পেছন ফিরে তাকিয়ে ইতিহাস দেখা by রাহাত খান

গত ৫ সেপ্টেম্বর ছিল বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরগাড়িসহ পানিতে ডুবে (বলা যায় অপঘাতেই) মৃত্যু হয় তাঁর। আমি এই সুযোগে আল্লাহ রাহমানুর রাহিমের কাছে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।


আল্লাহ তাঁর কবরের শাস্তি যেন নিজ শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরবে মাফ করে দেন। তাঁকে যেন বেহেশত নসিব করেন।
দোষে-গুণে মিলিয়ে মানুষ। নবী-পয়গাম্বর এবং মহাত্মা ব্যক্তিবর্গ ছাড়া কোন মানুষ এই দোষ-গুণের উর্ধে নয়। সব মিলিয়ে বারো বছর অর্থমন্ত্রী হিসেবে দেশবাসীকে বারোটি বার্ষিক বাজেট উপহার দেয়া কোন গুণ কিনা জানি না, তবে একটা অসামান্য কৃতিত্বের রেকর্ড তো বটেই। প্রয়াত সাইফুর রহমান এই কৃতিত্বের অধিকারী নিঃসন্দেহে। তবে সাইফুর রহমান সম্পর্কে অনেকের মতো আমারও একটি ভিন্ন পর্যবেক্ষণ রয়েছে। সেটা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ হিসেবে বর্তমান প্রজন্মকে আর একবার স্মরণ করিয়ে দেয়া আর ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে সেই অপ-ইতিহাস তুলে ধরাটা কর্তব্য বলেই আমি মনে করি। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, সাইফুর রহমান তো একজন অর্থনীতিবিদ ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ হিসেবে তাঁর কিছু কাজ-কর্ম তুলে ধরার এই প্রয়াস কেন? উত্তরটা আমার বিবেচনায় খুবই সহজ। একজন রাজনীতি করা লোক হিসেবেই জিয়াউর রহমান এবং তাঁর স্ত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কেবিনেটে তিনি স্থান পেয়েছিলেন। তাছাড়া যে কোন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সেই দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসই প্রকারান্তরে। তেমনি অর্থনীতি ও রাজনীতির বাইরের কোন বিষয় নয়। মানুষের পরিচয় একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীব হিসেবে। রাজনীতির বাইরে অর্থনীতির কোন ঘটনা ঘটে না। অর্থনীতির বাইরেও ঘটে না রাজনৈতিক ঘটনা-দুর্ঘটনার কোন বহির্প্রকাশ।
সেজন্য সাইফুর রহমানের অতীত কিছু কর্মকা-কে রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ বলে অবহিত করতে চাই। আগেই বলেছি সাধারণ মানুষ দোষ-ত্রুটির উর্ধে নয়। তবে সাইফুর রহমানের মতো ‘কৃতী’ লোকেরা যখন অপকীর্তি করেও রেহাই পেয়ে যান, তখন সেসব অপকর্মে দৃষ্টান্তসমূহ প্রকাশ্যেই তুলে ধরা প্রয়োজন বৈকি। একান্তই প্রয়োজন। তিনি তাঁর সময়ের দাপুটে অর্থমন্ত্রী। বিএনপি বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতায় থাকাকালীন ‘একনেক’ বৈঠকে সভাপতিত্ব করতেন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। যে কোন অর্থনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একনেকই সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় প্ল্যাটফরম। একনেক বৈঠকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তা দিতেন না। হয়ত ক্ষমতা উপভোগের যে সুযোগ ও আনন্দ সেসব উপভোগ করার বদলে একনেকের বৈঠকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধৈর্য ধারণ করে বসে থাকার কোন অর্থ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খুঁজে পেতেন না। তাঁর পড়াশোনা কদ্দূর এর জবাবে নির্বাচন কমিশনের কোয়ারির জবাবে লিখতেন : তিনি স্ব-শিক্ষিত। স্ব-শিক্ষিতরাই প্রকৃত শিক্ষিত। দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি বুঝবেন এমন তো কোন কথা নেই। ফলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের একনেক বৈঠকে সাইফুর রহমানই সভাপতিত্ব করতেন।
