কাঁদছে তিনজনের পরিবার

কসময় তাঁদের নামে উঠত জয়ধ্বনি। এখন দুয়োধ্বনি দশ দিকে। মাঠে তাঁদের পারফরম্যান্সে করতালির বৃষ্টি ঝরেছে কত! এখন সেই জায়গা নিয়েছে ধিক্কার। সালমান বাট, মোহাম্মদ আসিফ ও মোহাম্মদ আমেরকে মাথায় তুলে নাচত যারা, এখন তারাই এই ত্রয়ীকে নিক্ষেপ করছে আবর্জনার আঁস্তাকুড়ে। ইংল্যান্ডে জেলখানার চারপাশের দেয়াল তাই যেন ক্রমে পাষাণভার হয়ে চেপে ধরছে তাদের। ওই ছোট্ট কুঠরির চেয়েও সংকুচিত হয়ে গেছে তাঁদের জীবন। তবুও পরিবারকে ঠিকই পাশে পাচ্ছেন তাঁরা। রক্তের সম্পর্ক বলে কথা!


আমেরের মা'র অশ্রুসিক্ত ছবি দেখে সহানুভূতি জেগেছে অনেকের মনে। তাঁর 'বাচ্চা ছেলে'র অপরাধের শাস্তি হিসেবে ছয় মাসের জেল মানতে পারছেন না তিনি। অভিন্ন কথা বলেছেন ভাই মোহাম্মদ ইজাজও, 'আমার ভাই সব অপরাধ স্বীকার করে নেওয়ার পরও কেন ওকে জেলে দেওয়া হলো। আমরা ভেবেছিলাম ও মুক্তি পাবে।' এক দরিদ্র অঞ্চল থেকে উঠে আসা আমের হয়তো অর্থের মোহে পড়ে গুলিয়ে ফেলেছিলেন ন্যায়-অন্যায় বোধ। সালমান বাটের তো তা হওয়ার কথা নয়। লাহোরের এক ধনী পরিবারেই তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবা জুলফিকার আলী বাট তাই সন্তান অপরাধ করেছে বলে মানছেনই না। বিচারক সালমানকে এই অপকর্মের হোতা হিসেবে চিহ্নিত করলেও সেটি মানতে নারাজ জুলফিকার, "আমি সেবার হজে গিয়েছিলাম যখন সালমান আমাকে ফোন করে বলল, ম্যাচ পাতানোর সঙ্গে ওর নাম এসেছে। আমি সেই মুহূর্তে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, 'শপথ করে বলো, তুমি এর সঙ্গে জড়িত কি না?' ও শপথ করেই সেটি অস্বীকার করল। আমার ছেলে কখনোই মিথ্যা বলে না।" সালমানের ৩০ মাসের জেলের শাস্তির বিপক্ষে আপিল করবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। তার পরও সন্তান অপরাধী প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য প্রস্তুত তাঁর বাবা, 'যদি এই জঘন্য অপকর্মে আমার সন্তানের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়, আমি জাতির উদ্দেশে বলছি, সালমানকে নিয়ে আমি প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলতে প্রস্তুত।'
সালমান বাটের শাস্তিটা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে পারিবারিক কারণে। বিচারক তাঁর দণ্ড দেওয়ার দিনেই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তাঁর স্ত্রী। এই মাসে লাহোরে সালমানের বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। স্বাভাবিক কারণেই স্থগিত করা হয়েছে তা। 'আমরা সবাই প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছি। এটি আমাদের পরিবারের জন্য বিশাল এক ট্র্যাজেডি। মেয়ের শ্বশুরপক্ষের লোকরা সেটি বুঝেছে'_বলেছেন সালমানের বাবা। পুরো পরিবারই যে ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে, সেটি বোঝা যাবে সালমানের বোন রুবাবের কথায়, 'আমার মা ভালো নেই। ভালো নেই সালমানের স্ত্রীও। ওরা শুধু কেঁদেই চলেছে, কোনো ঘুম-খাওয়া নেই। সে আমার একমাত্র ভাই, আমার মায়ের একমাত্র ছেলে। ও বিদেশের জেলে একা পড়ে আছে, আমরা কেউ কোনো কাজে আসছি না, এ যে কী জ্বালা!'
