নরসিংদীতে আ'লীগ অফিসে ঢুকে গুলি: মেয়র নিহত

রসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নরসিংদী পৌরসভার মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেন অজ্ঞাত মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে গতকাল মঙ্গলবার রাতে নিহত হয়েছেন। তার মৃত্যুর খবরে ছড়িয়ে পড়লে নরসিংদী শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকশ' বিক্ষুব্ধ জনতা শহরের বাসস্ট্যান্ড, বাজির মোড়, বৌয়াকুড় ও স্টেশন রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় দোকানপাট এবং যানবাহন ভাংচুর করে। এতে ঢাকা-নরসিংদী যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার রাত সোয়া ১১টায় তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।


নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রেষ্ঠ মেয়র হিসেবে পরপর দু'বার স্বর্ণপদক লাভ করেন। নরসিংদী সদর থানার ওসি আনোয়ার হোসেন জানান, এ ঘটনায় স্থানীয় ছাত্রলীগ আজ থেকে টানা তিন দিনের হরতাল আহ্বান করেছে।
ধারণা করা হচ্ছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরেই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিহতের বোন সাজিয়া আফরিন রোজি বলেন, 'আমার ভাইয়ের কোনো শত্রু ছিল না। কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা আমরা বুঝতে পারছি না।'
মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেন এবার দ্বিতীয় দফায় মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি দেশের শ্রেষ্ঠ পৌর মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঢাকা বিভাগীয় পৌর মেয়র কমিটির সভাপতিও ছিলেন তিনি। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তার স্ত্রীর নাম তামান্না বাবলী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার রাত
সোয়া
৮টার দিকে লোকমানহোসেন নরসিংদী সদর রোডে বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সভা করছিলেন। এ সময় ৭-৮ জনের একদল অজ্ঞাত মুখোশধারী সন্ত্রাসী জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে ঢুকে খুব কাছ থেকে মেয়রকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করে দ্রুত পালিয়ে যায়। লোকমান হোসেনের পেটে, বুকের বাম পাশে দুটি, পেটে দুটি ও ডান হাতে গুলিবিদ্ধ হন। তাকে দ্রুত জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তাকে সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। এ সময় তাকে রক্ত দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. হরিদাস সাহা রাত সোয়া ১১টায় তার মৃত্যুর খবর ঘোষণা করেন। এর আগেই তার মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে উত্তাল হয়ে ওঠে নরসিংদী। নরসিংদী সদর থানার ওসি আনোয়ার হোসেন ওই সময় তার মৃত্যুর খবর জানালে, বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। তার মৃত্যুর খবরে সাত শতাধিক নেতাকর্মী হাসপাতালে ভিড় জমান। খবর পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও নরসিংদীর সাংসদ জহিরুল হক ভূঁইয়া, নারায়ণগঞ্জের সাংসদ নজরুল ইসলাম বাবু, নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজসহ অন্যরা ঢাকা মেডিকেলে ছুটে যান। হাসপাতালে উত্তেজনার কারণে রাত সোয়া ১২টায় তার লাশ ওটি থেকে গোপনে মর্গে নেওয়া হয়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নরসিংদী পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও ঠিকাদার সুদীপ্ত সাহা সমকালকে বলেন, সন্ধ্যায় লোকমান হোসেনসহ কয়েকজন নরসিংদী সদর রোডে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বসে আলোচনা করছিলেন। এ সময় হঠাৎ মুখোশধারী এক ব্যক্তি সেখানে ঢুকে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুখোশধারী ব্যক্তি লোকমানের কাছে পেঁৗছে তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। উপস্থিত অন্য সবাই ভয়ে মাটিতে বসে পড়েন। এরইমধ্যে মুখোশধারী আততায়ীরা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে পালিয়ে যায়।
রাত সোয়া ১১টায় মেয়র লোকমানের মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করার পর ক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা নরসিংদী শহর। লোকমানের অনুসারী ও বিক্ষুব্ধ জনতা রেলস্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেয়। পোড়ানো হয় স্টেশন মাস্টারের কক্ষ। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কার্যালয় সংলগ্ন সার্কিট হাউসে ভাংচুর চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। শহরে লাঠিমিছিল করেছে তারা। বিক্ষুব্ধ জনতা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। শহরজুড়ে বিক্ষোভ করছে। রাত পৌনে ১০টায় লোকমান হোসেনের নিজ এলাকা বাসাইলে রেললাইন অবরোধ করে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় তারা রেললাইন উপড়ে ফেলে। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা এগারসিন্ধু ট্রেনটি আটকে দেয় বিক্ষোভকারীরা। রাত থেকেই ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
বিক্ষোভকারীরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। এ সময় তারা ১২টি যাত্রীবাহী বাস ভাংচুর করে। রাত সাড়ে ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিক্ষোভ চলছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য শহরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঁইয়া ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য শহরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
গুলিবিদ্ধ লোকমান হোসেনের চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিতে রাতে ঢাকা মেডিকেলে উপস্থিত হন নরসিংদী-৩ আসনের সাংসদ জহিরুল হক ভূঁইয়া, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার সাংসদ নজরুল ইসলাম বাবু, আহত লোকমানের ভাই ও নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজসহ আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ।
সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে লোকমান হোসেনেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মেয়রের ঘনিষ্ঠজনেরা জানান, আওয়ামী লীগের একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মেয়র লোকমান। অপরের অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এক মন্ত্রীর কতিপয় প্রভাবশালী লোক। সম্প্রতি নরসিংদী সরকারি কলেজে ভর্তি-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে স্থানীয় ছাত্রলীগের শাহ আলম ও লেলিন গ্রুপ। শাহ আলম মেয়র লোকমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। লেলিন এক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। ভর্তি-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় লোকমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের চার নেতাকর্মীকে আটক করে পুলিশ। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে লোকমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কাইয়ুমের নেতৃত্বে গত মাসে নরসিংদী শহরে ঝাড়ূমিছিল করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.