শনিবারের সুসংবাদ-আলোর পরশ দিল বিহঙ্গ by মানিক সরকার মানিক,

রা নিজেরাও কেউ বাঙালি নয়, সমাজের আর ১০ জনের সঙ্গে সামাজিকভাবে মিলেমিশে চলার বা ওঠাবসার অধিকারও নেই ওদের। নিজেরা অশুচি হলেও সেই আদিকাল থেকে ওরাই এ সমাজের শুচিতার কাজ করে আসছে। সমাজের তথাকথিত 'অস্পৃশ্য' দলিত হরিজন সম্প্রদায়ের শিশু-কিশোর ওরা। অথচ ওরাই এখন বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ গান, কবিতা আর নৃত্যের মাধ্যমে সবাইকে মনেপ্রাণে সত্যিকারের বাঙালি হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। নিজেদের দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনেও নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।


নতুন প্রজন্মের এই হরিজন শিশু-কিশোর অনেকটাই পাল্টে ফেলেছে তাদের চৌদ্দ পুরুষের ক্ষয়িষ্ণু জীবনাচার ও সংস্কৃতি। এই ব্যতিক্রমী ধারায় যুক্ত শিশু-কিশোরদের বসবাস রংপুর সদর হাসপাতাল হরিজন পল্লীতে। ওদের বদলে যাওয়ার সূচনা 'বিহঙ্গ' নামের একটি সংগঠনের সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে। এই বিহঙ্গ এখন ওদের পথচলা আর সংগ্রামের প্রেরণা।
গত সোমবার বিকেলে রংপুর মহানগরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ওই হরিজন পল্লীতে পা রাখতেই সম্মিলিত কণ্ঠে গাওয়া গুরুসদয় দত্তের সমাজ জাগানিয়া সেই গান_'মানুষ হ মানুষ হ, আবার তোরা মানুষ হ'-এর অনুকরণে 'আবার তোরা বাঙালি হ'_কথাগুলো বেশ জোরালোভাবে কানে এসে ধরা দেয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শুধু গান আর কবিতায় নয়, হরিজন এই শিশু-কিশোররা এখন তাদের বংশপরম্পরায় পাওয়া ময়লা-আবর্জনা সাফ করার পাশাপাশি পড়াশোনার জন্য নিয়মিত বিদ্যালয়েও যাচ্ছে। প্রতিদিনের গানের ক্লাস ছাড়াও সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিকসহ নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েও কুড়িয়ে আনছে নানা পুরস্কার।
ওদের সঙ্গে নানা কথাবার্তা চলছিল। সে সময় বই-খাতার ব্যাগ ঘাড়ে হাজির হলো এক তরুণ। উপস্থিত সবাই তাকে 'ডিজেল' বলে সম্বোধন করলেও ওই তরুণ জানালো তার নাম উজ্জ্বল রায়। লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসিতে ভালো ফল করে এখন ওই প্রতিষ্ঠানেই উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছে। উজ্জ্বলের স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়ার। কারণ হিসেবে জানালো, চিকিৎসকরা তাদের 'মানুষ' মনে করে না। তাই সে প্রমাণ করবে সুইপাররাও মানুষ এবং তারাও ভালো কিছু করতে পারে। উজ্জ্বল একা নয়, তার মতো আরো অনেক হরিজন তরুণ এখন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে বিভোর।
দলিতদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বিহঙ্গর প্রতিষ্ঠাতা মৌসুমী শঙ্কর ঋতা। ছড়াকার ঋতা ২০০৬ সালে একক প্রচেষ্টায় এই সংগঠনটি গড়ে তোলেন। উদ্দেশ্য অবহেলিত এবং সুবিধাবঞ্চিত এই হরিজন শিশুরা যাতে সমাজের আর ১০ জনের মতোই লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারে। ঋতা তাঁর লক্ষ্যে এগিয়েছেন অনেকটাই। তিনি জানালেন, এই হরিজন পল্লীতে গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র নামের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি শুধু অক্ষরজ্ঞান শেখানোর জন্য একটি স্কুল খুললেও তা যথেষ্ট ছিল না। সুবিধাবঞ্চিত এসব হরিজন শিশু-কিশোর নিয়ে তিনি কাজ করবেন_এমনটা ভাবনা ছিল ঋতার অনেক আগে থেকেই। ২০০৬ সালে মাত্র ১২-১৪ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রথম তিনি তাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি গানসহ সংস্কৃতি চর্চার এই কার্যক্রম শুরু করেন। এ সময় সুইপারদের মধ্য থেকেই অনেকে এর বিরোধিতা করে। অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে ঋতা তাদের শেষ পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটি বোঝাতে এবং সম্মতি আদায় করে নিতে সক্ষম হন। ব্যাস, এখন পর্যন্ত তাঁকে আর তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। ঋতা জানান, এদের নিজস্ব সংস্কৃতির সংগীত হলো 'ভোজপুরী'। ভোজপুরীর পাশাপাশি ওরা এখন নিয়মিত রবীন্দ্র, নজরুল, আধুনিক, লালন ও লোকগীতি গায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সদর হাসপাতাল হরিজন পল্লীতে ৬৬টি পরিবারে প্রায় ৮০০ মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে শিশু-কিশোরের সংখ্যা কমপক্ষে ১০০। বিহঙ্গ প্রতিষ্ঠাকালে এদের অনেকেই স্কুলে যাওয়া তো দূরের কথা, লেখাপড়ার ধারই ধারতো না। কেউ লেখাপড়া করলেও তা ছিল বড় জোর তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। এর পরই শিকেয় উঠত লেখাপড়া। বিহঙ্গ তাদের উদ্বুদ্ধ করে পড়াশোনার ব্যাপারে। তারা এখন কম-বেশি সবাই নিয়মিত স্কুলে যায়। এদেরই একজন মানিক বাসফোর। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। সম্প্রতি পৌরসভায় সুইপারের চাকরি নিয়েছে। তার গাওয়া গান এবং জীবন নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে ইউনিসেফের মিনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড (২০০৮) লাভ করেন বর্তমানে এটিএন বাংলার প্রযোজক মো. শারফুল আলম। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ভারতী রাজের লেখা অনেক কবিতা ও ছড়া ছাপা হয়েছে স্থানীয় পত্র-পত্রিকায়। এ ছাড়া স্কুল কিংবা জাতীয় দিবসের কোনো আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জিতেছে পুরস্কারও। দারুণ আবৃত্তিও করে সে। আরেকজনের নাম রাধা রানী বাসফোর। সে চ্যানেল আইয়ের ক্ষুদে গানরাজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অনেকদূর এগিয়েও আর অংশ নেয়নি। এ ছাড়া পিয়া, শাকিল, রানা, লিমন, জুলি, টুটুলসহ অনেকেই লেখাপড়া, সংগীত, আবৃত্তি ও গানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য বয়ে আনছে।
ঋতা জানান, শুরু থেকেই তাঁকে উৎসাহ এবং নানাভাবে সহায়তা করে আসছেন তাঁর বড় ভাই সুব্রত সরকার গৌড়। এর মধ্যে বর্তমান জেলা প্রশাসক বি এম এনামুল হক তাঁদের কিছুটা আর্থিক সহায়তা করেছেন। আরো কেউ কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালেও তা একেবারেই অপ্রতুল। তিনি জানান, অবহেলিত এবং সুবিধাবঞ্চিত এই শিশু-কিশোরদের নিয়ে অনেক সভা-সেমিনার করি। অনেক ভালো ভালো কথা বলি। এসব কারোরই মনের কথা নয়। এখনো মন থেকে আমরা মেনে নিতে পারি না এই হরিজন শিশুদের। এখনো তারা হোটেলে বসে খেতে পারে না। হোটেলের গ্লাসে তাদের পানি খেতে দেওয়া হয় না। ওরা স্কুলে লেখাপড়া করে নিজস্ব পরিচয় আড়াল করে। জাতি হিসেবে ওদের হিন্দু পরিচয় দিয়ে স্কুলে ভর্তি করানো হয়। যখন সাধারণ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা জানতে পারে ওরা সুইপার, তখন সরাসরি না হলেও নানাভাবেই তাদের মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে স্কুল থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। তিনি জানান, সবাই প্রকৃত উদার মন নিয়ে এগিয়ে এলে এদের জন্য অনেক কিছুই করা সম্ভব। প্রমাণ করা সম্ভব হরিজন হলেও এরা মানুষ এবং এই মানব শক্তি দিয়েও সমাজের অনেক কিছু করা সম্ভব।
রংপুরের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সাথাওয়াত রাংগা বলেন, 'হরিজন শিশু-কিশোররা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে যেভাবে কাজ করছে, এটা আমাদের জন্য একটা শিক্ষা।' তাঁর মতে, 'একজন নারী যদি একক প্রচেষ্টায় এই হরিজন শিশু-কিশোরদের এতটা সহযোগিতা দিতে পারেন, তাহলে আমরা সবাই মিলে কেন ওদের আরো এগিয়ে নিতে পারব না।' তিনি জানান, এর জন্য দরকার মানসিকতার পরিবর্তন।
বিহঙ্গ এবং হরিজন শিশু-কিশোরদের নিয়ে জেলা প্রশাসক বললেন, প্রতিভা থাকলে তা যে বিকশিত হবে, এটিই তার বড় প্রমাণ। এই মানব সম্পদকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি জানান, এদের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা দরকার।
 

No comments

Powered by Blogger.