লোকমানকে প্রথম গুলি ছোড়ে আশরাফ : এজাহারে বিস্তারিত বিবরণ

মেয়র লোকমানকে টার্গেট করে প্রথম গুলিটি ছোড়ে যুবলীগ নেতা আশরাফুল সরকার। গুলিটি বুকের বাঁ পাশের উপরিভাগে লাগলে গুরুতর জখম হন মেয়র। এর পর মঞ্জুরের গুলি পেটের বাঁ পাশে নাভির নিচে বিদ্ধ হয়। আমির হোসেন আমুর গুলি লাগে মেয়রের বাঁ হাতে। খুনি মামুনের গুলি লাগে আবারও নাভির নিচে। অজ্ঞাত অস্ত্রধারীর আরও একটি গুলি বিদ্ধ হয় একই স্থানে।সংঘবদ্ধ হত্যাকারীদের একের পর এক গুলিতে চিত্কার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন লোকমান।


মাত্র কয়েক মিনিটের হত্যামিশন। আশপাশের লোকজনকে রীতিমত হতভম্ব বানিয়ে ভোজবাজির মতো ঘটে এই হত্যাকাণ্ড। একপর্যায়ে লোকজন খুনিদের ধাওয়া দিলে তারা ফাঁকা গুলি চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে পালিয়ে যায়।
পহেলা নভেম্বর সেই কালরাতে কীভাবে সশস্ত্র খুনিরা হত্যা করেছে নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেনকে, এহাজারে তা বিস্তারিত জানিয়েছেন নিহতের ভাই কামরুজ্জামান।
এজাহারে তিনি মুখ্য আসামি হিসেবে উল্লেখ করেছেন টিঅ্যান্ডটিমন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজুর ভাই ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর নাম। প্রভাবশালী এই আওয়ামী লীগ নেতা মেয়র লোকমানের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রভাবশালীদের নিয়ে এই হত্যার পরিকল্পনা করে। নিচে এজাহারের বিস্তারিত :
আমি নিম্নস্বাক্ষরকারী মোঃ কামরুজ্জামান (৩৮), পিতা-মৃত শাহনেওয়াজ মিয়া, সাং-১৩৯, বাসাইল, থানা ও জেলা-নরসিংদী। আপনার থানায় হাজির হইয়া এই মর্মে লিখিত এজাহার দায়ের করিতেছি যে, আমার বড় ভাই লোকমান হোসেন, নরসিংদী পৌরসভার বর্তমান মেয়র। তিনি পরপর ২ (দুই) বার বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে নরসিংদী পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং মেয়র নির্বাচিত হন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট হইতে শ্রেষ্ঠ মেয়র হিসেবে দুই-দুইবার গোল্ড মেডেল প্রাপ্ত হন এবং মিউনিসিপ্যাল এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ম্যাব) ঢাকা বিভাগের সভাপতি, বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম ও পাওয়ার লুম ওনার্স এসোসিয়েশন-এর সভাপতি এবং নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। নরসিংদী পৌরসভার সর্বস্তরের জনগণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে রাস্তা-ঘাটসহ শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করিয়া আধুনিক শহরে রূপান্তরিত করেন। যাহার ফলে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান দেখে কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। প্রায়ই তারা আমার ভাইকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করত এবং টেলিফোনেও বিভিন্ন সময় হুমকি প্রদান করত। আসন্ন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে সামনে রেখে আমার ভাই লোকমান হোসেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হিসেবে প্রচার কার্য চালাচ্ছিলেন। পক্ষান্তরে সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু