নব অনুরাগে নয়াচীনের জাতীয় দিবস by শওকত মাহমুদ

তুন রাষ্ট্র ব্যবস্থার ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনে আজ পয়লা অক্টোবর গণচীন মহা উল্লাসমুখর। রাজধানীর কেন্দ্রস্থল ৬শ' বছর ধরে রাষ্ট্রমঞ্চ হিসেবে সুবিদিত তিয়েন আন মেন স্কোয়ার সেজেছে ফুলে ফুলে, নব অনুরাগে। ১৯৪৯ সালের এই দিনে বিকাল ৩টায় যেখানে দাঁড়িয়ে কিংবদন্তির রাষ্ট্রনায়ক মাও সে তুং নয়াচীন পত্তনের ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেখানেই প্রেসিডেন্ট হু জিন তাও বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজের অভিবাদন নেবেন।

৪ লাখ ৪০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের ওই স্কোয়ারে গত কয়েকদিনে বিশাল আয়োজনের মহড়া দেখে নিশ্চিত হয়েছি, গত বছর অলিম্পিকের চোখজুড়ানো উদ্বোধনী ও সমাপনী পর্বের পর এবার ঘটতে যাচ্ছে গর্বের বিনীত প্রকাশের আরও এক আত্ম-অতিক্রমণ। 'সাংস্কৃতিক বিপ্লবে'র নামে নৈরাজ্য এবং উন্নয়ন-অসারতার এক দশকে (১৯৬৬-৭৬) যখন চৌ এন লাই ও মাও সে তুংয়ের মৃত্যু যোগ হয়ে রাষ্ট্রটি বিপর্যস্ত, তখন ১৯৭৮ সালে প্রায় নির্বাসন অবস্থা থেকে আরেক নেতা দেং শিয়াও পিংকে অভিভাবকত্বে এনে চীনা কমিউনিসট পার্টি এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। রাষ্ট্রিক কর্মকান্ডে দক্ষ দূরদর্শী দেং দিলেন নতুন দিশা। সমাজতন্ত্রকে জমাট বাঁধানোর লক্ষ্যে সংবিধানে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার প্রত্যয় ঠিকই রইল। কিন্তু এগোবার পথ বদলে চীনা বৈশিষ্ট্যে বাজারমুখী অর্থনীতি চালু, চীনের দরজা খোলার পাশাপাশি অবদমিত বেসরকারি প্রাণচাঞ্চল্যকে মুক্তি দেয়া, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সুবিন্যস্তকরণ ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পথ্য সাব্যস্ত হলো। ফলাফল? চীনের জিডিপি ১৯৭৮ সালের ১৪৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০০৮ সালে ৩ হাজার ৩৭০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছল। বিশ্বের মাত্র ৭ ভাগ আবাদযোগ্য জমি দিয়ে নয়াচীন এখন বিশ্বের ২২ ভাগ মানুষের খাদ্য-জোগানদাতা। পন্ডিতদের ভবিষ্যদ্বাণী, আগামীর অর্থনৈতিক পরাশক্তি নিঃসন্দেহে চীন। যদিও দেশটির পরিচালকরা এখন নিজেদের 'উন্নত দুনিয়া'র সদস্য বলতে নারাজ। ২০০৯-এ বিশ্ব আর্থিক মন্দায় সব দেশ বেসামাল, চীনের রফতানিও কমেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজার বড় করে চীন তা পুষিয়ে নিচ্ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রধান অর্থনীতিবিদ সেদিন বললেন, জিডিপির কাঙ্ক্ষিত ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার এ বছর হয়তো ধরে রাখা যাবে। আর্থিক এই সাফল্যের পাশাপাশি চীনা সমাজে এখন বইছে সৃষ্টিশীলতার সুবাতাস। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার উৎকর্ষে তারা এখন মাতোয়ারা। সবচেয়ে বড় কথা, চীন রাষ্ট্রের সামাজিক সুস্থিতি বা কঠিন সামাজিক-সাংস্কৃতিক গ্রন্হন-সূত্র আজ যে কোনো জাতির জন্যে ঈর্ষণীয়। প্রতিটি মানুষ একে অপরের হৃদয়ে গাঁথা। নাগরিক হিসেবে প্রচন্ড দায়িত্ববোধসম্পন্ন। 