পদোন্নতি নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে অসন্তোষ

বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক পদে ৬৪৪ জন এবং সহযোগী অধ্যাপক পদে ১২১ জন চিকিৎসক পদোন্নতি পেয়েছেন। সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া চিকিৎসকদের ৯০ জন ক্যাডারভুক্ত নন। গত সোমবার গভীর রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে পদোন্নতি পাওয়া চিকিৎসকদের নামের তালিকা প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। পদোন্নতিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক পরিচয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

নন-ক্যাডার যেসব চিকিৎসক পদোন্নতি পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন: চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব শারফুদ্দীন আহমেদের স্ত্রী ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের চিকিৎসক নাফিজা আহমেদ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের অবেদনবিদ্যা বিভাগের চিকিৎসক ও নন-ক্যাডার চিকিৎসক সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, বিএমএর দপ্তর সম্পাদক ও জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক কামরুল হাসান, বিএমএ কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক উত্তম বড়ুয়া, জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটের (এনআইসিভিডি) চিকিৎসক ও বিএমএর দপ্তর সম্পাদক কামরুল হাসান, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ও বিএমএ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মো. নাইমুল হক শাম্মী, স্বাচিপ আহ্বায়ক নারয়ণচন্দ্র দত্ত ও স্বাচিপ সভাপতি বিশ্বাস আক্তার হোসেন, স্বাচিপ নেতা মো. আবু রায়হান এবং হঠাৎ নেতা হয়ে ওঠা চিকিৎসক মো. আবদুর রউফ ।
এসব চিকিৎসকদের মধ্যে এনআইসিভিডির চিকিৎসক কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় তদন্ত চলছে, আবু রায়হানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পরিবর্তে ক্লিনিকে ব্যক্তিগত রোগী দেখার অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করেই।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) মাধ্যমে শুধু ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকদের পদোন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু তালিকায় ক্যাডারভুক্ত নন এবং বিভিন্ন সময় উন্নয়ন প্রকল্পে নিয়োগ পেয়েছেন, এমন ৯০ জন চিকিৎসক পদোন্নতি পেয়েছেন।
বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকেরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ছয় বছর পর সরকার একটি অগ্রহণযোগ্য ও অসংগতিপূর্ণ তালিকা প্রকাশ করেছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সরকার আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) প্রভাবশালী নেতাদের ইচ্ছায় তালিকা করেছে। সরকারি কর্মকমিশনের মেধা যাচাই-প্রক্রিয়া গুরুত্ব পায়নি।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, রাজনীতি না করায় পদোন্নতি পাবেন না, এই আশঙ্কায় অনেকেই একাধিকবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু আবার সভা ডাকতে হবে, এই অজুহাতে মন্ত্রণালয় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে যুগ্ম সচিব আশরাফুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কথা বলা যায়নি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ূন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা জ্যেষ্ঠতা এবং যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে পদোন্নতির সুপারিশ করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে স্বাচিপের মহাসচিব এম ইকবাল আর্সলান বলেন, তিনি মনে করেন নিরপেক্ষভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যদি তা না-ই হতো, তাহলে তাঁকে স্বাচিপ নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়তে হতো না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তিন ধরনের চিকিৎসক আছেন। ১৯৮২ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৯৮৬ সালের ১৭ মে পর্যন্ত ছয় মাসের জন্য নিয়োগ পাওয়া ছয় হাজার ৩৭ জনকে ইন-সার্ভিস ট্রেইনি বলা হয়। এঁদের চার হাজার ৬৭৫ জন পরে বিসিএস পরীক্ষা দেন। অবশিষ্ট এক হাজার ৩৬২ জন আইএসটি হিসেবে পদোন্নতির জন্য আবেদন করতে পারবেন বলে অধিদপ্তর জানায়। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ক্যাডার চিকিৎসক সমিতি মন্ত্রণালয় বরাবর একাধিকবার চিঠি দিয়েছে। কিন্তু তাদের এই আবেদন শেষ পর্যন্ত সরকার আমলে নেয়নি। আইএসটি ক্যাটাগরিতে পদোন্নতি পেয়েছেন ১৯৯৬ সাল থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকেরাও।
বঞ্চিত চিকিৎসকেরা বলছেন, ক্যাডারভুক্ত নন এবং বিভিন্ন সময় প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকেরা কীভাবে পদোন্নতি পেলেন, তা স্পষ্ট করেনি কর্তৃপক্ষ।
জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন: নাক, কান, গলা বিভাগের পদোন্নতিবঞ্চিত একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সিরাজুল ইসলাম মাহফুজ (ষষ্ঠ বিসিএস), আশফাক আহমেদ (অষ্টম বিসিএস), জোবায়ের হোসেন (অষ্টম), আবু কায়সার (নবম), শফিকুল ইসলাম (নবম) পদোন্নতি পাননি। তাঁদের ডিঙিয়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ১৩তম বিসিএসের চিকিৎসকদের।
একই ঘটনা ঘটেছে ইউরোলজি বিভাগে। ১৯৮৮-৮৯ সালে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকদের ডিঙিয়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ১৫তম বিসিএসের আমানুর রসূল, কাজী মনোয়ারুল করিম ও মো. শওকত আলমকে। মেডিসিন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন খুলনা মেডিকেল কলেজের শেখ ছাইদুল হক। নিয়ম অনুযায়ী সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কমপক্ষে তিন বছরের অভিজ্ঞতা ছাড়া সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া যাবে না। ছাইদুলের এই অভিজ্ঞতা নেই। যদিও এ বিভাগে অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসক ছিলেন।
মেডিসিন বিভাগের পদোন্নতিবঞ্চিত চিকিৎসকদের অভিযোগ, মোট ৫২টি পদ শূন্য থাকলেও শুধু ১২টি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। স্বাচিপের কট্টর সমর্থক পাওয়া যায়নি বলে এমনটি করা হয়েছে বলে দাবি তাঁদের।

No comments

Powered by Blogger.