যানজটে স্থবির মহাসড়ক : দুর্ভোগে ঘরমুখো মানুষ by কাজী জেবেল

ড়ক-মহাসড়ক ও ফেরিঘাটে ভয়াবহ যানজটে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে। বাসের শিডিউল ভেঙে পড়েছে। রেলও ছেড়েছে নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে গতকাল প্রতিটি ট্রেন ৩-৪ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে। এরমধ্যে গতকাল দুপুরে কুমিল্লায় মালবাহী রেল দুর্ঘটনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ৪ ঘণ্টা পর ট্রেন চালু হয়। ট্রেন বিঘ্নিত হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন ঈদের ঘরমুখো মানুষ। রাজধানীর বাস ও ট্রেন স্টেশনে নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা পরও কাঙ্ক্ষিত যানবাহনের দেখা পাননি তারা।


চরম ভোগান্তির শিকার এসব যাত্রী বাস ও ট্রেন টার্মিনালে অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। অনেককে আবার ব্যাগের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা গেছে। বাস মালিক ও শ্রমিকরা জানান, সড়ক-মহাসড়কগুলোতে ভয়াবহ যানজট ও ফেরি পারাপারে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হওয়ায় বাসগুলো সময় অনুযায়ী রাজধানীতে ঢুকতে পারছে না। নির্ধারিত সময়ে গাড়ি ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে ওইসব গাড়ির যাত্রীরা কাউন্টারের আশপাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবস্থান করে অপেক্ষা করছেন। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছেন, নরসিংদীতে ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয়ায় ক্ষতি হওয়ায় ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি হবে।
এদিকে ঘরমুখো যাত্রীদের চাপ বেশি থাকার সুযোগ নিয়ে রাজধানীতে চলাচলকারী লক্কড়-ঝক্কড় অনেক বাস দূরপাল্লার যাত্রী বহন করছে। অনেক বাস ও লঞ্চ মালিক গলাকাটা ভাড়া আদায় করছে। আগাম টিকিট সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হওয়া অনেক যাত্রী ঝুঁকি নিয়ে গতকাল বাস, ট্রেন, ট্রাক ও লঞ্চের ছাদে চড়ে বাড়ি ফিরেছেন। সব মিলিয়ে ঈদযাত্রীরা ভোগান্তি ও কষ্টের মধ্যেই গন্তব্যে গেছেন। সরেজমিন লঞ্চ-বাস টার্মিনাল এবং রেলস্টেশন ঘুরে গতকাল এসব চিত্র দেখা যায়।
যানজটে যান চলাচলে স্থবিরতা : রাজধানীর সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগের অন্যতম পথ হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও মাওয়া-কাওড়াকান্দি ফেরিপথ। গুরুত্বপূর্ণ এসব পথে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এতটাই ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে যে, যানবাহন চলাচলে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গত বুধবার গভীর রাত থেকে চলা যানজট গতকাল রাত পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বিশেষ করে কুমিল্লার চান্দিনা থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার এলাকায় যানজটের মাত্রা বেশি ছিল। যানজট নিরসনে গতকাল কুমিল্লা অংশে অতিরিক্ত ২৪০ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে গাজীপুরের কালিয়াকৈর থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। মহসড়কে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ও যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো, মৌচাক, সফিপুর, চন্দ্রা, বাড়াইপাড়া, কবীরপুর ও কালিয়াকৈর বাসস্ট্যান্ডে অতিরিক্ত গাড়ির চাপ থাকায় যানজট শুরু হয় বলে পুলিশ জানায়। এছাড়া ঢাকা-টাঙ্গাইল রুটের বাইপাস সড়কে একটি বাস এবং বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু ট্রাক বিকল হয়ে পড়ায় ঢাকা-বঙ্গবন্ধু সেতু সংযোগ সড়কে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়। করটিয়া থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে