দুর্গতিনাশিনী দুর্গা by তারাপদ আচার্য্য

'যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥' শরতের ছেঁড়া মেঘের আকাশ। মহালয়া শেষ। দেবী দুর্গার আগমন বার্তা আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে ভক্তদের মনে বইছে আনন্দের জোয়ার। ক'দিন আগেই মুসলমানদের ঈদের আনন্দ কাটতে না কাটতে আবার শুরু হয়েছে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ পূজা দুর্গাপূজা। সম্প্রীতির এই দেশে এ পূজা সবার।

আমরা সবাই ঈদে যেমন আনন্দ করি তেমনি দুর্গাপূজাতেও মেতে উঠি উৎসবের আমেজে। এছাড়া বুদ্ধপূর্ণিমাতেও বৌদ্ধদের সঙ্গে মিশে পালন করি বুদ্ধপূর্ণিমা। আবার খ্রিষ্টানদের বড়দিনে আমাদের আনন্দের শেষ থাকে না। তাই ঈদ, পূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিন আমাদের সবার। সবাই আমরা সব উৎসবের ভাগীদার। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বারো মাসে তেরো পূজা। এত পূজার ভেতরও দুর্গাপূজা ভিন্নমাত্রা পেয়েছে সমাজে। কথিত আছে, এই অকালে শ্রীরামচন্দ্র অশুভ শক্তির প্রতীক রাবণ রাজাকে পরাজিত করতে শক্তি সঞ্চারে মায়ের পূজা করেছিলেন। তাই এই পূজাকে অকালবোধন আবার কেউ কেউ শারদীয়া পূজা নামেও উল্লেখ করে থাকেন। দুর্গাপূজার ব্যাপ্তি অনেক। শুধু বাংলাদেশে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়, তা নয়। ভরত, নেপাল, শ্রীলংকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের অবাঙালিরাও ভিন্ন ভিন্ন নামে এ উৎসব পালন করে থাকে। যেমন কাশ্মীর ও দাক্ষিণাত্যে অম্বা ও অম্বিকা, গুজরাটে হিঙ্গুলা ও রুদ্রাণী, কান্যকুব্জে কল্যাণী, মিথিলায় উমা এবং কুমারিকা প্রদেশে কন্যাকুমারী নামে মা দুর্গার পূজা হয়ে থাকে। ধর্মীয়শাসেত্র আমরা দুর্গার বিভিন্ন নাম পাই। দুর্গা, মহিষমর্দিনী, শূলিণী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারি, বাহারী, চন্ডী, লক্ষ্মী, উমা, হৈমবতী, কমলা, শিবাণী, যোগনিদ্রা প্রভৃতি নামে ও রূপে মায়ের পূজা হয়ে থাকে। দুর্গাপূজায় মায়ের আরাধনার মতো দেবীমূর্তির ইতিহাসও অনেক সুপ্রাচীন। আজকের এই রূপরেখার পেছনে রয়েছে তারই রূপলাবণ্য গড়ে ওঠার এক চমকপ্রদ ইতিহাস। অশুভ শক্তিকে দমন করার জন্য দেবী দুর্গার সৃষ্টি। পুরাণের মত অনুসারে, শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে কেশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ, চন্দ্র তেজে স্তনদ্বয়, ইন্দ্রের তেজে মধ্যভাগ, বরুণের তেঝে জংঘা ও ঊরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল।...... মহাদেব দিলেন শূল, কৃষ্ণ দিলেন চক্র, শঙ্খ দিলেন বরুণ, অগ্নি দিলেন শক্তি.... [দ্র : হংসনারায়ণ, (১৯৮০, ১৭৫)] এই হলো বিপদনাশিনী দেবীমাতা দুর্গা। ঋগবেদের দেবীসুক্তে, রাজসনেরীসংহিতা, কেনোপানিষদ, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় আরণ্যক, রামায়ণ, মহাভারত, বৌদ্ধ জৈন তন্ত্র গ্রন্হসমূহ, দেবী ভাগবত, স্কন্দপুরাণ, মার্কন্ডেয়পুরাণ, কালিকাপুরাণ, বৃহন্নারদীয় পুরাণ, বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ প্রভৃতি শাক্তপুরাণ, উপপুরাণসমূহে সিংহবাহিনী দেবী দুর্গার বিশেষ বিবরণ ও পূজার ব্যবস্থা আছে। দুর্গতি হতে ত্রাণ করেন বলেই দেবীর নাম হয়েছে দুর্গা। রাজ্যভ্রষ্ট রাজা যুধিষ্ঠির বিপদ হতে মুক্তিলাভ করার জন্য মা দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বলে মহাভারতের বিরাট পর্বের ষষ্ঠাধ্যায়ে উল্লেখ আছে। দেবীর স্তোত্রে আছে-'দুর্গাৎ তারয়সে দুর্গে তৎত্বং দুর্গা স্মৃতি জনৈঃ।' চন্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী- দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গ বিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগতকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি মা দুর্গা। ব্রহ্মার বরে পুরুষের অবধ্য মহিষাসুর নামে এক দানব স্বর্গরাজ্য দখল করলে রাজ্যহারা দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণুর নির্দেশে সকল দেবতার তেজঃপুঞ্জ থেকে যে দেবীর জন্ম হয় তিনি দুর্গা। দেবতাদের শক্তিতে শক্তিময়ী এবং বিভিন্ন অসেত্র সজ্জিতা হয়ে দেবী যুদ্ধে মহিষাসুরকে বধ করেন। তাই দেবীর এক নাম হলো মহিষমর্দিনী। দুর্গপূজার প্রচলন সম্পর্কে পুরাণের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই- পুরাকালে রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্বজনপ্রতারিত সমাধি বৈশ্য একদিন মেধস মুনির আশ্রমে যান। সেখানে মুনির পরামর্শে তাঁরা দেবী দুর্গার পূজা করেন। পূজায় তুষ্টা হয়ে দেবী তাঁদের মনের ইচ্ছে পূরণ করেন। এই পূজা বসন্তকালে হয়েছিল বলে এর এক নাম বাসন্তী পূজা। শারদীয় দুর্গোৎসবে আশ্বিনের শুক্লাষষ্ঠী থেকে শুক্লানবমী পর্যন্ত দেবীদুর্গার পূজা হয়ে থাকে। দেবীর সঙ্গে যুক্ত হয় আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্যাবিজ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী, সর্বৈশ্বর্য প্রদায়িণী দেবী লক্ষ্মী, সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশ, বলরূপী কার্তিক এবং ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মূর্তবিগ্রহ দেবাদিদেব মহাদেব। এ যেন একই সঙ্গে শক্তি, জ্ঞান, ঐশ্বর্য, সিদ্ধি, বল ও বৈরাগ্যের এক অপূর্ব সমাবেশ। ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। শাসত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে। সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা প্রবেশ। কদলীবৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে একটি বধূ আকৃতিবিশিষ্ট করে দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়। প্রচলিত ভাষায় একে 'কলাবউ' বলে। অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান- অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে আটচল্লিশ মিনিটে দেবীর বিশেষ পূজা 'সন্ধিপূজা'। অষ্টমী তিথিতে কোনো কুমারী বালিকাকে এনে পূজা করা হয়। একে কুমারীপূজা বলে অভিহিত করা হয়। নবমীতে হোমযজ্ঞের দ্বারা পূজার পূর্ণাহূতি দেয়ার রীতি। দশমী তিথিতে হয় দেবীর বিসর্জন। এই দশমী তিথি বিজয়াদশমী নামে খ্যাত। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে এই দিনে শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক রাবণ নিহত হয়েছিলেন। দুর্গাপূজা তিন প্রকার : সাত্ত্বিক (জপ, যজ্ঞ ও নিরামিষ ভোগ দ্বারা পূজা), তামসিক (কিরাতদের জন্য বিহিত : এতে জপ, যজ্ঞ ও মন্ত্র নেই। মদ্য, মাংস প্রভৃতি দ্বারা পূজা করা হয়) ও রাজসিক (পশু বলি ও আমিষ ভোগ দ্বারা পূজা করা হয়)। অতীতে দুর্গাপূজার সময় ছাগ, মেষ, হরিণ, শূকর, গন্ডার, বাঘ গো-সাপ, কচ্ছপ বা পাখি বলি দেয়া হতো। বর্তমানে অবশ্য বলির প্রচলন নেই বললেই চলে। মা দুর্গা সাধারণত দশভুজা। তবে কোনো কোনো শাসেত্র তার বাহুর সংখ্যা চার, আট, দশ, ষোলো, আঠারো বা কুড়ির কথা উল্লেখ আছে। মায়ের গায়ের রং হবে আতসীপুষ্পবর্ণ বা তপ্তকাঞ্চনবর্ণ, কখনওবা রক্তবর্ণ। প্রতিমা ছাড়াও পূজা হতে পারে দর্পণে, অনাবৃত ভূমিতে, পুস্তকে, চিত্রে, ত্রিশূলে, শরে, খড়গে বা জলে। বাংলাদেশে দুর্গাপূজার ইতিহাসে যা জানা যায় তা হলো- প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) রাজত্বকালে রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ। মতান্তরে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮৩)। কিন্তু জীমূতবাহনের (আনু, ১০৫০-১১৫০) দুর্গোৎসবনির্ণয়, বিদ্যাপতির (১৩৭৪-১৪৬০) দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী, শূলপাণির (১৩৭৫-১৪৬০) দুর্গোৎসববিবেক, কৃত্তিবাস ওঝার (আনু, ১৩৮১-১৪৬১) রামায়ণ, বাচসপতি মিশ্রের (১৪২৫-১৪৮০) ক্রিয়াচিন্তামণি, রঘুনন্দনের (১৫শ-১৬শ শতক) তিথিতত্ত্ব ইত্যাদি গ্রন্হে দুর্গাপূজার বিস্তৃত বর্ণনা থাকায় অনুমান করা হয় যে, বাংলায় দুর্গাপূজা দশম অথবা একাদশ শতকেই প্রচলিত ছিল। হয়তো কংসনারায়ণ কিংবা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে তা জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। উনিশ শতকে কলকাতায় মহাসমারোহে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো। মূলত দুর্গাপূজা হলো অশুভ, অন্যায়, পাপ, পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে ন্যায়, পূর্ণ, সত্য, শুভ ও সুন্দরের যুদ্ধ। এ পূজা আমাদের চিত্তশক্তি জাগরণের পূজা। শত্রু দমনের জন্য চাই শক্তি ও সাহস, বিপদে ধৈর্য, সাংসারিক জীবনে চাই সুখ ও সম্পদ। দুর্গতি থেকে রক্ষা, বিভেদ, বিবাদ, অনৈক্য, সাম্প্রদায়িকতা, ক্ষুদ্রস্বার্থবোধ ও সংকীর্ণতা প্রভৃতির ঊর্ধ্বে ওঠার জন্য মহাশক্তির বরলাভ একান্ত প্রয়োজন। আত্মশক্তির উত্থান ঘটাতে না পারলে সৃষ্টিকে জয় করা সম্ভব নয়। হৃদয়ের শক্তিকে জাগ্রত করা, প্রলোভনের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আদ্যাশক্তি মহামায়ার কৃপালাভের জন্য দুর্গাপূজা করা আমাদের অবশ্যই প্রয়োজন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যেও সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করার এমন সৌহার্দ্য, হিংসা, বিদ্বেষ, কলুষতামুক্ত ভালোবাসার সপন্দনে মথিত, গৌরাবান্বিত হওয়ার অপূর্ব সুযোগ মেলা ভার। লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.