জুলফিকার বাট পুরো ব্যাপারটায় পাচ্ছেন ষড়যন্ত্রের গন্ধ, 'আমার ছেলে আসলে ফাঁদে পড়েছে। পাকিস্তান ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করার জন্য এটি করা হয়েছে। সালমানের সঙ্গে আরো এমন দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যারা খুব ভালো খেলছিল। আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের সম্পদগুলোকে ষড়যন্ত্র করে জেলে পাঠানো হয়েছে।' আর রাওয়ালপিন্ডিতে যাঁর একাডেমীতে ক্রিকেটার হিসেবে হাতেখড়ি আমেরের, সেই আসিফ বাজওয়া এই ঘটনায় সিংহ ভাগ দায় চাপিয়েছেন পাকিস্তান টিম ম্যানেজমেন্টের ওপর, 'আমি মনে করি, এই অপরাধের ৮০ শতাংশ দায় ইংল্যান্ড সফরের ম্যানজেমেন্টের। কেউ কি ম্যানেজার ইয়োহার সায়িদকে এ জন্য দোষারোপ করেছে? নিরাপত্তা ম্যানেজারের কাছে কেউ জানতে চেয়েছে, অনাহূত লোকজন কি করে ওদের সঙ্গে মিশল? যখন আপনি শিশুকে স্কুলে পাঠান, জানেন যে কড়া শিক্ষক ওর প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখবে। পাকিস্তান দলে সেটি হয়নি। আমার তাই মনে হয়, আরো অনেক ক্রিকেটারকেই ওদের দুর্ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে।'
শাস্তি ঘোষণার পর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন মোহাম্মদ আমের। সেখানে নিজের অপরাধ আরেকবার স্বীকার করে পিসিবিকেও দায়ী করেছেন এ বাঁহাতি ফাস্ট বোলার, 'পিসিবি আমাকে এই ম্যাচ পাতানো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেয়নি। যা ঘটেছে, তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কৃতকর্মের জন্য পাকিস্তানি জনগণের কাছে আমি ক্ষমা চাইছি। আমি তখন বুঝিনি যে এ ঘটনা এত দূর গড়াবে। যদি জানতাম, তাহলে কখনোই এসবে জড়াতাম না। এটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।' নিজে সব স্বীকার করায় যে সতীর্থ দুজনের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন, তাও বলেছেন তিনি, 'সালমান ও আসিফ বিচার চলাকালীন আমার নামে অনেক কুৎসা বলেছে। ক্ষতিগ্রস্ত করতে চেয়েছে আমার ইমেজ। যখন সময় আসবে, এই কেসের খুঁটিনাটি সব আমি বলব।'
শাস্তি হয়ে গেছে। এখন এই দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে সামনে এগিয়ে চলাই এই ত্রয়ীর একমাত্র স্বপ্ন। আমেরের সেই স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করবেন বলে বদ্ধপরিকর আসিফ বাজওয়া, 'আমের ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত। আমি ওর সঙ্গে প্রতি দিন ফোনে কথা বলেছি। বলেছি যে যখন ফিরবে, তখন আর কারো সঙ্গে ওকে দেখা করতে দেব না। এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে আমি ওকে আড়াল করব। আরো ভালো মানুষ এবং পরিচ্ছন্ন ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তুলব।'
দুঃস্বপ্নের রাত পেরিয়ে অমন সুন্দর ভোরের স্বপ্নের চেয়ে ভালো উদ্দীপনা আর কী হতে পারে! ক্রিকইনফো/ এপি/এএফপি/রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.