এজন্য এবং অন্যান্য কারণে তাঁকে দাপুটে মন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করি। এই দাপুটে অর্থমন্ত্রী একবার কি এক জরুরী বৈঠক করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে যান। সাল-তারিখ আমার সঠিক মনে নেই। তবে সেটা বিএনপি-জামায়াত জোটের ২০০১-২০০৬ শাসন পর্বের শেষ বছর কিংবা তার আগের বছরের ঘটনা হবে। সেদিন মনে হয় সাইফুর রহমানের মন-মেজাজ তেমন ভাল ছিল না। অবশ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁর পুত্র তারেক রহমান ছাড়া সহকর্মী মন্ত্রী, আমলা এবং অন্য যে কারও প্রতি সাইফুর রহমানের ব্যবহার এ রকমই ছিল। তাঁর স্বাভাবিক মেজাজেও ধমক ও ভর্ৎসনা ছাড়া তেমন কিছুই পাওয়া যেত না। দাপুটে মন্ত্রীই বটে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বৈঠকে তাঁর যোগদানের প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম। সেদিন বৈঠকে যোগদান করার আগে ও পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর থেকে শুরু করে প্রায় সব উচ্চপদস্থ, নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি অভিধানের সেরা গালিগালাজগুলো তিনি যেভাবে অকাতরে বিতরণ করে ছিলেন সেটা অনেকের মতে দুর্লঙ্ঘ্য এক রেকর্ড। অমুকের বাচ্চা, তমুকের বাচ্চা, ইত্যাদি তাঁর স্বভাবসুলভ গালিগালাজ তো করছিলেনই, এছাড়া অমুক কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্মচারীদের বংশদ- দেয়ার হুঁশিয়ারিও দিচ্ছিলেন। একজন জিএমের ঘরে ঢুকে সাবেক অর্থমন্ত্রী দ্যাখেন জিএম সাহেবের একজন পিএস আছেন। ব্যস, এ নিয়ে জঘন্য সব কথা এবং অশোভন ও নোংরা সব গালি ঝাড়তে শুরু করেন অর্থমন্ত্রী। ‘বেচারা’ জিএমের তো ভয়ে আতঙ্কে মূর্ছা যাওয়ার দশা।
ঘটনা যখন ঘটছিল তখন সকাল ১০টা সাড়ে ১০টা হবে। আমি তখন বাসায়। অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। বাসার ডিজিটাল ফোনটা বেজে উঠল। ফোন ধরতেই প্রায় কাঁদ কাঁদ স্বরে এক ব্যক্তি নিজ পরিচয় গোপন করে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকে অর্থমন্ত্রীর এই ব্যবহার এবং গালিগালাজের তুবড়ি ফোটানোর ঘটনাগুলো জানালেন হয়ত এই ভেবে যে, আমি তখনকার সময়ে একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী পত্রিকার সাংবাদিক ছিলাম। আমি হয়ত ঘটনাটি কাগজে তুলে ধরব। তাতে আর কিছু না হোক, লোকে তো জানবে!
কিন্তু পরের দিন কোন জাতীয় পত্রিকায় এই ঘটনা নিয়ে এক লাইনের নিউজও ছাপা হলো না। নিজের অক্ষমতাজনিত অপরাধ স্বীকার করে নিয়েও বলছি, বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রতিশোধপরায়ণ এই অর্থমন্ত্রীকে ‘ভয়’ পেত না, এমন পত্রিকা বলতে গেলে প্রায় ছিলই না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নামে তোলপাড় হয় শুধু বেশিরভাগ সময় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। তা ছাড়া বিএনপি আমলে তো দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক হত্যা ইত্যাদি কিছুই হয় না। হয়? এই দুঃখ আর বর্ণনা করি না। বিএনপি-জামায়াত জোটের অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমানের আরও দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করে নিবন্ধ শেষ করতে চাই। উদ্দেশ্য? উদ্দেশ্য তো একটা আছেই। সেটা যথাসময়ই বলব।
একবার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের পেশ করা বাজেটের নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করে একটি জাতীয় পর্যায়ের দৈনিকে নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন শামস কিবরিয়া। তার জবাবে তখনকার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান কিবরিয়ার মতানৈক্যের জবাব না দিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে এমন একটি নিবন্ধ লেখেন যা রুচিহীন শুধু নয়, ক্ষমতার নির্লজ্জ প্রকাশও বটে। পড়াশোনায় কিবরিয়া সাহেব রহমান অবশ্য কম যান না। কিবরিয়া বরাবর প্রথম শ্রেণীতে প্রথম বা দ্বিতীয়। সাইফুর রহমানও কৃতিত্বের সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণী পেয়ে গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। শ্বশুরের অর্থানুকূল্যে বিলাত গিয়ে সিএ ডিগ্রী অর্জন করেন। প্রভাবশালী শ্বশুরবাড়ির পৃষ্ঠপোষকতায় মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরিও পান। তারপর পান স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের নেক নজর। অতঃপর অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন আপাতত আমার কাজ নয়। কিন্তু অতিশয় ভদ্র, মন্ত্রী হিসেবে দক্ষ, মানুষ হিসেবে নিরীহ শামস কিবরিয়াকে তাঁর লেখার জবাবে সাইফুর রহমান যে রুচিহীন এবং আপত্তিকর লেখাটা লিখিছিলেন, সেটা কদর্য বললেও বোধকরি কম বলা হয়। তদানীন্তন বিএনপির স্নেহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে শেকড়গাড়া জঙ্গীদের গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন শামস কিবরিয়া। দ্রুত তাঁকে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করালে তিনি হয়ত তখনকার মতো বেঁচে যেতেন। সিলেটের সন্তান অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সিলেটেরই আরেক সাবেক অর্থমন্ত্রী রক্তাক্ত ও মৃত-প্রায় শামস কিবরিয়ার জন্য সরকারী তরফ থেকে একটি হেলিকপ্টার পাঠিয়ে সহানুভূতির পরিচয় দিতে পারতেন! সাইফুর রহমান সেটা করা দূরে থাক, তার সরকারের তরফ থেকে জানিয়ে দেয়া হলো আহত কিবরিয়ার জন্য হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। সর্বজনবিদিত সন্ত্রাসীকে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে ঢাকায় আনার এবং ঢাকার সেরা হাসপাতালে চিকিৎসা করার দৃষ্টান্ত বিএনপি সরকারের রয়েছে। শুধু দেশের এক সেরা অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক অর্থমন্ত্রীকেই বিএপির তরফ থেকে কপ্টার পাঠানোই সম্ভব হয়নি!
সাইফুর রহমান এখন বেঁচে নেই। তাঁর উদ্দেশে কিছু বলা না বলা সমান কথা। তবু রাজনীতির ইতিহাসকে স্মরণ করে বলি, তিনি সেই অর্থমন্ত্রী যিনি কালো টাকা সাদা করেছিলেন দ- দিয়ে। শুধু তিনি নন, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁর প্রধানমন্ত্রী, তখন ক্ষমতায় না থাকা বেগম খালেদা জিয়াও একই সময় দ- দিয়ে কালো টাকা সাদা করেছিলেন। অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশ হলে শুধু দুর্নীতি নির্দেশনের এই কারণেই উভয়কে রাজনীতি থেকে কলঙ্কের বোঝা নিয়ে বিদায় নিতে হতো। কিন্তু আমরা বাস করি উদ্ভট এক গণতান্ত্রিক সমাজে। সাইফুর রহমান বেঁচে নেই, তিনি বেঁচে থাকলে কি বলতেন তা জানি না। জানা থাকলেও সেটা উহ্য রাখাই শ্রেয়। তবে দ- দিয়ে কালো টাকা সাদা করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইদানীং দুর্নীতি নিয়ে অহরহ বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। বলা নিষ্প্রয়োজন, দুর্নীতির অভিযোগ এনে কথা বলছেন তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে।
তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অবশ্যই ধোয়া তুলসী পাতা কিছু নয়। তাঁর প্রতিপক্ষ বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী, উপদেষ্টার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে হৈচৈ ফেলে দেয়া হলমার্ক দুর্নীতির ঘটনায় জিয়া পরিষদ করতেন এমন একটা সিন্ডিকেটের নাম যেমন আলোচিত-পর্যালোচিত ও নিন্দিত হচ্ছে, তেমনি দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে বর্তমান সরকারের একাধিক উপদেষ্টার নাম। একজন উপদেষ্টা তো টাকার জন্য সবই করতে পারেন। জামায়াতের লোককে আওয়ামী লীগের লোক বানিয়ে ফেলতে পারেন, তেমনি আওয়ামীপন্থী লোককে অবাঞ্ছিত করতেও খুবই পারদর্শী তিনি। দুর্নীতি দুর্নীতিই। আজ কিংবা কাল এর উদঘাটন হবেই। বেরিয়ে যাবে দুর্নীতির সত্যাসত্য।
সেদিকের বিচারে যে কেউ দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজের বিপক্ষে কথা বলতেই পারেন। তবে যাঁর আমলে দুর্নীতি একটা ভয়াবহ মহামারীর পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, দুর্নীতি দমন কমিশনকে কয়েকবার নানা চাকরি থেকে রিটায়ার করা তিন বৃদ্ধ ব্যক্তির চা-কফি পান এবং তর্ক বা আড্ডা দেয়ার একটা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছিল, সেই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কথা বলার আগে নিজ সরকারের দুর্নীতি সংক্রান্ত রেকর্ডটি মনে রাখা উচিত।