নিজেও উক্ত পদে প্রার্থী হিসেবে প্রচার কার্য চালাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি জনসমর্থন না পেয়ে আমার ভাই-এর জনসমর্থনে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দিত। আব্দুল মতিন সরকার এবং তারেক আহমেদ বিগত পৌরসভা নির্বাচনে আমার ভাই-এর নিকট বিপুল ভোটে পরাজিত হয়ে আমার ভাইকে প্রাণনাশের বিভিন্ন হুমকি দিত। আমার ভাই-এর রাজনৈতিক উত্থান এবং প্রচণ্ড জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হইয়া উপরোক্ত প্রভাবশালীদের সাথে আরো কিছু প্রভাবশালী লোকজন আমার ভাইকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে। আমার ভাই আমার সাথে এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে এবং আরো কিছু হিতাকাঙ্ক্ষীদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করেন। উপরোক্ত শত্রুতার জের হিসেবে আসামী—(১) সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু (৫২), পিতা-মৃত আফসার উদ্দিন, সাং-আদিয়াবাদ, থানা-রায়পুরা, (২) আব্দুল মতিন সরকার (৫৫), পিতা-মৃত ছালাহ উদ্দিন ওরফে সালু সরকার, সাং-দত্তপাড়া, থানা-নরসিংদী। (৩) মোবারক হোসেন ওরফে মোবা (৪১), পিতা-মৃত জজ মিয়া, সাং-পশ্চিম কান্দাপাড়া (মহিলা কলেজের পাশে) বর্তমানে উপজেলা মোড়, থানা-নরসিংদী, (৪) মোন্তাজ উদ্দিন ভূঞা (৫০), পিতা-মৃত আঃ জব্বার ভূঞা, সাং-দত্তপাড়া, থানা-নরসিংদী, (৫) নুরুল ইসলাম (৪৩), পিতা-মৃত ডা. আমিনুল ইসলাম, সাং-বৌয়াকুড়, থানা-নরসিংদী, (৬) মনোয়ার হোসেন খাঁন ওরফে মঈন (৪০), পিতা-মৃত বেলায়েত হোসেন খান, সাং-মধ্য কান্দাপাড়া (রহমান প্রেস), থানা-নরসিংদী, (৭) হিরন মিয়া (৪০), পিতা-মৃত আজিজ মিয়া ওরফে আইজ্জা, সাং-ভেলানগর, থানা-নরসিংদী, (৮) তারেক আহমেদ (৪৬), পিতা-মৃত মৌলভী তোফাজ্জল হোসেন, সাং-বানিয়াছল (খালপাড়), থানা-নরসিংদী, (৯) মাসুদুর রহমান মুরাদ (৪০), পিতা-মৃত আব্দুর রশিদ মাস্টার, সাং-আদিয়াবাদ, থানা-রায়পুরা, (১০) কবির সরকার (৪২), পিতা-রহমান সরকার, সাং-মহিলা কলেজের পাশে, থানা-নরসিংদী, সর্ব জেলা-নরসিংদী। উপরোক্ত আসামীগণ পরস্পর যোগসাজশে ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে আমার ভাইকে খুন করার জন্য নিম্নোক্ত আসামীদের নির্দেশ প্রদান করে। যাহাদের নাম—(১১) আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফুল সরকার (৩৮), পিতা-মৃত সালাউদ্দিন সরকার ওরফে সালু সরকার, সাং-দত্তপাড়া, থানা-নরসিংদী (১২), মিঞা মোঃ মঞ্জুর (৪০), পিতা-মৃত আব্দুর রশিদ, সাং-দত্তপাড়া, থানা-নরসিংদী, (১৩) আমির হোসেন ওরফে আমু (৪৫), পিতা-মৃত আজিজ মিয়া ওরফে আইজ্জা, সাং-ভেলানগর, থানা-নরসিংদী, (১৪) মামুন (২৫), পিতা-মৃত মানিক মিয়া, সাং-ভেলানগর, থানা-নরসিংদী, সর্ব জেলা-নরসিংদীসহ অজ্ঞাতনামা ৭/৮ জন আসামী। আমার ভাই পৌর মেয়র লোকমান হোসেন বিগত ০১-১১-২০১১ইং তারিখ সন্ধ্যা অনুমান ৭:০০ ঘটিকা হইতে নরসিংদী সদর রোডস্থ জেলা আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে বসিয়া আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ও কর্মীদের সাথে আসন্ন জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের বিষয়ে আলোচনা