যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার বামঘরানার দেশগুলোর সম্পর্ক by আহমেদ জামিল

লাতিন আমেরিকার বামঘরানার দেশগুলোর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এ অঞ্চলে তার মিত্র দেশগুলোর সংঘাতপূর্ণ সম্পর্কের বিষয়টি দিন দিন সপষ্ট হয়ে উঠছে। অথচ বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার পর কিউবা ও ভেনিজুয়েলাসহ লাতিন আমেরিকার বামঘরানার দেশগুলোর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার ব্যাপারে একটা আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল অনেকের মধ্যে।


কিন্তু বাস্তবতা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার মসনদে যিনিই বসুন না কেন তার পক্ষে সাম্রাজ্যবাদী নীতি পরিত্যাগ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যে কারণে বারাক ওবামা সরকারও চাচ্ছে না মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় বামঘরানার সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক এবং ক্ষমতায় টিকে থাকুক। কারণ বামপন্হী সরকারগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও কর্তৃত্ববিরোধী। এ বাস্তবতার নিরিখেই কিউবার ওপর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরও এক বছর বৃদ্ধি করেছে ওয়াশিংটন। হন্ডুরাসে বামপন্হী প্রেসিডেন্ট জেলায়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে মার্কিন মদদের অভিযোগ উঠেছে। এর পাশাপাশি কলম্বিয়ায় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর এসব ঘটনা আমেরিকা মহাদেশে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের পাশাপাশি আহমাদিনেজাদের ইরানের সঙ্গে ভেনিজুয়েলা এবং বলিভিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ওয়াশিংটন এবং পেন্টাগনের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি লাতিন আমেরিকার বামঘরানার দেশগুলো যে সমাজতান্ত্রিক নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভীষণ অপছন্দ। এছাড়া বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ-এর খপ্পর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লাতিন আমেরিকার বামপন্হী সরকারগুলো দেশের অভ্যন্তরে নানা ধরনের গণমুখী নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণের সঙ্গে একই মতাদর্শের দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার লক্ষ্যে 'অল্টারনেটিভ ফর দ্য আমেরিকানস' গঠন করেছে। এ উদ্যোগকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থের পরিপন্হী হিসেবে দেখছে। কেননা এর ফলে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। যাই হোক, ফিদেল ক্যাষ্ট্রোর ছোটভাই রাউল ক্যাষ্ট্রো প্রেসিডেন্ট হবার পর কিছু সংস্কারমুখী কর্মসূচি গ্রহণের কারণে কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে ওয়াশিংটনের তরফ হতে বেশ ইতিবাচক কথাবার্তা বলা হয়। কিন্তু অচিরেই কিউবা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র তার আগের নীতি-অবস্থানে ফিরে আসে। কিউবা তার সমাজতান্ত্রিক নীতি-আদর্শ পরিত্যাগ না করার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এ সিদ্ধান্ত নেয়। গত ১ আগষ্ট কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাষ্ট্রো সুসপষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, হাভানা ওয়াশিংটনের সঙ্গে সংলাপে রাজি, তবে সমাজতান্ত্রিক নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনা হবে না। প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাষ্ট্রোর এ ঘোষণা ওয়াশিংটনকে বেশ বিব্রত এবং আশাহত করে। প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাষ্ট্রোর এ ঘোষণার প্রায় এক মাস পর বারাক ওবামার প্রশাসন কিউবার ওপর ১৯৬২ সালের জারি করা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, তিনি মনে করেন কিউবার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে। প্রেসিডেন্ট ওবামা চাইছেন নিষেধাজ্ঞা ওঠানোর আগে কিউবাতে যথেষ্ট গণতান্ত্রিক সংস্কার আনা হোক। আর এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে কিউবা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ার ক্ষীণ আশাটুকু মিলিয়ে গেল। উল্লেখ্য, এ বছরের শুরুতে ত্রিনিদাদের রাজধানী পোর্ট অব সেপনে সামিট অব আমেরিকানস ব্যর্থ হয়েছে মূলত মার্কিন আপত্তির প্রেক্ষিতে অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান ষ্টেটসে কিউবাকে সদস্য পদ না দেয়ার কারণে। যে জন্য নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল ওর্তেগা সখেদে বলেছিলেন, 'এ সম্মেলনে কিউবা উপস্থিত নেই। কারণ তার অপরাধ হলো সে স্বাধীনতা এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে।' এদিকে মধ্য আমেরিকার দেশ হন্ডুরাসে সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নির্বাচিত বামপন্হী প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল জেলায়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার ঘটনার সূত্র ধরে এ অঞ্চলের বামঘরানার দেশগুলোর সঙ্গে হন্ডুরাসের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা এবং এক ধরনের রহস্যজনক নীরবতার