ক্রসফায়ার এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদা

'সে' এবং 'তিনি' দুটিই সর্বনাম। ব্যক্তির মর্যাদা ভেদে নামের পরিবর্তে সর্বনাম দুটির যে কোনো একটি ব্যবহৃত হয়। খুলনার ডুমুরিয়ায় কিন্তু মাত্র ১৯ ঘণ্টার ব্যবধানে একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে 'সে' 'তিনি'তে রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার ভোর ৪টায় পুলিশের ক্রসফায়ারে ভদ্রা নদীর পাড়ে নিহত হন নিরাপদ বৈরাগী (৫৮)।
জেলা পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, 'সে' নিউ বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টির প্রধান শৈলেনের সেকেন্ড ইন কমান্ড এবং তিনটি হত্যা মামলা, তিনটি অপহরণ মামলা, একটি অসত্র মামলাসহ আটটি মামলার আসামি। ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয় যে, নিউ বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্যরা রানাই গ্রামের পালপাড়া ভদ্রা নদীর পাড়ে বৈঠক করছিল। এ সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে চরমপন্হী দলের ক্যাডাররা গুলি চালাতে শুরু করলে পুলিশও পাল্টা গুলি করে। একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিরাপদ নিহত 'হয়'। পক্ষান্তরে নিরাপদ বৈরাগীর সত্রী কল্পনা রানী জানিয়েছেন, তার স্বামী একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারের কাছ থেকে মাসিক ৫শ' টাকা হারে ভাতা পেতেন। তিনি পেশায় দর্জি এবং দাকোপের ষ্টাইল টেইলার্সে কাজ করতেন। মঙ্গলবার রাতে পুলিশ তাকে সেখান থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং শুক্রবার ভোররাতে গুলি করে মেরে ফেলে। গোপন বৈঠক, ক্রস ফায়ার ইত্যাদি পুলিশের সাজানো গল্প। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল; কারণ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে পুলিশর্-যাব-এর ভাষ্য এবং ভিকটিমের আত্মীয়-স্বজনের বক্তব্যের মধ্যে বিস্তর গরমিল থাকে। এ ব্যাপারে এ দেশের মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিকটিমের ধরাপড়া এবং নিহত হওয়ার ব্যাপারে সাধারণ মানুষ পুলিশর্-যাবের নয় বরং আত্মীয়-স্বজনের বক্তব্যই সত্য বলে মেনে নেয়। বিষয়গুলোর এভাবেই ইতি ঘটে। আলোচ্য ক্ষেত্রে কিন্তু ঘটনা আরো ঘটেছে। ওইদিন ভোর ৪টায় যাকে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হয় রাত ১১টায় আবার সেই ব্যক্তিরই লাশ দাহ করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত নিরাপদ বৈরাগীর মরদেহ শ্মশানে আনার সময় সহযাত্রী হয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং পুলিশ বাহিনীর স্থানীয় সদস্যরা। পুলিশ স্যালুট করার পর চিতায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে খুলনার পুলিশ সুপার বলেছেন, 'তিনি' যে মুক্তিযোদ্ধা তা আমাদের জানা ছিল না। নিরাপদ বৈরাগী যে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তা জানা থাকলে পুলিশ কী করত তা এখন আর জানা সম্ভব নয়। তবে পুলিশ সুপারের বক্তব্যে পরোক্ষভাবে হলেও বেরিয়ে এসেছে যে, পরিচয় ভেদে 'ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের' পরিণতি ভিন্ন হয়। এটাকে আমরা আইনের শাসনের বাংলাদেশী ষ্টাইল বলতে পারি। তবে কথার মারপ্যাঁচের 'শাক' দিয়ে মানবাধিকার লংঘনের 'মাছ' ঢেকে রাখা যায় না বলেই বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আজ দেশে-বিদেশে আলোচনা ও দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের উজ্জ্বলতম জাতীয় গৌরব গাথা। প্রশ্নাতীতভাবে মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। যাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রতি মাসে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা দেয়া হয় তাকেই যখন বিনা বিচারে গুলি করে মেরে ফেলা হয়-সে ঘটনা কোনো অজুহাতেই মেনে নেয়া যায় না। নিহত ব্যক্তির মৃতদেহ জাতীয় পাতাকা দিয়ে মুড়িয়ে দিলেও নয়। এর আগেও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বিপথগামী ঘাতক, বিচারের প্রহসন, মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত ঝরিয়েছে স্বাধীন বাংলার মাটিতে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে আজ ভালো নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ সুপথে নেই বলেও শোনা যায়। আমরা যদি জাতি হিসেবে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করে হলেও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে যথাসময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদা দিতাম তবে আজ আমাদের সমবেত অবস্থানও অধিকতর গৌরবময় হতো। 'সে' কে 'তিনি' বানিয়ে এ ভুল সংশোধন করা যাবে না। এতে বরং অমর্যাদার কালিমা গাঢ়তর হবে।

No comments

Powered by Blogger.