নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ড-হত্যা মামলা ডিবিতে, এসপি প্রত্যাহার

রসিংদীর মেয়র হত্যাকাণ্ডে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ভাই ও এপিএসসহ ১৪ জনকে আসামি করে দায়ের করা মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রত্যাহার করা হয়েছে পুলিশ সুপার ড. আক্কাস উদ্দিন ভুঁইয়া ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এনামুল কবিরকে। তবে মামলা দায়েরের পর একদিন পেরিয়ে গেলেও আসামিরা কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। নিহত হওয়া নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের পরিবারের সন্দেহ, আসামিরা ক্ষমতাসীন দলের হওয়ায় পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে যথেষ্ট তৎপর হচ্ছে না।


পুলিশের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাস উদ্দিন ভুঁইয়া ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) এনামুল কবিরকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাঁদের ওএসডি করে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে।
লোকমান হোসেনের ভাই মো. কামরুজ্জামান গত বৃহস্পতিবার রাতে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু এবং এপিএস মাসুদুর রহমান মুরাদসহ ১৪ জনকে আসামি করে সদর মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। জানা যায়, মামলাটি গতকাল সকালে গোয়েন্দা পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। মেয়র হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবির) ওসি মামুনুর রশিদ বলেন, 'মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর পরই আমরা বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু মামলার আগেই আসামিরা জেনে যাওয়ায় সবাই গাঢাকা দিয়েছে। আসামিদের খুঁজে না পাওয়ায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।'
নরসিংদী সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কাসিফ সানোয়ার বলেন, 'ঘটনার সময় সন্ত্রাসীরা তাদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি ফেলে যায়। পুলিশ মোটরসাইকেলটি জব্দ করেছে এবং এটির মালিক কে তা বের করার জন্য বিআরটিসির সঙ্গে যোগাযোগ করছে। কিন্তু ঈদের ছুটি এসে পড়ায় পরিচয় বের করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই তদন্ত কাজে দ্রুত এগোনো যাচ্ছে না।'
এদিকে গতকাল শুক্রবার দুপুরে গাজীপুরের কালীগঞ্জ এলাকার সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি মেয়রের পরিবারকে সান্ত্বনা দেন, পরিবারের খোঁজখবর নেন। ওই সময় লোকমান হোসেনের স্ত্রী নুসরাত জাহান বুবলি বলেন, 'আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই, যারা আমার দুই সন্তানকে এতিম করল তাদের ফাঁসি চাই।' লোকমান হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গতকাল স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ সভা করেছে।
লোকমান হত্যা মামলার বাদী ও লোকমানের ভাই কামরুজ্জামান ক্ষোভ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শ্রেষ্ঠ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়ে দুইবার স্বর্ণপদক পেয়েছেন আমার ভাই। আর সেই ভাইকে যারা গুলি করে মারল পুলিশ বলছে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আমরা জানি, তারা এলাকায়ই আছে।' তিনি বলেন, খুনিদের গ্রেপ্তার ও ন্যায় বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছেন।
এ বিষয়ে নরসিংদী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় কুমার বসাক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আসামিদের ধরতে পুলিশের কয়েকটি বিভাগ কাজ করছে। পুলিশের আটটি দল তিনটি জেলায় অভিযান চালাচ্ছে। আসামিদের ধরতে পুলিশের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই।' ক্ষমতাসীন দলের লোক হওয়ায় আসামিদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে কি না_এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'ওপর মহল থেকে এ ধরনের কোনো চাপ নেই।'