কয়েকশ’ গাড়ি আটকা পড়ে। এতে ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এ স্থানে ২০ মিনিটের পথ যেতে সময় লাগে ৮ ঘণ্টার বেশি। এদিকে ফেরিঘাটেও ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। গাড়িচালকরা জানান, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম মাওয়া-কাওড়াকান্দি ফেরিঘাটের মাওয়া পয়েন্টে গাড়ির দীর্ঘ সিরিয়াল রয়েছে। প্রতিটি বাস পারাপারে ৮-১৪ ঘণ্টা সময় লাগছে। একই অবস্থা পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে। গতকাল বিকাল ৩টায় মাওয়া ঘাট থেকে আমার দেশ-এর স্টাফ রিপোর্টার মাহবুবুর রহমান জানান, সকাল পৌনে ৮টায় মাওয়ায় পৌঁছলেও ফেরিতে বাস উঠেছে বিকাল সোয়া তিনটায়। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যেসব বাস সকাল ৯টার পর মাওয়ায় পৌঁছেছে সেগুলো গভীর রাতেও পার হতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে এই দুই স্থানে পর্যাপ্ত ফেরি দেয়ার কথা থাকলেও তা না করায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান বাস মালিক ও চালকরা। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ খান গতকাল রাতে আমার দেশকে বলেন, যানজটের কারণে বাসের ট্রিপ কমে গেছে। নির্ধারিত সময়ে বাস ছাড়া যাচ্ছে না। হাইওয়ে পুলিশের গাফলতি, রাস্তার ওপর গরুর হাট ও দুর্ঘটনাকবলিত যানবহন দ্রুত সরিয়ে নিতে না পারায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
নির্ধারিত সময়ে ছাড়ে না বাস : সড়ক-মহাসড়ক ও ফেরিঘাটে তীব্র যানজটের কারণে নির্ধারিত সময়ে ঢাকায় পৌঁছতে পারেনি দূরপাল্লার বাস। ফলে গতকাল শিডিউল অনুযায়ী ওইসব বাস নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়েও যায়নি। যেসব বাস সকালে ছাড়ার সময় নির্ধারিত ছিল, বিকালেও ওই বাসের দেখা পাওয়া যায়নি। এতে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। রাজধানীর গাবতলী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, যাত্রীরা ব্যাগ-লাগেজ নিয়ে কাউন্টারের বিশ্রামাগার ও আশপাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। কেউ কেউ বসতে পেরেছেন। আবার কেউ রাস্তার পাশে বসে রয়েছেন। ঢাকা থেকে বরিশাল, রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের দূরপাল্লার বাসগুলো সাধারণত গাবতলী টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়। গতকাল বিকালে এ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, টার্মিনাল যাত্রীতে ভরে গেছে। সামনের রাস্তায় অনেক যাত্রী বসে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন। অনেক যাত্রী দীর্ঘ সময় বসে থাকায় ক্লান্ত হয়ে রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়েন। যাত্রীদের বিশ্রামের জন্য নাবিল, হানিফসহ অন্যান্য পরিবহন কাউন্টারের সামনে অস্থায়ী ক্যাম্প খুলেছে। অপেক্ষমাণ যাত্রী আর পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকাল ৮টার পর দু’একটি ছাড়া দূরপাল্লার গাড়ি টার্মিনাল ছেড়ে যায়নি। বৃহস্পতিবার যেসব গাড়ি ঢাকা থেকে অন্যান্য জেলায় গেছে, তা যানজটের কারণে গাবতলী পৌঁছায়নি। নির্ধারিত সময়ে গাড়ি না পেয়ে হাজার হাজার যাত্রী পরিবহনগুলোর কাউন্টার এলাকায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। অনেকেই পরিবহন শ্রমিকদের মারতে তেড়ে যান। রংপুরের যাত্রী রহমান বিশ্বাস জানান, হানিফ পরিবহনের ১১টার বাসের টিকিট নিলেও ৪টা পর্যন্ত তিনি কোনো গাড়ির দেখা পাননি। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ঈগল পরিবহনের টিকিট বিক্রেতা মজিবুর রহমান জানান, বরিশাল ও খুলনা থেকে বৃহস্পতিবার রাতে ছেড়ে আসা বাসগুলো শুক্রবার ভোররাতে ঢাকায় পৌঁছার কথা ছিল। কিন্তু দুপুর অবধি কোনো বাসের দেখা মেলেনি। একই অবস্থা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালেও। কক্সবাজারের চকরিয়াগামী যাত্রী সাইফুল ইসলাম জানান, ভোর সাড়ে ছয়টায় বাস সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। এজন্য আধঘণ্টা আগেই সায়েদাবাদ চলে এসেছি। অথচ তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পরও বাসের দেখা পাইনি। কখন বাস আসবে—সে বিষয়ে কাউন্টারের লোকজনও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি।
