স্কিন-কেয়ার কন্সপিরেসি by মাহমুদ শামসুল হক

ঢাকার কারওয়ান বাজারের ফুটপাত। চোঙ্গা ফুঁকে এক মধ্যবয়সী লোক ক্রিম বিক্রি করছেন। রং ফর্সা করার ক্রিম। তাৎক্ষণিকভাবে ক্রিমের কেরামতি প্রমাণের জন্য অনেকের মুখে মেখে দিচ্ছেন আরেকজন। প্রতি ফাইল কুড়ি টাকা। ঝটপট বিক্রি হয়ে গেল খয়েরি রংয়ের কৌটাগুলো। বোঝা গেল, ফর্সা হওয়ার আকুতি এখন তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়েছে। বাজারি অর্থনীতির প্ররোচনা পৌঁছে গেছে এমনকি নিম্নবিত্তের দোরগোড়ায়।

এর সপ্তাহ দুই পরে কাগজে খবর এলো, ভারতের রাজনীতিকরা রং উজ্জ্বল করার জন্য বিউটি পার্লারে যাচ্ছেন। রূপতাত্ত্বিক ডাক্তাররা তাদের 'বটোক্স' নামের রং ফর্সাকারী ক্রিম মাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা তা মেখে নাকি চামড়ার কালার বদলাতে সক্ষমও হচ্ছেন। এ দুটো ঘটনা দেখে খুব সহজেই আন্দাজ করা যায়, পুঁজিবাদী বাণিজ্যের বিস্তার ঘটেছে নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মতোই রং ফর্সাকারী সামগ্রী এখন অপরিহার্য। এই অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে মারাত্মক ক্ষতিকর রাবিশ পণ্য এখন পাওয়া যায় বড় বড় শপিংমলে। সেখানে ভিড় বাড়ছে, বিশেষত মধ্যবিত্ত মেয়েদের। বস্তুত দুনিয়া জুড়ে ফর্সা হওয়ার বাতিক এখন প্রায় দুরারোগ্য ব্যাধির পর্যায়ে এসে গেছে। উস্কানি আসছে বিচিত্র প্রলোভন নিয়ে পুঁজিবাদী মুনাফাখোদের কাছ থেকে। তাদের ব্যবসা ফেঁপে উঠছে ক্রমশ। এদিকে কৃত্রিম অভাবের শিকার হয়ে ফতুর হচ্ছে গরিব দেশের মানুষ। সৌন্দর্য বাণিজ্য এখন বিশ্বের অন্যতম বড় খাত। জীবন রক্ষাকারী অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ-বিষুধের চেয়েও বড় খাত। এক পরিসংখ্যান মতে, আমেরিকায় শিক্ষা অথবা সমাজসেবা খাতের চেয়ে বেশি ব্যয় হয় সৌন্দর্য চর্চায়। সেখানে প্রতি মিনিটে বিক্রি হয় কয়েক টন মেকআপ পণ্য, দেড় হাজারেরও বেশি লিপষ্টিক, দুই হাজার জারের বেশি ত্বক ফর্সাকারী সামগ্রী। পৃথিবীতে এখন যত রকম রং ফর্সাকারী ক্রিম তৈরি হচ্ছে এবং সেগুলো বেচে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান কী করে বহুজাতিক কোম্পানিতে পরিণত হচ্ছে তা রীতিমত গবেষণার বিষয়। সমাজবিদরা সংশয় প্রকাশ করছেন, অর্থনীতিবিদরা হতবাক। ইংল্যান্ডের জনৈক রূপ বিশারদের হিসাব অনুসারে, চামড়া সাদা করার জন্য তৈরি সামগ্রীর উৎপাদন ফি বছর বেড়ে যাচ্ছে শতকরা সাত ভাগ হারে। যার পরিমাণ একটি উন্নয়নশীল দেশের মাথাপিছু আয়ের দ্বিগুণেরও বেশি। বর্তমানে সৌন্দর্য কারখানা এবং সৌন্দর্যকেন্দ্র নির্মাণ বাবদ বছরে সারা বিশ্বে খরচ হচ্ছে প্রায় দু'শ' বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এসব কারখানায় সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে রং ফর্সাকারী ক্রিমের খাতে। বলা প্রাসঙ্গিক, এর প্রধান আখড়া অবস্থিত আমেরিকায়। না, উদ্দেশ্য একেবারেই ভালো নয়। দৈহিক সৌন্দর্য চর্চার নামে পুঁজিবাদী মুনাফাখোররা সৌন্দর্যের একটা মান দাঁড় করিয়ে কৃত্রিম অভাববোধ তৈরি করেছে। মানুষকে ক্রমাগত ফুঁসলিয়ে শরীরের রংয়ের একটি মূল্যমান তৈরি করেছে। এখনও বলা হচ্ছে, কালো রংয়ের মানুষ তুলনামূলকভাবে পেছনের কাতারের, যে কোনো কিউ'র পেছনে পড়ে থাকে তারা, সামাজিকভাবে এবং বৈবাহিক ক্ষেত্রে কালো মেয়ের কদর কম। এসব ভুয়া তত্ত্ব-তথ্য দিয়ে কালো চামড়াকে সাদা করার একটি ফালতু-ইতর চাহিদা সৃষ্টি করা হয়েছে। অতঃপর নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় পণ্য চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে সারা দুনিয়ায়। পাশ্চাত্যের এই ফর্সা- বন্দনা প্রাচ্যেও প্রবল। ভারতে গত নব্বই দশকে বছরে রং ফর্সাকারী ও বলিরেখা লোপকারী ক্রিমের বিক্রি বেড়েছে শতকরা চল্লিশভাগ হারে। বাংলাদেশে এসবে কোনো হিসাব নেই। জানেন সবাই, আগে ফর্সা হওয়ার একটি সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক তাগিদ মেয়েদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা ছেলেদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে এবং সংখ্যাও বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। পুঁজিবাদী উৎপাদকরা এ সুযোগ ছাড়ার পাত্র নয়। তারা অনেক কিছুর পাশাপাশি তৈরি করছে হরেক রাবিশ। সেগুলো হামেশা পাঠাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের বাজার তথা শপিং মলগুলোতে। ফর্সা রং কোনো গুণবাচক বিষয় নয়। গায়ের রংয়ের কোনো নিজস্ব মহিমা নেই। এসব জেনেশুনেও মানুষ ফর্সা রংয়ের প্রতি পক্ষপাত দেখায়। এর পেছনে রয়েছে সমাজতাত্ত্বিক কারণ। ফর্সা হওয়ার বাজে চর্চার শুরু হয়েছিল প্রাচীনকালেই। স্রেফ গায়ের রং কালো বলে নিগ্রয়েড রক্তধারার কৃষ্ণকায় মানুষকে 'দাস' বানিয়ে ছেড়েছে শ্বেতাঙ্গরা। আফ্রিকায় কালো মানুষদের শুধু কালো বলেই অমানুষের পর্যায়ে থাকতে হয়েছে শত শত বছর। স্বেতাঙ্গরা শুধু গায়ের বর্ণকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছে এক জঘন্য-ঘৃণিত তত্ত্ব-'বর্ণবাদ'। বর্ণবাদের সেই চাপ আজও সহ্য করতে হচ্ছে কৃষ্ণকায়দের। ফর্সা রংয়ের প্রতি অহেতুক পক্ষপাতের রয়েছে আরো অনেক কারণ। ঐতিহাসিকভাবেই শাসকশ্রেণী তাদের দেহ গড়নের শ্রেষ্ঠত্ব এবং সৌন্দর্যের ধারণা অন্যদের ওপর আরোপ করেছে। ভারত উপমহাদেশে যেসব শাসকগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে-যেমন আর্য, মোগল, পাঠান, তুর্কি-তাদের গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল ও ফর্সা। এভাবেই 'ফর্সা' সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে অন্যান্য বর্ণের চেয়ে কুলীনের মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে। অন্যদিকে কালোর প্রতি অনীহা হয়েছে বদ্ধমূল। না, সৌন্দর্য তথা সৌন্দর্য চর্চার বিপক্ষে তেমন কিছু বলার নেই। কারণ সৌন্দর্য চর্চা মানুষের সহজাত তথা আদিম প্রবৃত্তি। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় তখন, যখন সৌন্দর্যের মাপকাঠি ও তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয় পুঁজিবাদী বাণিজ্য এবং বাজারি অর্থনীতির ধারক-বাহকরা। এই অর্থনীতি সৌন্দর্য সংস্কৃতির নামে অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রবিশেষে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রূপ সামগ্রীর বাজার বিস্তৃত করে বিনা যুক্তিতে, বিনা বাধায়। তাদের এই অপপ্রয়াসকেই আধুনিক প্রগতিশীল অর্থনীতিবিদরা চিহ্নিত করেছেন সৌন্দর্যের শাসন ও 'শোষণ' নামে। এগুলোর ক্রেতাদের একথা বলা এখন খুবই সঙ্গত যে, সাবলীল ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা-দীক্ষা, কর্মক্ষমতা এবং সবার উপরে সুস্বাস্থ্যই সৌন্দর্য। রং বদলানোর প্রয়াস কেবলই কুহক, নিজের প্রতি বৈরিতা। বিশ্বের বিপুল জনগোষ্ঠীকে অভুক্ত রেখে, অপুষ্টির শিকারে পরিণত করে সৌন্দর্যপণ্যের ব্যাপারীদের কোষাগার ফাঁপিয়ে তোলা মানে নিজেকে প্রতারণা করা। মনে রাখা দরকার যে, রং বদলের প্ররোচনা আসলেই একটি পুঁজিবাদী চক্রান্ত।

No comments

Powered by Blogger.