সার্কের সেতুবন্ধ রচনার আসর এবার মালদ্বীপে-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নাটকীয় মোড় by মেহেদী হাসান

ক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনে সহযোগিতার অংশ হিসেবে মালদ্বীপকে সাতটি ট্রাক উপহার দিয়েছে বাংলাদেশ। সার্কের অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্র ও পর্যবেক্ষকরাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে দেশটির প্রতি। এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হলো_সেতুবন্ধ রচনা। হাজারেরও অধিক প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র মালদ্বীপ প্রতিবেশীদের সহযোগিতা নিয়ে প্রত্যন্ত দ্বীপ আদ্দুতে সম্মেলন আয়োজন করে সত্যিই যেন এক সেতুবন্ধ রচনা করতে চলেছে।


সম্মেলনে অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (ভিভিআইপি) নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মালদ্বীপ ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের (এমএনডিএফ) এলিট টিম শুরু করেছে অপারেশন ডলফিন স্টার।
এদিকে সম্মেলনের প্রাক্কালে পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা ভারতকে মোস্ট ফেভারড ন্যাশন (এমএফএন) অর্থাৎ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে গণ্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিষয়টিকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। আড়াই দশকেও সার্কের প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় তাঁরা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈরিতাকে দায়ী করে বলেন, এ দুই দেশের সম্পর্কের ইতিবাচক মোড় সার্ককে এগিয়ে নিতে জোরালো ভূমিকা পালন করবে। গত বুধবার পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা অনেকটা নাটকীয়ভাবেই ভারতকে বহুল প্রতীক্ষিত এমএফএন স্ট্যাটাস দিয়েছে। ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি শান্তি প্রক্রিয়া বিশেষ গুরুত্ব পাবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশা করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক জানান, ইতিবাচক আবহ সৃষ্টি হবে এবং এতে সার্কের অগ্রযাত্রা সহজ হবে।
জানা গেছে, আগামী বৃহস্পতি ও শুক্রবার ১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন সফলভাবে আয়োজনের জন্য মালদ্বীপ প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে কয়েক মাস আগে থেকেই। ভৌগোলিক অবস্থান ও অবকাঠামোগত স্বল্পতা ছিল দেশটির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। এর পরও দেশটি সফলভাবে সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি শেষ করেছে। সার্কের সদস্য ও পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রগুলো এ ক্ষেত্রে মালদ্বীপের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। গত ১৭ আগস্ট বাংলাদেশ সাতটি তিন টনের ট্রাক উপহার দেয় মালদ্বীপকে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সেনাবাহিনীর কারখানায় সংযোজিত ওই ট্রাকগুলো শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে মালদ্বীপকে দেওয়া হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা করেন, উপহার হিসেবে দেওয়া যান একদিকে যেমন সার্ক সম্মেলন সফলভাবে আয়োজনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে, অন্যদিকে তা বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরো জোরদার করবে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, সার্ক সম্মেলন আয়োজনের সহযোগিতা হিসেবে ভারত সরকার মালদ্বীপকে প্রায় ৩৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা (৫০ লাখ ডলার) দিয়েছে। অন্যদিকে যানবাহন দেওয়ার পাশাপাশি আদ্দুত নগরীতে ছয় কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে সহযোগিতা করেছে শ্রীলঙ্কা। পাকিস্তান সরকার সার্ক সম্মেলন আয়োজনে মালদ্বীপকে প্রায় তিন কোটি ১০ লাখ ৭০ হাজার টাকা (চার লাখ ছয় হাজার ৮৯০ ডলার) দিয়েছে। সার্কের অন্যতম পর্যবেক্ষক চীন প্রায় ১৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা (এক কোটি ২০ লাখ ইউয়ান) মূল্যমানের গাড়ি, অফিস ও রান্নাঘরের সামগ্রী ও সিসিটিভি দিয়েছে মালদ্বীপকে।
কূটনৈতিক সূত্র মতে, 'সেতুবন্ধ রচনা'কে ১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ঘোষণার মাধ্যমে সার্কভুক্ত দেশগুলোর ভৌগোলিক ও মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই যোগাযোগের ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের প্রতিনিধি শাওনা আমিনাথ জানিয়েছেন, সার্কের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে মালদ্বীপ অন্যান্য রাষ্ট্র ও পুরো অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ ৩০ বছর পর শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মধ্যে আবারও ফেরি যোগাযোগ চালুর দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, সার্কের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক স্বার্থ ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের মূল লক্ষ্য।
এদিকে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশ যোগাযোগ (কানেকটিভিটি) বৃদ্ধির ওপর জোর দেবে। এ ছাড়া আগের সম্মেলনগুলোতে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ওপরও গুরুত্বারোপ করবে বাংলাদেশ। তিনি আরো বলেন, এবারের সম্মেলনে তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। এগুলো হলো_প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সার্কের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে দ্রুত সাড়া প্রদান, উৎপাদিত পণ্যের মান সমতা নিশ্চিতকরণ ও পর্যালোচনা এবং সার্ক বীজ ভাণ্ডার গঠন-সংক্রান্ত। এগুলোর মধ্যে সার্ক বীজ ভাণ্ডার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ।
সূত্র মতে, এবারের সম্মেলনে প্রায় ৪০ দফা ঘোষণা থাকতে পারে। বিশেষ করে ১৬তম শীর্ষ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জের যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তার ওপর একটি সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকার কথা রয়েছে। স্বাগতিক দেশ মালদ্বীপ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকায় এই ইস্যুটি এবার বিশেষ গুরুত্ব পাবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।

No comments

Powered by Blogger.