রাজধানীতেই দুর্ভোগ : ঈদযাত্রায় রাজধানীতেই দুর্ভোগের শিকার হন যাত্রীরা। সিটি সার্ভিসের বাসগুলোতে মানুষের ভিড়ে ওঠার কোনো সুযোগ নেই। লোকাল বাসগুলো অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে সিটিং সার্ভিস হয়ে গেছে। কাউন্টার সার্ভিসের বেশিরভাগ বাস দূরপাল্লার ট্রিপ দিতে চলে গেছে। অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাব চালকরা দু’তিনগুণ বেশি ভাড়া ছাড়া যাত্রী বহন করতে নারাজ। রাস্তায় কোরবানির পশুর হাট ও ফুটপাত হকারদের দখলে চলে যাওয়ায় চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। সদরঘাটগামী যাত্রী আবদুর রহমান জানান, বাসে অতিরিক্ত যাত্রী থাকায় মিরপুর থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সদরঘাটগামী কোনো বাসে ওঠার সাহস পাইনি। অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাব চালকরা ভিড় ঠেলে সদরঘাট যেতে রাজি নন। পরে অনেক বুঝিয়ে ৫০০ টাকা ভাড়ায় একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে সদরঘাট পৌঁছাই। এছাড়া গাবতলী, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, সদরঘাট ও কমলাপুর ট্রেন টার্মিনালে পকেটমার, ছিনতাইকারী, অজ্ঞান ও মলম পার্টির তত্পরতা দেখা যায়।
ঝাউয়া বাসের দৌরাত্ম্য : ঈদ সামনে রেখে বেড়েছে ‘ঝাউয়া’ ট্রিপের। অদ্ভুত এ নামের বাসগুলোর নির্দিষ্ট কাউন্টার নেই। নেই নির্ধারিত সময়সূচি। যাত্রী পেলেই দূরদূরান্তের পথে পাড়ি দেয়। যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করে ইচ্ছেমত ভাড়া। পরিবহন সেক্টরে এসব বাস ‘ঝাউয়া’ নামে পরিচিত। গতকাল রাজধানীর বাস টার্মিনাল থেকে অনেক বাসকে ঝাউয়া ট্রিপ দিতে দেখা গেছে। আগাম টিকিট না পাওয়া যাত্রীরা অনেকটা বাধ্য হয়েই এসব বাসে চড়েন। আবার কম ভাড়ায় যাওয়া-আসায় অনেক যাত্রী ইচ্ছে করেই এসব বাসে যাতায়াত করেন। গতকাল গাবতলী-রাজশাহী, গাবতলী-সৈয়দপুর, গাবতলী-দিনাজপুর, গাবতলী-রংপুর, ঢাকা-দাউদকান্দি, ঢাকা-কিশোরগঞ্জ, ঢাকা-নরসিংদীসহ বেশক’টি রুটে ঝাউয়া বাস চলাচল করতে দেখা গেছে। এসব বাসের ভেতর দাঁড় করিয়ে এবং ছাদে যাত্রী বহন করা হচ্ছে। একইভাবে ঝাউয়া ট্রিপ দিতে রাজধানীতে চলাচলকারী সিটি সার্ভিস ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলাচল করে—এমন বাস ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। সায়েদাবাদ-কিশোরগঞ্জ, সায়েদাবাদ-ভৈরব, সায়েদাবাদ-দাউদকান্দি, মহাখালী-ময়মনসিংহ, মহাখালী-জামালপুর, গাবতলী-পাবনা, গাবতলী-রাজশাহীসহ বেশকিছু রুটে এসব বাস চলাচল করতে দেখা গেছে। এছাড়াও সিটি সার্ভিসের বেশকিছু বাস অন্যান্য রুটের যাত্রী বহন করেছে।
অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ছেড়েছে লঞ্চ : আইন অনুযায়ী লঞ্চের ছাদে যাত্রী বহন নিষিদ্ধ। ছাদে যাত্রী বহন করা হলে নৌ-দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। এটা জানা সত্ত্বেও সদরঘাট থেকে গতকাল ছাদে যাত্রী নিয়ে লঞ্চ ছেড়ে গেছে। লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন (যাপ) সংস্থার সেক্রেটারি সিদ্দিকুর রহমান জানান, গতকাল সদরঘাট থেকে ৩৪টি রুটে ৮৫টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে। এর মধ্যে ৬৫টি নিয়মিত সার্ভিস ও ২০টি স্পেশাল সার্ভিস। এদিকে সদরঘাট ঘুরে দেখা গেছে, দুপুর থেকেই বেশিরভাগ লঞ্চে যাত্রী ভরে টইটুমু্বর। ডেকের কোথাও যাত্রীদের বসার জায়গা নেই। এমনকি কেবিনের রাস্তা ও টয়লেটের সামনেও মানুষ আসন পেতেছে। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। শীতের রাত জেনেও অনেক নারী-পুরুষ লঞ্চের ছাদে চড়েছেন। এর পরেও বেশি যাত্রী নেয়ার আশায় এসব লঞ্চ ছাড়ার অনুমতি দেয়নি লঞ্চ মালিকরা। এ নিয়ে অনেক যাত্রী প্রতিবাদ ও হৈ চৈ করলে লঞ্চের স্টাফ ও ঘাট শ্রমিকরা তাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে চুপ থাকতে বলছে। অন্যথায় লঞ্চ থেকে নামিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। একাধিক লঞ্চের মাস্টার ও ড্রাইভার নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, দুপুরের আগেই তাদের লঞ্চগুলোয় অতিরিক্ত যাত্রী উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঝে মধ্যে এসে লঞ্চ ছাড়ার তাগিদ দিচ্ছেন। কিন্তু মালিকের নির্দেশ না পাওয়ায় লঞ্চ ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না। তারা আরও বলেন, অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে যাত্রাপথে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যাত্রীদের মধ্যে কোনো গণ্ডগোল হলে লঞ্চের ভারসাম্য রক্ষা করা কষ্টকর হয়ে পড়বে। এ কারণে অতীতে অনেক দুর্ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু মালিকরা অতিরিক্ত আয়ের আশায় এসব তোয়াক্কা করছেন না। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন (যাপ) সংস্থার সহ-সভাপতি সাহাবউদ্দিন মিলন আমার দেশকে বলেন, লোড লাইন না ডোবা পর্যন্ত কোনো লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী বহন করছে তা বলা যাবে না। ছাদে যাত্রী ওঠা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লঞ্চের আনসার ও স্টাফরা পেটালেও যাত্রীদের ছাদ থেকে নামানো যায় না। ডেকে জায়গা থাকা সত্ত্বেও অনেকে কৌতূহলবশত ছাদে চড়ে। এতে আমাদের কিছু করার থাকে না।
বাস-ট্রাকের ছাদে চড়ে ঈদযাত্রা : বাসের ছাদে চড়ে অনেক যাত্রীকে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। গাবতলীতে গরু আনা হয়েছিল এমন ট্রাকে চড়েও গেছেন অনেকে। যাত্রী ও চালকের মতে, কম ভাড়ায় ছাদে চড়ে যাওয়া যায়। এতে উভয়ের লাভ। রংপুরগামী লামইয়া এন্টারপ্রাইজ বাসের যাত্রী বাবুল মোল্লা বলেন, বাসের ভাড়া ৩৫০ টাকা। ছাদের ভাড়া ১৫০ টাকা। এজন্য ছাদে চড়েছি। গাবতলীতে গরু নিয়ে ঢাকা আসা খোলা ট্রাকে চড়ে দিনাজপুর, পাবনা, রংপুর, সৈয়দপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বেশকিছু রুটে যেতে দেখা গেছে। কম ভাড়ায় যাওয়া ও পরিবহন সঙ্কট থাকায় উত্তরাঞ্চলের যাত্রীরা ট্রাকে যেতে পছন্দ করে বলে জানান একাধিক ট্রাক চালক। তারা বলেন, আমরাও কিছু বাড়তি পয়সা পাই। আর মানুষ বাড়ি যেতে পারে তাই বহন করি। আর যাত্রীরা বললেন, মাত্র ৫০ থেকে ১০০ টাকায় বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় ট্রাকে উঠেছি। ভালোমানের গাড়িতে একই পথের ভাড়া ৩০০-৪০০ টাকা। এছাড়া বাসের ছাদে যাওয়ার চেয়ে ট্রাকে যাওয়াটা তুলনামূলক নিরাপদ।
ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় অব্যাহত : আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য বেশিরভাগ মানুষের পছন্দ ট্রেন। ঈদ মৌসুমে সেই আরাম থাকে না। আগাম টিকিট সংগ্রহকারীরা নির্দিষ্ট সময়ে স্টেশনে পৌঁছলেও ট্রেন ছেড়েছে অনেক পড়ে। এছাড়া ট্রেনের সিট ছাড়াও দাঁড়িয়ে বাড়তি যাত্রী বহন করা হয়। ট্রেনের ছাদে চড়ে অনেক যাত্রী গন্তব্যে গেছেন। এদিকে গতকালও শিডিউল অনুযায়ী ট্রেন চলাচল করেনি। এর কারণ হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়ের যুগ্ম-মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. মিয়াজাহান বলেন, সময় মেপে ট্রেন চলে। ঈদের সময় যাত্রীদের সঙ্গে অতিরিক্ত মাল ও বড় বড় ব্যাগ-লাগেজ থাকে। এ সময় প্রচুর