কারণেই এহেন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। মুখে অভ্যুত্থানের নিন্দা করলেও ওবামা প্রশাসন হন্ডুরাসের সামরিকজান্তা নিয়ন্ত্রিত মিচেলেত্তি সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এদিকে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল জেলায়া এখন হন্ডুরাসে প্রত্যাবর্তন করে ব্রাজিল দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছেন। হন্ডুরাসের সামরিক বাহিনী ব্রাজিল দূতাবাস ঘিরে রাখার প্রেক্ষিতে ব্রাজিল সরকার ঘোষণা করেছে যে, তাদের দূতাবাস আক্রান্ত হলে হন্ডুরাসকে কঠোর পরিণতি ভোগ করতে হবে। এর আগে একই ধরনের হুমকি দিয়েছিল ভেনিজুয়েলা এবং ইকুয়েডর। এদিকে দিন যতই অতিবাহিত হচ্ছে ততই এটি সপষ্ট হয়ে উঠছে যে, হন্ডুরাসে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেলায়াকে উচ্ছেদের পেছনে মার্কিন মদদ রয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট জেলায়া সরকারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাট্রিসিয়াভ্যালে বার্তা সংস্থা এপিকে বলেছেন, 'জেলায়ার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত।' এছাড়া বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসও বলেছেন, 'মার্কিন সামরিক বাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ড হন্ডুরাসের সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ছিল।' বিশ্লেষকরা বলছেন, বামপন্হী নীতির পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্হী ভূমিকা পালনের কারণেই জেলায়াকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা হচ্ছে, ২০০৫ সালে হন্ডুরাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সিএএফটিএ সম্পাদন করে। ওই বছরের ডিসেম্বরে হন্ডুরাসের প্রধান সমুদ্র বন্দর পুয়ার্টো কোর্টসে যুক্তরাষ্ট্র 'ইউএস কনটেইনার সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ' চালু করার প্রস্তাব দেয়। ওয়াশিংটন আমেরিকান মেরিন সেনাবাহিনীর দ্বারা সমুদ্র বন্দরটি নিয়ন্ত্রণ এবং জাহাজ চলাচল পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। জেলায়ার সরকার এর বিরোধিতা করলে হন্ডুরাসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। শুধু হন্ডুরাসে জেলায়াকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের ঘটনা নয়, বারাক ওবামা ওয়াশিংটনের মসনদে বসার পর ভেনিজুয়েলা এবং বলিভিয়ায় অনুষ্ঠিত গণভোটে শ্যাভেজ এবং মোরালেসবিরোধী দক্ষিণপন্হী দলগুলোকে ওবামা প্রশাসনের তরফ হতে মদতদানের অভিযোগ উঠেছিল। এমনকি সম্প্রতি বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসকে ব্যর্থ হত্যা প্রয়াসের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও উঠেছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে কলম্বিয়ার দক্ষিণপন্হী সরকারের সম্মতিতে দেশটির সাতটি সামরিক ঘাঁটিতে মাদকদ্রব্য পাচার রোধের নামে মার্কিন সৈন্য মোতায়েন সংক্রান্ত চুক্তির ইস্যুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ আমেরিকার বামঘরানার দেশগুলোর সঙ্গে কলম্বিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইকুয়েডর, এল সালভাদর, প্যারাগুয়ে এবং ভেনিজুয়েলা এই চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছে। তবে সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে ভেনিজুয়েলার তরফ হতে। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এই চুক্তি তার দেশে মার্কিন হামলা চালানোর পূর্বপ্রস্তুতির অংশ। ভেনিজুয়েলা কলম্বিয়া সীমান্তে এরই মধ্যে কয়েক ডিভিশন সৈন্য পূর্ণ যুদ্ধের প্রস্তুতিতে রেখেছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ ঘোষণা দিয়েছেন, তার দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে সমরাসত্র কেনার জন্য ২২০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে। শ্যাভেজ ঘোষণা করেছেন, রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা রকেট খুব শিগগির মোতায়েন করা হবে পাহাড়, সমতল, উপকূল এবং মাটির নিচে। শ্যাভেজ মন্তব্য করেন, কোনো শত্রু বিমান ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে এলেই তাকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে। উল্লেখ্য, এর মধ্যে ভেনিজুয়েলা রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ নৌমহড়া সম্পন্ন করেছে। ইরান সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের সঙ্গে দেয়া এক যৌথ বিবৃতিতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এসব ঘটনা থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন এবং তার মদতপুষ্ট দক্ষিণপন্হী তথা প্রতিবিপ্লবী সামরিক কিংবা যে কোনো ধরনের অভ্যুত্থান প্রতিহত করার লক্ষ্যে লাতিন আমেরিকার বামঘরানার দেশগুলো নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি দিন দিন জোরদার করছে। তারা তাদের পক্ষে রাশিয়া ও চীনের মতো বৃহৎ শক্তি এবং ইরানের মতো আঞ্চলিক শক্তিকে কাছে টানতে সক্ষম হয়েছে। এ ধরনের ঘটনাকে কেউ কেউ নতুন আরেকটি স্নায়ু যুদ্ধের সূচনা বলে মূল্যায়ন করছেন। লেখক : কলেজ শিক্ষক এবং কলামিষ্ট

No comments

Powered by Blogger.