দুর্নীতি দমন কমিশন-নিরপেক্ষ ও তৎপর কমিশন চাই

ভারতে নাগরিক আন্দোলনের নেতা আন্না হাজারের সাম্প্রতিক আন্দোলনের ঢেউ প্রতিবেশী দেশটিকে কাঁপিয়ে দিলেও তা আমাদের দেশে খুব তোলপাড় সৃষ্টি করেনি। তবে গণমাধ্যমসহ দেশের সচেতন নাগরিকরা আন্না হাজারের আন্দোলনের দিকে তীব্র নজর রাখছিলেন। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের দেশটির পরিচালকরা নাগরিক আন্দোলনের দাবি মেনে নিয়েছেন। নাগরিক আন্দোলন ও আন্না হাজারের জয় হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে রাষ্ট্র ও জনগণ।


দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয় সেখানে যেখানে সমস্বরে ধ্বনিত হয়েছে তার তুলনা সাম্প্রতিককালে নেই। আন্না হাজারে দীর্ঘদিন ধরে লোকপাল আইনের প্রস্তাব করে আসছিলেন, যার অধীনে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা তো বটেই, প্রধানমন্ত্রীও আসবেন। লোকপাল চাইলে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করতে পারবেন। অনেক দরকষাকষি, আন্দোলন-সংগ্রামের পর অবশেষে আন্নার চাওয়া অনুসারেই আইনটি লোকসভায় উত্থাপিত হতে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশে যখন দুর্নীতিবিরোধী শক্ত আইন হতে যাচ্ছে তখন উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। এখন এ দেশে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলছে ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইন অনুসারে। বলা চলে, দীর্ঘদিনের নাগরিক আন্দোলনের ফসল হিসেবে আইনটি তৈরি হয়েছিল এবং একাধিক সরকারের অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুর্নীতি দমন ব্যুরো থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন তৈরি হতে পেরেছিল। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দুদক পুনর্গঠিত হয় এবং ২০০৪ সালের আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আইন সংশোধনের পেছনের যুক্তি হলো, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুদক ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযান পরিচালনা করেছিল। কোনো তদন্ত, আলামত, প্রমাণ ছাড়াই দুদক আইনের আওতায় রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। দুদক কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিল সত্য, সে যুক্তিতে ২০০৪ সালের আইনের কিছু সংস্কার করা যেত। কিন্তু তা না করে দুদক আইনে ব্যাপক পরিবর্তনের উদ্যোগ এসেছে। ওয়াকিবহাল মানুষেরা বলছেন, এ সংশোধনী পাস হলে দুদক অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। শুধু তা-ই নয়, এ প্রতিষ্ঠান রাখার কোনো অর্থ দাঁড়াবে না। আমাদের দেশের রেওয়াজ হলো, ক্ষমতাসীন না থাকলেই কেবল সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং সে মামলা কখনো কখনো গতি পায়। যদিও জনমনে এ ধারণা তীব্র যে, যারা ক্ষমতাসীন থাকেন তাদের পক্ষেই দুর্নীতি করা সম্ভব এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা তা করেনও। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলার নজির এখানে খুব বেশি দেখা যায় না। অথচ দুর্নীতি রোধ করতে সেটিই সবচেয়ে জরুরি। শুধু রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী-সাংসদরাই নন, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রতিরোধের যথাযথ ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু সংশোধনীতে দেখা যাচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। অনুমতি নিয়ে মামলা করতে হলে স্বাভাবিকভাবে দুদকের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না। সংশোধনীটি কার্যত শক্তিশালী স্বাধীন দুদকের অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই এ সংশোধনী পাসের আগে সরকারের উচিত বিষয়টিকে আবারও পর্যালোচনা করা। সকলের মত নিয়ে একটি শক্তিশালী দুদক গঠন করতে পারলে সেটিই গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ বলে বিবেচিত হবে। তবে শুধু ভালো আইন করলেই চলবে না। কাগজে-কলমে স্বাধীন, নিরপেক্ষ কমিশন, আইনে কঠোর ধারা থাকলেই দুর্নীতি দমন হয় না। যারা এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করেন তাদেরও স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মানসিকতাসম্পন্ন হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের কর্মকর্তাদের কার্যকর তৎপরতা থাকতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। দুর্নীতি প্রতিরোধে শক্তিশালী ব্যবস্থা না থাকলে দুর্নীতি সরকারকে পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলতে পারে। সাম্প্রতিক অতীতে এমন উদাহরণ বাংলাদেশ দেখেছে। গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক একটি স্বচ্ছ ও সুশাসিত ব্যবস্থার স্বার্থে তাই শক্তিহীন নয়, শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন আইনই প্রত্যাশিত।
 

No comments

Powered by Blogger.