সংখ্যক মহিলা, শিশু ও বয়স্ক যাত্রীও থাকেন। ট্রেন স্টেশনগুলোতে এসব যাত্রীর ওঠা-নামার জন্য অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়। এছাড়া ঈদে বেশি যাত্রী থাকায় ট্রেন স্টেশনে আসার সঙ্গে সঙ্গে টিকিটবিহীন যাত্রীরা ছাদে ও বগিতে জোরপূর্বক উঠে পড়ে। এসব যাত্রীর টিকিট ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশি সময় ব্যয় হয়। ফলে ঈদে ট্রেনের শিডিউল রক্ষা করা সম্ভব হয় না। গতকাল কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেটগামী ট্রেনগুলো ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে গেছে। উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনগুলোও দেরিতে ছেড়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সহকারী পরিচালক (সেন্ট্রাল কন্ট্রোল) রেজাউল হক সাংবাদিকদের জানান, লালমনি এক্সপ্রেস ৭ ঘণ্টা বিলম্বিত হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ট্রেনও ছেড়েছে এক থেকে দেড় ঘণ্টা দেরিতে। এদিকে গতকাল সকালে কমলাপুর রেলস্টেশন পরিদর্শন করেছেন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নরসিংদীতে বুধবার ট্রেনে আগুন দেয়ার ঘটনায় বৃহস্পতিবার থেকে ট্রেনের শিডিউল ঠিক থাকছে না। এর নেতিবাচক প্রভাব ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের ওপরও পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
বিকল্প পথে বাড়ি ফেরা : পরিবহন সঙ্কটের কারণে ঈদের আগাম টিকিট সংগ্রহ করতে না পারা যাত্রীরা বিকল্প পথে বাড়ি ফিরতে দেখা গেছে। সচ্ছল পরিবারগুলো মাইক্রোবাস ভাড়া করেই গন্তব্যে গেছেন। কম দূরত্বের যাত্রীরা ট্যাক্সিক্যাব ও সিএনজি নিয়েই গন্তব্যে গেছেন। আবার একই এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা লোকাল বাস রিজার্ভ করে যাত্রা করতে দেখা গেছে। অনেক যাত্রী ভেঙে ভেঙে কাটা পথে গন্তব্যে গেছেন।
কাওড়াকান্দি-মাওয়া নৌরুটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় : আমাদের শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি জানান, কাওড়াকান্দি-মাওয়া নৌরুটে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি ভাড়া দিয়ে পার হচ্ছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হাজার হাজার যাত্রী সাধারণ। দক্ষিণাঞ্চলের ঘরমুখো যাত্রীরা জানান, মাওয়া ঘাট থেকে সি-বোটে ১৩০ টাকার স্থলে ২২০ টাকা, লঞ্চে ২৫ টাকা ভাড়ার স্থলে ৪০ টাকা এবং ট্রলারে ৩০ টাকার স্থলে ৫০ থেকে ৭০ টাকা ভাড়া নেয়া হচ্ছে। কাওড়াকান্দি ঘাট এলাকা থেকে খুলনা, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, বরিশাল, মাদারীপুরসহ ২১টি জেলায় চলাচলকারী মাইক্রোবাসেও অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। মাইক্রোবাসে বরিশাল পর্যন্ত ১৫০ টাকার স্থলে ৩০০ টাকা, খুলনা ২০০ টাকার স্থলে ৩৫০টাকা, মাদারীপুর ১০০ টাকার স্থলে ২০০ টাকা, কালনা ঘাট ১৫০ টাকার স্থলে ৩০০টাকা নেয়া হচ্ছে। মাইক্রোবাস ছাড়াও কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে বাস, সবুজ বাংলা, টেম্পো, বেবীসহ সব পরিবহনেই প্রতিটি রুটে দেড় থেকে দু’গুণ ভাড়া আদায় করছে। কাওড়াকান্দি মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সভাপতি খোকা মাদবর জানান, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ভাড়া একটু বেশি নেয়া হচ্ছে। শিবচর থানা পুলিশ পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক বলেন, কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের নিকট থেকে ঈদের সময় অতিরিক্ত ভাড়া রোধে পুলিশ ও প্রশাসনের সভা করে পরিবহন মালিকদের কঠিন হুশিয়ারি দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া কথা আমি শুনিনি এরপরও যদি কেউ অতিরিক্ত ভাড়া নেয় তবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.