জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯, একটি পর্যালোচনা by অধ্যক্ষ মুহাম্মদ যাইনুল আবেদীন

শিক্ষানীতি একটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৭ এপ্রিল প্রফেসর কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৮ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি খুব তড়িঘড়ি করে ২ সেপ্টেম্বর '০৯ জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেন, যা ওয়েব সাইটে ৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি দাবি করেছে, তারা ব্যাপক মতামত নিচ্ছেন।

এমনকি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৫৬টি সংস্থা ও সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে অালাদা আলাদা বিস্তারিত মতবিনিময় করা হয়েছে মর্মে চূড়ান্ত খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কোন্ কোন্ সংস্থা ও সংগঠন মতামত দিয়েছে তার নামের তালিকা পরিশিষ্টে সংযোজন করা হয়নি। এতে কোন্ কোন্ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মতামত নেয়া হয়েছে, চূড়ান্ত খসড়ায় তার উল্লেখ না থাকায় জনমনে সংশয় ও সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল প্রণয়নে যেভাবে ব্যাপকভিত্তিক মতামত নেয়া দরকার ছিল তা করা হয়নি বলে দেশবাসীর কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে। এই শিক্ষানীতিতে বেশকিছু অসঙ্গতি লক্ষ্য করা হয়েছে। যেমন-ক. শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের সেক্যুলার, গণমুখী, সুলভ, সুষম, সার্বজনীন, সুপরিকল্পিত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। অথচ বর্তমান সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা ও সেক্যুলার শব্ধ দুটি বাদ দিতে হবে। খ. বলা হয়েছে, এই শিক্ষা ব্যবস্থা নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি করবে অথচ ধর্মীয় শিক্ষাকে একেবারে উপেক্ষা করা হয়েছে। তাই নৈতিকতাবোধ সৃষ্টির জন্য ধর্ম শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাই শিক্ষার্থীদের মূল ভিত্তি। অথচ সেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে ললিতকলা শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যা একজন শিক্ষার্থীর মন-মানসিকতাকে ধর্মবিমুখ করার জন্য যথেষ্ট। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা করা হলে দুই কোটি শিক্ষার্থীর জন্য তিন লাখ শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। এছাড়া এর জন্য যে বড় ধরনের অবকাঠামো প্রয়োজন তাও পূরণ করা সম্ভব নয়। প্রাথমিক শিক্ষা পাঁচ বছর থেকে আট বছর করার প্রস্তাব অবাস্তব। উন্নত দেশগুলোতে ছয় বছরের প্রাথমিক শিক্ষা। কোথাও আট বছরের প্রাথমিক শিক্ষা নেই। সুতরাং শিক্ষার স্তর বিন্যাস আগের মতো থাকাই বাঞ্ছনীয়। মাদরাসা শিক্ষার এবতেদায়ি বা প্রাথমিক স্তরে ১ম ও ২য় শ্রেণীতে সাধারণ শিক্ষার মতো বাংলা, গণিত ও ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেখানে কোরআন শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কোরআন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। তৃতীয় শ্রেণী থেকে কোরআন, তাজবিদ, আরবি ১ম পত্র, আকাঈদ ও ফিকহ, আরবি ২য় পত্র অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। অথচ উপরোক্ত বিষয়গুলো মাদরাসা শিক্ষার জন্য মৌলিক বিষয়। তাই মাদরাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার স্বার্থে বিষয়গুলোকে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে রাখতে হবে। মাদরাসা শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে অন্যান্য ধারার সঙ্গে মাদরাসা শিক্ষায় অভিন্ন বিষয়গুলো অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। এটি একটি অগ্রহণযোগ্য প্রস্তাব। সাধারণ শিক্ষার অনুরূপ এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক পড়িয়ে এবং অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নিয়ে মাদরাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা এবং উপরোক্ত গুণাবলী মাদরাসা শিক্ষার্থীদের থেকে আশা করা বাতুলতা মাত্র। বর্তমানে মাদরাসা শিক্ষার জন্য সিলেবাস ও কারিকুলাম নির্ধারিত রয়েছে। ওই সিলেবাস ও কারিকুলামকে আলাদা রেখে আরও মানসম্পন্ন করা যেতে পারে। মাদরাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে ৮ম কৌশল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, 'সাধারণ শিক্ষা ধারায় অনুসৃত শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রক্রিয়া মাদরাসা শিক্ষা ধারায় অনুসরণ করতে হবে। তবে ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া অন্যান্য বিষয় (যথা-ইংরেজি, বাংলা, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়, কলা, কারিগরি শিক্ষা) বিভিন্ন পর্যায়ে প্রান্তিক মূল্যায়ন করবে নিজ নিজ দায়িত্ব অনুযায়ী মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড বা প্রস্তাবিত তথ্য-প্রযুক্তি, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা কাউন্সিল। ধর্মীয় শিক্ষার মূল্যায়ন মাদরাসা বোর্ডের দায়িত্বে থাকবে।' এ কৌশলের মাধ্যমে দ্বৈত শাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং মাদরাসা বোর্ডকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। মাদরাসার শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করে তাদের থেকে মূল্যায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সরিয়ে অন্যদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। অথচ মাদরাসার ওই বিষয়গুলোর শিক্ষকমন্ডলী একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিধারী ব্যক্তি। তাই মাদরাসা শিক্ষার স্বার্থে মাদরাসা শিক্ষকদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। প্রস্তাবিত শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতি বাস্তবায়ন না করে বিদ্যমান মাদরাসা শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতি অব্যাহত রাখতে হবে। নবম কৌশল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, 'মাদরাসা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই শিক্ষার সকল স্তরে সুচারুরূপে পরিচালনা, তদারকি, সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিতরূপে স্থানীয় জন-তদারকি, পরিবীক্ষণ ও অ্যাকাডেমিক পরিদর্শনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।' এ কৌশল অবলম্বনের ফলে গভর্নিং বডি/ম্যানেজিং কমিটির ক্ষমতা খর্ব হবে, দলীয় প্রভাব বৃদ্ধি পাবে, মাদরাসা শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই মাদরাসা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিকল্পে প্রস্তাবিত কৌশলের পরিবর্তে বিদ্যমান তদারকি, পরিবীক্ষণ ও নিরীক্ষণ ব্যবস্থা আরও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। দশম কৌশল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, 'মাদরাসা শিক্ষার উচ্চ অর্থাৎ ফাজিল ও কামিল পর্যায়ে শিক্ষাক্রম/পাঠ্যপুস্তক অনুমোদন, শিক্ষাঙ্গনগুলোর তদারকি ও পরিবীক্ষণ এবং পরীক্ষা পরিচালনাসহ সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব বর্তমানে কুষ্টিয়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ন্যস্ত। একটি নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এই বিশাল দায়িত্ব পালন দুরূহ বলে মাদরাসা বোর্ডকে অনুমোদনকারী (অ্যাফিলিয়েটিং) ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করে এ দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। বর্তমানে মাদরাসা বোর্ড যে দায়িত্ব পালন করছে, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শাখা সেসব দায়িত্বও পালন করবে।' এ কৌশলটি ৭ম কৌশলের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ৭ম কৌশল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, 'মাদরাসা শিক্ষার ইবতেদায়ি, আলিম স্তরের স্বীকৃতি প্রদান, নবায়ন, ধর্মীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে পরীক্ষা গ্রহণ, সনদ প্রদান ইত্যাদি কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডকে প্রয়োজনের নিরিখে পুনর্গঠন করে আরও সুসংগঠিত ও কার্যকর করতে হবে। উপরোক্ত কৌশল দুটি থেকে এটা সুসপষ্ট যে, ১০ নং কৌশলে মাদরাসা বোর্ডকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার প্রস্তাব করা হয়েছে, অন্যদিকে ৭ নং কৌশলে বোর্ডকে প্রয়োজনের নিরিখে পুনর্গঠন করে আরও সুসংগঠিত ও কার্যকর করার প্রস্তাব করে স্ববিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে একদিকে মাদরাসা বোর্ডের মর্যাদা, ক্ষমতা এবং ঐতিহ্য নষ্ট করা, অন্যদিকে ফাজিল ও কামিলের মান ধ্বংস করার নীলনকশা বাস্তবায়নের চক্রান্ত করা হয়েছে। মাদরাসা বোর্ডকে অ্যাফিলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরকরণ প্রক্রিয়া আইনগত দিক থেকে একটি অত্যন্ত জটিল বিষয়ই শুধু নয়, এটি একটি অবাস্তব প্রস্তাবও বটে। এ অবস্থায়, যদি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ দায়িত্ব সরাতে হয় তাহলে মাদরাসা বোর্ডকে অ্যাফিলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর না করে মাদরাসার শিক্ষার সঙ্গে জড়িতদের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি ঢাকায় একটি অ্যাফিলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তার ওপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত করা যেতে পারে। এগারতম কৌশল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, 'মাদরাসা শিক্ষার উচ্চ পর্যায়ে এবং সাধারণ শিক্ষার উচ্চ পর্যায়ের মধ্যে ডিগ্রির সমতা সরকার নির্ণয় করবে।' এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, মহান জাতীয় সংসদে বিল পাস করে ফাজিলকে স্নাতক ডিগ্রি ও কামিলকে মাসটার্স ডিগ্রির সমমান প্রদান করা হয়েছে। আইন দ্বারা বিষয়টি মীমাংসিত। একটি মীমাংসিত বিষয় সম্পর্কে অহেতুক নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করে মীমাংসিত বিষয়কে বিতর্কিত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এ অবস্থায় এ বিষয়ে প্রস্তাবিত কৌশল বাতিল করে বিদ্যমান মীমাংসিত অবস্থা বজায় রাখতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, নৈতিকতাসম্পন্ন জনশক্তি তৈরির জন্য শিক্ষার সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। বর্তমানে মাদরাসা শিক্ষা বাংলাদেশের একটি অন্যতম শিক্ষাধারা, যা নৈতিকতাসম্পন্ন সুনাগরিক উপহার দিচ্ছে। সুতরাং এ শিক্ষার স্বকীয়তা বজায় রেখে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সমন্বয় করা যেতে পারে। অন্যথায় জনগণ তা মেনে নেবে না।

No comments

Powered by Blogger.