'তরুণরা শিক্ষা পাবে, রোগীরা চিকিৎসা এবং বৃদ্ধরা পাবেন সেবা'- বহুদিনের এই চীনা স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হতে চলেছে। চীনা ভাষা, যা কিনা ডধু ড়ভ ষরভব-এর মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পারিবারিক মুল্যবোধের আন্তরিক চর্চা প্রবহমান। একটি উদাহরণ দিই। চীনা ভাষায় ঐধড় শব্ধটির মানে 'ভালো'। এটি লিখতে গেলে দুটি অক্ষর মিলিয়ে লিখতে হয়। একটি হচ্ছে নারী, অপরটি ছেলে। অর্থাৎ সত্রী ও ছেলে একসঙ্গে লিখলে ভালো বোঝায়। পারিবারিক মূল্যবোধের কতই না গভীর পরিচয়! আড়াই হাজার বছর আগে শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কনফুসিয়াস কল্যাণমুখী প্রীতিবন্ধনের নৈতিকতাসম্পন্ন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় আচার পালনের যে বাণী রেখে গেছেন, তার প্রভাব রাষ্ট্রটির পরতে পরতে আজও অনুসরণীয়। কিন্তু তারপরও সমস্যা ফুরনোর নয় এবং চীনারা সমস্যার কথা আগের মতো আর আড়ালে-আবডালে বলে না। কয়েকদিন আগে কমিউনিসট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি বার্ষিক অধিবেশন শেষে প্রকাশিত ইশতেহারে বলা হয়েছে, দলের ৭ কোটি ৬০ লাখ সদস্যের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ বাড়িয়ে দলকে আরও গতিশীল করতে হবে। দুর্নীতি কমানো এবং বৈশ্বিক মন্দায় চীনের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে নির্ঝঞ্চাট রাখার অঙ্গীকারের পাশাপাশি চীনের অখন্ডতা রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয়ও তাতে ব্যক্ত হয়েছে। এই অধিবেশনের আগে দলের নেতারা বাইরের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ইংরেজি দৈনিক ঈযরহধ উধরষু ১৯-২০ সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলেছে, ----অন্যদিকে চীনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যে আয়ের বৈষম্য কমানো, বেকারত্ব হ্রাস, অর্থনীতির রফতানি-নির্ভরতা কমানো, জ্বালানির ব্যবহার পরিমিত করে পরিবেশের উন্নয়ন সাধন, সর্বোপরি গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে আগামী তিন দশকে জনসংখ্যার বার্ধক্যের কালে (ধমব ড়ভ ড়ষফ) প্রবেশ করা। স্থানীয় মিডিয়ার অভিমত হচ্ছে, আয়ের বৈষম্যটা প্রকট হচ্ছে। ২০ ভাগ লোকের হাতে দেশের ৮০ ভাগ সম্পদ। দামি বিএমডব্লিউ গাড়ির বিক্রি গোটা বিশ্বে যখন গত বছরের তুলনায় ১৯ ভাগ কমেছে, চীনে উল্টো বিক্রি বেড়েছে ২৬ ভাগ। সরকারকে জরুরি ভিত্তিতেই এদিকে নজর দিতে হবে। এবারের আয়োজন জাতীয় দিবস (কুয়ো কিংজিয়ে- এঁড় মরহম লরব) উদযাপনে এবার সরকারের ঠাঁট-বাট যেমন বেশি, মানুষের উৎসবমুখরতাও অধিকতর। ১৯৪৯-এর পর এবারের আয়োজন সবচাইতে বড়। কোটি কোটি পতাকা তো উড়ছেই, যে যেমন পেরেছে বাড়ি বা ভবনের সামনে ফুলের কোয়ারি বসিয়েছে। উৎসবের আয়োজন করেছে। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে বেইজিং শহরের নানা স্থানে, স্কুল-কলেজে মহড়ার পর মহড়া চলছে। জাতীয় দিবসের উৎসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে শরতের উৎসব। তবে মূল অনুষ্ঠান তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে- যার চীনা উচ্চারণ ও অর্থ হচ্ছে, থিয়েন আন মেন- সৃষ্টিকর্তার নিরাপদ দরজা। রাশি রাশি ফুলের মুগ্ধ সমারোহের মধ্যে চীনের ৫৬ জাতি-উপজাতির প্রতীক হিসেবে ৫৬টি খিলান বসানো হয়েছে। সামরিক কুচকাওয়াজের পাশাপাশি ৫ হাজার বছরের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সামরিক ও অর্থনৈতিক অগ্রসরতা, ৫৬ জাতি-উপজাতির মানুষের বসন-ভূষণ, সামাজিক ক্রিয়া এবং অনুষ্ঠানের জগৎ বাঙ্ময় হবে সঙ্গীতে ও নৃত্যে। প্রায় এক লাখ শিল্পী ও ছাত্রছাত্রী ও অন্যান্য জন এতে অংশ নেবে। কুচকাওয়াজ ও প্রদর্শনীতে এবার সর্বোচ্চ সংখ্যক ৪৩টি সুর বাজবে। এর মধ্যে থাকবে বেইজিং অলিম্পিকের থিম সং 'ইউ অ্যান্ড মি' সুরের মূর্ছনায় মাও সে তুং, জেং শিয়াও পিং, সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন ও হুজিন তাও'র রেকর্ডকৃত বক্তব্যও শোনানো হবে। প্রায় হাজার শিল্পী ও যন্ত্রী তিন ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে বিনা বিরতিতে সুরসৃষ্টিতে মগ্ন থাকবেন। গত তিন মাস ধরে এসবের মহড়া চলেছে। সামরিক কুচকাওয়াজে চীনের সামরিক শৌর্যের প্রতিফলন থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। কুচকাওয়াজের সৈন্যদের জন্য বেইজিংয়ের উপকণ্ঠে একটি গ্রাম বানানো হয়েছে। একটি বিশেষ কমান্ডো বাহিনী এতে প্রথমবারের মতো অংশ নিচ্ছে। বছরের মূল কুচকাওয়াজের আগে অপ্রত্যাশিত চমক দিয়ে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল লিয়াং গুয়াংলি বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর অসত্র ভান্ডারে যত ধরনের অসত্র আছে, গণমুক্তিফৌজের হাতে এখন সে সবের প্রায় সবই আছে। সামরিক কাজে ব্যবহারযোগ্য উপগ্রহ, উন্নত জঙ্গি বিমান, নতুন ধরনের ট্যাংক, কামান, ক্ষেপণাসত্র, সর্বাধুনিক যুদ্ধ জাহাজ ও সাবমেরিন চীন এখন বানিয়ে ফেলেছে। অনেকেরই সম্ভবত জানা, এই তিয়ান আন মেন স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে মাও সে তুং রাষ্ট্র গঠনের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা বিপ্লবের পরিচালক কমিউনিসট পার্টির একক সিদ্ধান্ত ছিল না। ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাও সে তুং সব রাজনৈতিক দলের সম্মেলন (চাইনিজ পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্স- যে কাঠামো আজও সক্রিয়ভাবে বলবৎ) ডেকেছিলেন। সেখানে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়, বেইজিং হবে রাজধানী। এখন থেকে সৃষ্টবর্ষ গ্রহণ করা হবে। ১৯৩৫ সালে কবি তিয়েন হান রচিত 'দি মার্চ অব দি ভলান্টিয়ার্স' হবে জাতীয় সঙ্গীত। জাতীয় পতাকা হবে রক্তলালের জমিনে পাঁচটি হলুদ তারা। লাল হচ্ছে বিপ্লব ও সৌভাগ্যের রং।  বড় তারাটি কমিউনিসট পার্টির; বাকি চারটি ১. শ্রমিক, ২. কৃষক, ৩. সৈন্য ও ৪. অন্যান্যের প্রতীক। তিয়ান আন মেন স্কোয়ারের এক পাশে মেমোরিয়াল হলে মাও'র দেহ সংরক্ষিত। লাখ লাখ লোক লাইন বেঁধে মাও'কে দেখতে যায়। ৩৪ দশমিক ৭ মিটার উঁচু তিয়ান আন মেন টাওয়ারে মাও'র একটি ছবি টানানো- দুই পাশে দুটি স্লোগান। 'গণচীন দীর্ঘজীবী হোক', 'বিশ্ব মানবের মৈত্রী অমর হোক'। পরিবর্তনের গল্প গোটা বিশ্বের বিসিমত মনোযোগ চীনের দিকে। এক সময়ের ঘুমন্ত সিংহ আজ গর্জনমুখর। পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতার এদেশ বহু যুদ্ধ, বিভাজন, রাজতন্ত্র, ঔপনিবেশিক শাসন দেখেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে এক সময়ে নমস্য ছিল। পরে রাজতন্ত্রের রক্তারক্তির কারণে পিছিয়ে যায়। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পেছনে চীন থেকে নেয়া কাঁটা কম্পাস, বারুদ এবং কাগজের প্রযুক্তি বড় ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৪৯ সালের পর থেকে এ জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়, তিন বছরের মধ্যে স্থিতি আসে। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৯ এবং সেখান থেকে ২০০৯- এই ৬০ বছরকে দু'ভাগে ফেললে সপষ্ট হয়, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আত্মঘাতী রক্তক্ষরণের মধ্যেও সফল ভূমি সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে। রাষ্ট্রটি সুসংহত হয়েছে, চীনা জনগণ বৈদেশিক বৈরিতা থেকে নিজেদের রক্ষা করেছে। ১৫ প্রতিবেশী দেশ নিয়ে ৯৬ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের তৃতীয় বৃহত্তম এই রাষ্ট্রে ৫৬ জাতি-উপজাতির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে পূর্ণ চীনা সমাজে ঐক্যের ঐকতান অক্ষুণ্ন রাখা- নজীরবিহীন বটে। এর পরের ৩০ বছর এক স্বপ্নের অভিযাত্রা। দুর্দমনীয় গতিতে এগিয়ে চলা। এর উদ্বোধনের কৃতিত্ব দেংয়ের। এ সময় ২০ কোটি চীনা মানুষ দারিদ্র্যের সীমারেখা ভেঙেছে। ১৯৮৫ সালে 'টাইম' সাময়িকী দেং শিয়াও পিংকে দ্বিতীয়বারের মতো 'বছরের সেরা মানুষ' নির্বাচন করে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল----কিন্তু দেং একা বা কমিউনিসট পার্টিই কি একক কৃতিত্বের দাবিদার? আসলে তখন জনগণও পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছিল। একটা গ্রামের কথা বলি। আনহুয়েই প্রদেশের একটি গ্রাম শিয়াও গাং এর বদনাম ছিল, এটি ভিক্ষুক ও টাকার অভাবে বিয়ে করতে অসমর্থ পুরুষে ভরা। গ্রামের তাবত জমির মালিক কমিউন। কিন্তু মন দিয়ে কৃষকরা ফসল ফলায় না। ১৯৫৬ থেকে গ্রামটি রাষ্ট্রকে কোনো ফসল দিতে পারেনি, উল্টো সরকারের কাছ থেকে ১৯৬৬ থেকে '৭৯ পর্যন্ত ১ লাখ ১৪ হাজার কেজি শস্য ও ১৫ হাজার ইউয়ান খয়রাতি নিয়েছে। ১৯৭৮ সালের এক রাতে গ্রামের ১৪ কৃষক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গোপন চুক্তি করল, কমিউনের জমি নিজেরা ভাগ করে চাষ করবে। ফসলের এক অংশ গোপনে পরিবারগুলোর মধ্যে বণ্টন হবে। প্রত্যেকে একটি লক্ষ্যমাত্রা ধরে কাজ করবে এবং ফসলের একটা অংশ সরকারকে দেবে। এটা ছিল কমিউনবিরোধী কাজ। কিন্তু ওই ১৮ কৃষক দারুণ সাফল্য দেখাল। বদলে গেল গ্রামটির চেহারা। চুক্তিভিত্তিক আবাদের ব্যবস্থা সাফল্য পেল। ছড়িয়ে গেল চীনে। সরকারও মেনে নিল। ১৯৮৪ সালে কমিউন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হলো। চীন এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এভাবে গ্রামীণ সংস্কার একাকার হলো জাতীয় অর্থনীতির পরিবর্তন ধারায়। দেংয়ের পর জিয়াং জেমিন অর্থনীতির ওই সফূরণকে বিকশিত করলেন। হু জিন তাও এর সঙ্গে গুরুত্ব দিয়েছেন ৯ বছর বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, গ্রামাঞ্চলে সমবায়িক চিকিৎসা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর ওপর। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর গুরুত্বারোপের সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হু জিন তাও----এর মাধ্যমে চীনকে নতুন পথে নেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু আসলে কি চীন পারবে সেই অভীষ্টে পৌঁছতে? সম্ভাবনা প্রচুর, সমস্যাও এন্তার। ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে বলতে গেলে, চীনে বেশ কয়েকবার এসেছি। চীন ভ্রমণে সঞ্চয় করে নেয়া যায় পরিতৃপ্ত চিত্তের নিত্য সজীবতা। চীনা জনগণের মানবিকতা এমনই প্রীতিমুগ্ধতা জাগায় যে, অনাত্মীয়দের মধ্যে তারা আত্মীয়তা ঘটিয়ে দেন। অনুচ্চারিত তবে একক জাতিসত্তার অধিকারী (৯২ ভাগ মানুষ হান জাতির, অন্যান্য ৫৫ উপজাতি) আর কোনো রাষ্ট্রের সংবিধানে এমন কথা আছে জানি না, একমাত্র চীনারাই বলতে পারে ---- উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হচ্ছে, চীনাদের অসিমতাবোধ প্রবল। অসিমতাবোধ হচ্ছে আমি আছি, আমি যে আমি। আমি আছি, সেই শারীরিক, স্নায়বিক অনুভুতি প্রখর হলে 'অসিমতাবোধ' ঘটে। কয়েক হাজার বছরের সভ্যতা, যুদ্ধ ও শান্তির মধ্যে যুগপৎ বাস, শাসন-কাঠামোর প্রতি তীব্র আনুগত্যবোধ এবং সভ্যতাগত, জাতিগত স্বাতন্ত্র্য তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সপষ্ট। চীন বা চুংগোয়া হচ্ছে এক ধরনের ধারণা, যার অর্থ হলো, বিশ্বের কেন্দ্রস্থ রাজ্য। এই মানুষ এখন আধুনিকতা বা আন্তর্জাতিকতা বরণ করছে আপন সংস্কৃতিকে জোরালো রেখে। নজর ক্রমেই উঁচু হচ্ছে। কিন্তু সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সদাসতর্ক। তাদের সংস্কৃতির অন্তঃস্থ স্রোত হলো, পদাতিক যুদ্ধের দর্শন-গুরু আড়াই হাজার বছর আগে চীনা জেনারেল সান যু তার 'আর্ট অব ওয়ার' গ্রন্হে যা বলেছিলেন- যুদ্ধের সময় শান্তির এবং শান্তির সময়ে যুদ্ধের পরিকল্পনা কর। এশীয় বিষয়ক ব্রিটিশ গবেষক ও কলামিসট 'মার্টিন জ্যাকস তার হোয়েন চায়না রুলস দি ওয়ার্ল্ড : দি রাইজ অব দি মিডল কিংডম অ্যান্ড দি অ্যান্ড অব দি ওয়েসটার্ন ওয়ার্ল্ড' গ্রন্হে মত রেখেছেন, একুশ শতকে কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এদের মধ্যে চীন এক নম্বরে। কারণ হিসেবে বলছেন, চীন যত না জাতি রাষ্ট্র, তার চাইতে বেশি সভ্যতাভিত্তিক রাষ্ট্র। চীনকে শুধু অর্থনৈতিক সাফল্যে মাপলে মাপুনি অসমাপ্ত থাকবে। এই সভ্যতার মূলে আছে এর অন্তর্গত সামাজিক সম্পর্ক, প্রথা, সংস্কৃতি, ঐক্যের প্রতি অঙ্গীকার, রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ আনুগত্য, মেধাবান রাজনীতিকবর্গ, দক্ষ প্রশাসন প্রভৃতি। দ্বিতীয়ত, পূর্ব এশিয়ার ইয়েলো রেসের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সাংস্কৃতিক মানদন্ডে তার রয়েছে ----। সারা বিশ্বে চীনা কম্যুনিটি অর্থনৈতিকভাবে শক্তির অধিকারী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পশ্চিমারা কোরিয়া, জাপান, ভেঙে সিঙ্গাপুর গড়ে যাই করুক না কেন, ওই সব রাষ্ট্রের লোকায়ত ভিত্তি কিন্তু চীনের সভ্যতাকে ঘিরেই। এ ছাড়া চীন তার আয়তন ও জনসংখ্যার বিচারে এক সময় নিজকে মহাদেশ বলে দাবি করলে অযৌক্তিক মনে হবে না। এর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। কমিউনিসট পার্টি চীনের মানুষকে সুখ, শান্তি, অসিমতাবোধ দিতে পেরেছে এবং সে চেষ্টায় নিয়োজিত আছে। এ সব কারণে শুধু অর্থনৈতিক অঙ্গনে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও পশ্চিমের পতনের পাশাপাশি চীন আবির্ভূত হবে মূলকেন্দ্র হিসেবে। এ পর্যবেক্ষণ মার্টিন জ্যাকসের। উন্নয়নশীলদের সঙ্গে, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সখ্য ও সহযোগিতা দেখার মতো। আগ্রাসনবাদী নয় বলে তাদের সঙ্গে মৈত্রীতে মহা-উৎসাহী পোড় খাওয়া উন্নয়নকামীরা। বাংলাদেশ

No comments

Powered by Blogger.