করাকালীন সময়ে একই তারিখ অনুমান রাত ৮:০০ ঘটিকায় ১১নং আসামী হইতে ১৪নং আসামীগণসহ অজ্ঞাতনামা আরো ৭/৮ জন সন্ত্রাসী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে জেলা আ’লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে আসিয়া সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত লোকজনের সামনে ১১নং আসামী আশরাফুল সরকার তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আমার ভাই লোকমান হোসেনকে হত্যার উদ্দেশ্যে বুক লক্ষ্য করিয়া গুলি করিলে উক্ত গুলি তাঁহার বুকের বাম পাশের উপরিভাগে বিদ্ধ হয় এবং গুরুতর জখম হয়। ১২নং আসামী মিয়া মোঃ মঞ্জুর আমার ভাইকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করিলে আমার ভাইয়ের পেটের বাম পাশের নাভির নিচে বিদ্ধ হয় এবং মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হয়। ১৩নং আসামী আমির হোসেন আমু তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আমার ভাইকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করিলে উক্ত গুলি আমার ভাইয়ের বাম হাতের বাহুতে বিদ্ধ হয়। ১৪নং আসামী মামুন তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আমার ভাইকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করিলে উক্ত গুলি তাঁহার পেটের বাম পাশে নাভীর নীচে বিদ্ধ হয়। আর একজন অজ্ঞাতনামা আসামী তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আমার ভাইকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করিলে উক্ত গুলি আমার ভাই-এর পেটের বাম পাশে নাভীর নীচে বিদ্ধ হয়। আমার ভাই চিত্কার দিয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িলে আশেপাশের লোকজন এবং জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের অস্থায়ী কার্যালয়ে থাকা লোকজন আসামীদের ধাওয়া করিলে আসামীরা ফাঁকা গুলি করিয়া ত্রাস সৃষ্টি করিয়া পূর্ব দিক দিয়া দৌড়াইয়া পালাইয়া যায়। সাথে সাথে আশেপাশের লোকজন দ্রুত আমার ভাই লোকমান হোসেনকে নিকটস্থ নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সংবাদ পাইয়া আমি লোকজনসহ দ্রুত হাসপাতালে যাই এবং আমার ভাইকে এ্যাম্বুলেন্সযোগে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়া যাওয়ার পথে আমার ভাই লোকমান হোসেন উপরোক্ত ঘটনা আমার নিকট বিস্তারিত বর্ণনা করেন। ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিত্সাধীন থাকা অবস্থায় রাত অনুমান ১০:৪০ ঘটিকায় আমার ভাই লোকমান হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর শাহবাগ থানা পুলিশ লাশের সুরতহাল তৈরী করে এবং ময়নাতদন্ত শেষে পরদিন লাশ নিয়া বাড়ী আসি। বৈদ্যুতিক আলোতে আশেপাশের লোকজন এবং দলীয় কার্যালয়ের লোকজন ঘটনা দেখে। আমার ভাই-এর দাফনকার্য সমাপ্ত করিয়া এবং শোকাহত থাকায় এবং আত্মীয়স্বজনদের সাথে আলোচনা করিয়া মামলা দায়েরে সামান্য বিলম্ব হয়।
অতএব, নিবেদন উক্ত এজাহারটি গ্রহণপূর্বক এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে মর্জি হয়।
নিবেদক : (মোঃ কামরুজ্জামান), পিতা-মৃত শাহনেওয়াজ মিয়া, সাং-১৩৯, বাসাইল, থানা ও জেলা-নরসিংদী। তারিখ : ০৩/১১/২০১১ইং

No comments

Powered by Blogger.