তবে সেটা বক্ষ্যমান নিবন্ধের জন্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। ভিন্ন বিষয়। এই বিষয়ে প্রয়োজনে দেশী-বিদেশী পরিসংখ্যান তুলে ধরে কাল কিংবা পরশু কথা বলা যাবে। তাড়াহুড়া করার কিছু নেই। নির্বাচন এখনও এক বছর এবং পাঁচ মাস দূরে।
বরং যা বলছিলাম, সেই প্রয়াত সাইফুর রহমানের কথাই বলি। দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০১-২০০৬) ক্ষমতাসীন হওয়ার কিছুদিন পর তিনি এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া গিয়েছিলেন ভৈরবে, ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর ওপর নির্মিত নয়নাভিরাম সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে জনসাধারণের জন্য খুলে দিতে। সেতুর সম্পূর্ণটাই সেসময়কার সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের তৈরি। সেতুর নামও দেয়া হয়েছিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু। প্রতিপক্ষ সরকারের করা সেতু, বিমানবন্দর, স্থাপনা ইত্যাদির নাম বদলে দেয়াটা বিএনপির খুবই প্রিয় কাজ। এক্ষেত্রেও তারা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু নামটা বদলে দিয়ে সেতুর নামকরণ করেন ভৈরব সেতু। একজন সাংবাদিক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে প্রশ্ন করে বসেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর নাম বদলে ভৈরব সেতু করা হলো কেন?
প্রশ্ন শেষ করার আগেই প্রায় গর্জে উঠলেন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। হু ইজ সৈয়দ নজরুল ইসলাম? আমরা তাঁকে চিনি না!
সৈয়দ নজরুল ইসলামকে চেনেন না সাইফুর রহমান। তাদের বিএনপি-জামায়াত জোট। কথা শুনে স্তম্ভিত না হয়ে পারা যায় না। জাতির পিতা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডান হাত, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বীর বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সংগঠক ও মহানায়ক সৈয়দ নজরুল ইসলামকে চেনেন না সাইফুর রহমান। দম্ভের সঙ্গে গর্জে উঠে বলেন : হু ইজ সৈয়দ নজরুল ইসলাম। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে এমন ধারায় কথা বলা তো শুধু বেয়াদবি নয়, শুধু অমার্জনীয় ধৃষ্টতা নয়, এমন ধারা উক্তিকে বলতে হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতা। শুধু পাকিস্তানের পক্ষেই এ রকম অমার্জনীয় ধৃষ্টতা প্রকাশ করা সম্ভব। অবশ্য বিএনপি-জামায়াত তো জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে নামেমাত্র বাংলাদেশ রেখে পাকিস্তানীকরণের রাজনীতিই করে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ সজ্ঞানে এবং সচেতনভাবে। পাকিস্তান একটি প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। জঙ্গী-সন্ত্রাসী লালন-পালন ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে সারা বিশ্বে। কিন্তু তাতে কি, বিএনপি-জামায়াত জোট বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার পাকিস্তানী এজেন্ডাই বাস্তবায়িত করতে চাইছে। সাইফুর রহমানের সেদিনের সেই গর্জে ওঠা ভাষায় ‘হু ইজ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আমরা তাকে চিনি না’ উক্তিতে তাই বিস্মিত হই না। শুধু ভাবি, কতটা দৃষ্টতাপূর্ণ কথা বলতে পারলেন হিসাবরক্ষক (চার্টার্ড এ্যাকাউন্ট্যান্ট) থেকে অর্থমন্ত্রী হওয়া একটা মানুষ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যাঁর সামান্যতম অবদান ছিল বলে জানা যায় না। সাইফুর রহমান আজ মৃত। তবে মৃত সাইফুর রহমানের এই পাকিস্তানপ্রীতি, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাবিরোধী উক্তি ‘মরবে’ না কোনদিন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই অমার্জনীয় বেয়াদবির খতিয়ান থেকে যাবেÑকোন সন্দেহ নেই তাতে।
লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.