সম্ভব-অসম্ভবের দোলাচলে by সঞ্জয় সাহা পিয়াল

নেক অনেক দিন আগেকার একটি গল্প। তখনও লোকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেত জলযানে চড়ে। ৮১ বছর আগে, ১৯৩০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় এমনই এক সফরে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। আজকের মতো তখন পাঁচ দিনেই টেস্ট বাঁধা ছিল না। 'টাইমলেস' ওই টেস্টে শেষ ইনিংসে ইংল্যান্ডের সামনে টার্গেট ছিল ৬৯৬ রানের। জয় থেকে মাত্র ৩৫ রান দূরে ছিল ইংলিশরা। হাতেও নগদ পাঁচটি উইকেট ছিল। কিন্তু ১০ দিনের মাথায় ইংল্যান্ড দেখল তাদের জাহাজ ধরার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়েই মাঠের জয়টা ফেলে দৌড়ে ছুটল জাহাজের দিকে।


১৩৫ বছরের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সেটাই ছিল চতুর্থ ইনিংসে পাঁচশ'র ওপর তোলা ম্যাচের ঘটনা। আজ বাংলাদেশও যদি ৭ উইকেটে ৩৪৪ রান করতে পারে তাহলে কল্পকাহিনীর মতো আরেকটি ইতিহাস লেখা হবে মিরপুরে। পারবে কি বাংলাদেশ? যেখানে চতুর্থ ইনিংসে ৪১৮ রান তুলে একবারই শুধু জয়ের ঘটনা আছে, সেখানে বাংলাদেশ কি পারবে রেকর্ড ভেঙে ফেলতে? এটা কি সম্ভব? ১৯৩০ সালের গল্পটি প্রথমবারের মতো শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ইমরুল কায়েস। 'সম্ভব। তবে যদি কাল (আজ) দুটি সেশন তামিম উইকেটে থাকতে পারে।' সম্ভবের সঙ্গে 'যদি'টা বলে নিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোচ ওটিস গিবসনও। 'বাংলাদেশ যদি পাঁচশ' তাড়া করে জিততে পারে তাহলে রেকর্ড ভাঙতে হবে। উইকেটের যে অবস্থা তাতে ব্যাটসম্যানরাই সুবিধা পাবে কাল। তবে কোনো সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।' গতকাল ঢাকা টেস্টের চতুর্থ দিন শেষে তামিমের ৮২ রানে অপরাজিত থাকার পর দুই শিবির সম্ভব-অসম্ভবের দোলাচলে।
অথচ সকালের সেশনে যখন ব্রাভো তার ইনিংসটি একশ' থেকে দেড়শ' পেরিয়ে ২শ'র কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন মিরপুরের স্কুল গ্যালারিও ধরে নিয়েছিল অতল সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের সম্ভাবনা। কোনো তাড়াহুড়া না করে ঠাণ্ডা মাথায় এদিন ক্যারিবীয়রা তাদের রানের শৃঙ্গ গড়ে তোলেন। সকালে প্রথম এক ঘণ্টায় মাত্র দুটি বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলেন তারা। কেমার রোচকে শুভর হাতে তুলে দেওয়ার পর চন্দরপল দায়িত্ব নিয়েছিলেন ব্রাভোকে ডাবল সেঞ্চুরির পথ দেখিয়ে দেওয়ার। প্রথম সেশনে তারা মাত্র ১০২ রান যোগ করেন স্কোর কার্ডে। এর মধ্যেই অবশ্য চন্দরপলকে স্লিপে ফেলে দেন ইমরুল। মাত্র এক উইকেট খুইয়ে লাঞ্চের সময়ই ৪৩৩ রানের লিড নিয়ে রাখেন তারা। অনেকেই ভেবেছিলেন, লাঞ্চের
সময়ই স্যামি তাদের ইনিংস ডিক্লেয়ার করবেন। কিন্তু ব্রাভোর ডাবল সেঞ্চুরির মাইলফলকের জন্য লাঞ্চের পরে রীতিমতো টি২০ খেলতে থাকেন ক্যারিবীয়রা। মাত্র দশ ওভারের মধ্যে ৭৬ রান তুলে নেন তারা। এর মধ্যে ব্রাভো শুভর বলে মুশফিকের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হওয়ার পর ৫ উইকেটে ৩৮৩ রানেই ইনিংস ডিক্লেয়ার করেন স্যামি। আগের ইনিংসে ১২৪ রানে এগিয়ে থাকায় বাংলাদেশের সামনে টার্গেট দাঁড়ায় ৫০৮ রানের অসম্ভব এক লক্ষ্যের।