গতকাল বিকেলে লোকমান হত্যার বিচারের দাবিতে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেয়র লোকমান হত্যার প্রতিবাদে তিন দিনের শোক কর্মসূচির অংশ হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামানের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য মাহবুবুর রহমান আলম, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এ হাদী, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া, প্রচার সম্পাদক সামসুল আলম রাখিল, জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান খোকন, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জোবায়ের আহমেদ, শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ফটিক মাস্টার, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ আলম ভূঁইয়া প্রমুখ।
প্রতিবাদ সভায় বক্তারা আধুনিক নরসিংদী গঠনে মেয়র লোকমান হোসেনের অবদানের কথা স্মরণ করেন এবং যারা তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। সভা উপলক্ষে অনুষ্ঠানের চারপাশে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
মেয়র লোকমানের ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ আবারও বলেছেন, তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই মামলা করা হয়েছে। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মন্ত্রীর সঙ্গে কখনো আমার ভাইয়ের প্রকাশ্য বাদানুবাদ হয়নি। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে আমার ভাই রাজিউদ্দিন রাজুর সঙ্গে গিয়ে রায়পুরায় নির্বাচনী প্রচার কাজে অংশ নেন। কিন্তু মেয়র হওয়ার পর তিনি এত জনহিতকর কাজে জড়িয়ে পড়েন যে মন্ত্রীর কাছে যাওয়ার বা কাছে গিয়ে বসে থাকার সময় পাননি। এ সুযোগে সাবেক পৌর চেয়ারম্যান মতিন সরকারসহ দলের ষড়যন্ত্রকারীরা মন্ত্রীর কান ভারী করতে থাকেন আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে।'
তা ছাড়া মন্ত্রীর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু আসন্ন জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে জেলা সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ পদের প্রার্থী ছিলেন পৌর মেয়র লোকমান হোসেনও। এতে ক্ষুব্ধ হন বাচ্চু। তিনি রায়পুরায় এক দলীয় বৈঠকে প্রকাশ্যে লোকমান হোসেনকে দেখে নেওয়ারও ঘোষণা দেন বলে জানান শামীম। তিনি বলেন, 'এ নিয়ে নানা সময় আমাদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করতেন আমার বড় ভাই। এ ঘটনায় নরসিংদী মডেল থানায় ভাই একটি জিডিও করেছিলেন।'
সাবেক পৌর চেয়ারম্যান মতিন সরকার সম্পর্কে শামীম অভিযোগ করে বলেন, 'মতিন সরকার একজন গডফাদার। এলাকায় মাদক ব্যবসা, কিলিং পলিটিঙ্সহ নানা অপরাধে তিনি জড়িত। তিনি একজন ঠাণ্ডা মাথার খুনি। তাঁর এসব অপকর্মের বিরোধিতা করেছেন লোকমান হোসেন। সবশেষে তিনি মতিন সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা তাঁর বেপারিপাড়ার মাদক স্পট উচ্ছেদের উদ্যোগ নেন। ফলে দলের ভেতরে ও বাইরে লোকমান ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ তৈরি হতে থাকে। কিন্তু জনগণ তাঁর সঙ্গে আছে_এ কথা বলে ভাই এগুলোকে পাত্তা দিতেন না।'
হত্যা মামলার এজাহারে বলা হয়, শত্রুতার জের ধরে মন্ত্রীর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল মতিন সরকার, মোবারক হোসেন মোবা, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোন্তাজ উদ্দিন ভূঁইয়া, নরসিংদী সদর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম, মনোয়ার হোসেন খান ওরফে মঈন, হিরন মিয়া, নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও বিএনপি নেতা তারেক আহমেদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব মাসুদুর রহমান মুরাদ ও কবির সরকার মেয়র লোকমান হোসেনকে খুন করার নির্দেশ দেন। তাঁদের নির্দেশ পেয়ে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফুল সরকার, মিঞা মো. মঞ্জুর, আমির হোসেন ওরফে আমু ও মামুনসহ অজ্ঞাতপরিচয় সাত থেকে আটজন।
আসামিদের মধ্যে একজন হলেন বিএনপি নেতা নূরুল ইসলাম। তাঁকে আসামি করা প্রসঙ্গে শামীম নেওয়াজ বলেন, নূরুল ইসলাম শহরে অস্ত্রের রাজনীতি করেন। তরুণদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন। তাই তিনি এ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন।
ভাঙচুর ও ট্রেনে আগুনের ঘটনায় দুটি মামলা

No comments

Powered by Blogger.