দিনের তখনও ৪৭ ওভার বাকি ছিল। শুরুতেই মনে হয়েছিল, তামিম আর ইমরুল তাদের প্রথম ইনিংসের ভুল শুধরে দেখেশুনে বল ছেড়ে দেবেন। কিন্তু কোথায় কী, দিনের প্রথম ওভারেই ফিদেল অ্যাডওয়ার্ডকে মিড অফ দিয়ে বাউন্ডারি ছাড়া করেন ইমরুল। পরের ওভারে পাল্লা দিয়ে কেমার রোচকে দু'বার বাউন্ডারি মারেন তামিম। মাত্র ২ ওভারেই ১৮ রান! ভুলটা করেন তামিম এর পরই। ফিদেলের শর্ট বলে গালিতে ক্যাচ তুলে দেন; কিন্তু এদিন তামিমের ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় ১২ রানে জীবন পেয়ে যান স্যামুয়েলসের হাত থেকে; কিন্তু ভাগ্য তো সবার জন্য দরজা খুলে রেখে বসে থাকতে পারে না। ওই ওভারেই ফিদেল ইমরুলকে প্রথম স্লিপে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন। ২৬ রানে প্রথম উইকেট পড়ে যাওয়ায় তামিম কিছুটা শান্ত হন; কিন্তু কেমার রোচকে আবার একই ওভারে তিনটি বাউন্ডারি মেরে ক্যারিবীয় ফিল্ডারদের এলোমেলো করে দেন। পাঁচশ' রানের বোঝা নিয়ে চলা বাংলাদেশের ইনিংস তখন ১০ ওভারেই ৬২ রান। যার মধ্যে ৪২ রানই এসেছে দড়ির ওপারে বল পাঠিয়ে। এমন বিধ্বংসী ইনিংসে গতিরোধক এনেছিলেন শাহরিয়ার নাফীস। ৪১ মিনিট ক্রিজে কাটিয়ে ২৫ বল খেলে ১৮ রানের মাথায় তিনি চরম একটি ভুল করেন। চা বিরতিতে যাওয়ার আগের বলটিতেই তিনি স্যামির হাতে রিটার্ন ক্যাচ দিয়ে বসেন। এরপর রাকিবুল এসে তামিমকে ঠাণ্ডা হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তামিম যখন বিশুর এক ওভারে পরপর বাউন্ডারি আর ওভার বাউন্ডারি হাঁকিয়ে সবাইকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন, তখন আম্পায়ারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাকিবুল তামিমকে বোঝাতে গিয়েছিলেন; কিন্তু অন্যকে শিক্ষা দিয়ে নিজেই ভুল করে বসেন দিন শেষের কিছুক্ষণ আগে। স্যামুয়েলসের একটি ঘূর্ণিতে আগের বলেই পরাস্ত হয়েছিলেন, আর পরের বলটিতে আউট হয়ে যান রাকিবুল। ৭২ মিনিট ক্রিজে থাকা রাকিবুলের ৫২ বলে ১৭ রানের সংগ্রামী ইনিংসের ইতি ঘটে ওখানেই।
চোখের সামনে রাকিবুলকে ওভাবে আউট হতে দেখে তামিমও আর কোনো রিস্ক নেননি। যিনি কি-না ৫৮ বলে ৫০ রান করেছিলেন, ৭৯ বলে তুলেছিলেন ৬৬, তিনিই পরে শান্ত হয়ে গিয়ে দিনের বাকি সময় আর কোনো বাউন্ডারি হাঁকাননি। পরের ৭০ বলে মাত্র ১৬ রান তোলেন। দিন শেষে তামিমের ওই ধৈর্যটুকুই বাংলাদেশকে আজ ইতিহাসের মুখোমুখি করতে যাচ্ছে। যেখানে মুশফিক ৩৩ বলে অপরাজিত রয়েছেন। যেখানে পুরো দিনের ৯০ ওভার পড়ে আছে বাংলাদেশের সাত ব্যাটসম্যানের জন্য। বাংলাদেশ কি পারবে তিন সেশনের এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে? 'প্লিজ, আজ আমি কিছু বলতে পারব না। আগে বললে কিছুই হয় না।' বিনয়ের সঙ্গে আজকের দিনটি অপেক্ষা করতে বললেন তামিম। মুশফিকও পাশ থেকে অনুরোধ করলেন, 'অপেক্ষা করুন না, কাল সকালেই বোঝা যাবে কী হতে যাচ্ছে।'
এই মিরপুরেই এর আগে শ্রীলংকার বিপক্ষে চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশের ৪২৩ রান রয়েছে। এ মাঠেই ভারতের সঙ্গেও ৪০০ রান তোলার সুখস্মৃতি রয়েছে। ক্রিকেট বিশ্বে পাঁচশ' রানের গল্পটা অসম্ভব হলেও বাংলাদেশ শিবিরে কিন্তু সম্ভাবনার চোরা হাওয়া বইছে।

No comments

Powered by Blogger.