আমার নয়ন-ভুলানো এলে by আবদুশ শাকুর

বর্ষা বিদায়ের পরই মনোহর রূপে হাজির হয় শরৎ। আকাশে পেঁজা তুলোর মতো ভেসে বেড়ায় মেঘ। নদীর দুধার ভরে ওঠে কাশফুলে। এই মনোমুগ্ধকর রূপে মোহিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দসহ আরও কত শত কবি-সাহিত্যিক-চিত্রকর।


রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
‘এক মুহূর্তের জন্য প্রগাঢ় সুখ অনুভব করিলে, সেই মুহূর্তকে যেমন আর মুহূর্ত বলিয়া মনে হয় না— মনে হয় যেন তাহার সহিত অনন্তকালের পরিচয় ছিল, বোধহয় আমারও সেইরূপ এক শরৎকাল রাশীকৃত শরৎ হইয়া উঠিয়াছে। আমি সেই শরতের মর্মের মধ্য দিয়া যেন বহুসহস্র সুদূর শরৎপরম্পরা দেখিতে পাই—দীর্ঘ পথের দুই পার্শ্ববর্তী বৃক্ষশ্রেণী যেমন অবিচ্ছিন্ন সংহতভাবে দেখা যায়, সেইরূপে— অর্থাৎ সবসুদ্ধ মিলিয়া একটা নিবিড় শারদ আনন্দের ভাবরূপে। আমার মনে হয় স্বভাবতই শরৎকাল স্মৃতির কাল এবং বসন্ত বর্তমান আকাঙ্ক্ষার কাল। বসন্তে নবজীবনের চাঞ্চল্য, শরতে অতীত সুখদুঃখময় জীবনের পূর্ণতা। বাল্যকাল না গেলে যেন শরতের অতলস্পর্শ প্রশান্তি অনুভব করা যায় না।’ (আশ্বিন সপ্তমীপূজা ১৮৮৯, পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তক)।
আমার মনেও ষড়ঋতুর মধ্যে স্মৃতির কাল হিসেবে জেগে আছে বাংলার তৃতীয় ঋতু—ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল। বাংলায় এই ঋতুটি স্মৃতির তীরে নিয়ে আসে বর্ষাকালটিকেও। কারণ, বর্ষার গমনের জন্য অপেক্ষমাণ এ ঋতুটি যেন শেষবর্ষার ধারাজলে সদ্যস্নাতা কিশোরীরূপেই আবির্ভূত হয় একসকালে, আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকালের অবসানে। রাশভারী বর্ষার অনুগামিনী শরৎ চপলা চঞ্চলা—লুকোচুরি খেলাই যার স্বভাব। রবীন্দ্রনাথের গানেও তাই বর্ষার ফুল যূথিকা আর শরতের ফুল শেফালিকা আসে এক নিঃশ্বাসে:
মেঘের দিনে শ্রাবণ মাসে যূথীবনের দীর্ঘশ্বাসে
আমার-প্রাণে সে দেয় পাখার ছায়া বুলায়ে\
যখন শরৎ কাঁপে শিউলিফুলের হরষে
নয়ন ভরে যে সেই গোপন গানের পরশে।
শরতের সঙ্গে পরিচয়ের সেই প্রথম সকালটি আমার মনে এতকাল পরেও অম্লান আছে। মনে আছে, সকালটিকে কিশোরকালে গ্রামে দেখেছিলাম বলে—তাও বাগানবাড়ির নারিকেল-সুপারির সারি সারি গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে। না, নগরের জানালার গরাদের ফাঁক থেকে এই অপরূপ ঋতুটির রূপের লীলা পূর্ণ প্রেক্ষায় দেখা যায় না। এ ঋতুর প্রতীক শিউলি ফুলটির অলৌকিক মহিমাও শহরের কিচেন-গার্ডেনে বোঝা যায় না। বিদ্যুৎবাতি আর পাষাণের মাঝখানে জ্যোৎস্না তো শরমেই লুকায়। অথচ শরদিন্দুর আলোতেই শিউলি হয়ে ওঠে অপরূপ। এ কারণে ‘শিউলি’ নামটিও স্নিগ্ধতার প্রতীক। তাই বাহিরের মতো বাঙালির ঘরেও এত শেফালি আর এত শিউলি।
ও হ্যাঁ, এমন একটি লীলাময়ী ঋতু আর তার কুলতিলক শিউলি ফুলটিকে আমার বোধে ঠিক কোন প্রহরে পেয়েছিলাম শিশির-ভেজা স্নিগ্ধ সবুজ গ্রামীণ পটভূমিতে? সকালবেলায় আলো ফুটে ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠেই। উঠোনে বেরিয়ে দেখলাম—শেফালি বৃক্ষের শাখায় শাখায় কত রকমের সুন্দর ভঙ্গিমায় ফুটে আছে শিউলি। তরতাজা নবীন বয়সেই তাড়াহুড়া করে তারা একে একে ঝরে পড়ছে—যেন সবংশে আত্মহত্যার লগ্ন বয়ে যাচ্ছে তাদের।
অপটু কণ্ঠে গেয়ে উঠলাম রবীন্দ্রনাথের শরৎ-পর্বের একটি গানের কলি:
আমার নয়ন-ভুলানো এলে,
আমি কী হেরিলাম হূদয় মেলে\
শিউলিতলার পাশে পাশে ঝরা ফুলের রাশে রাশে
শিশির-ভেজা ঘাসে ঘাসে অরুণরাঙা চরণ ফেলে
নয়ন-ভুলানো এলে\
নয়ন-ভুলানো শরৎ আমাকে যেন ঘুমের ঘোরেই নিয়ে গেল উঠানের পরে বাগান ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত এক উজ্জ্বল সবুজের সাগরে—আদিগন্ত ঢেউ খেলানো ধানের খেতে। খেতের আলের শিশির-ভেজা নরম ঘাসে পা রাখতেই কণ্ঠে এল শরতের আরেকটি গানের কলি:
আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা—/ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই—লুকোচুরি খেলা\
এই নতুন ঋতুবোধে উদ্দীপ্ত আমি অভিজ্ঞতাটির কথা সবিস্তারে বলার মতো যথাযোগ্য লোক পেয়ে গেলাম পরদিন শনিবারেই, যখন সাপ্তাহিক ছুটিতে জেলা শহর থেকে বড় ভাই বাড়ি এলেন। শুনে তিনি বললেন, এটা শরৎকাল—যেটা ভারী বর্ষণের এই উপকূলীয় জেলায় খুবই উপভোগ্য হয়। তবে এর শ্রেষ্ঠ জেল্লা চন্দ্রালোকের শিউলি ফুলে নয়, দিবালোকের কাশফুলে। শুনেই আমি বায়না ধরলাম—কাশফুল আমাকে এখনই দেখাতে হবে। ভাই বললেন, এ ফুল আমাদের বাড়ির কাছে-ধারে কোথাও নেই। এটা ফোটে প্রধানত চরাঞ্চলে আর নদীর জলের খালের ধারে।
আমার মন ভেঙে যেতে দেখে মা বললেন—একে নিয়ে কাল আমাদের বাড়ি বেড়িয়ে আয় না। সেই বাড়ির পেছনের বাগানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের খালের ধারটা এ সময় ভরে থাকে কাশের ফুলে। সে দৃশ্য দেখার জন্য আমাদের ছোটবেলার সব খেলা দক্ষিণের বাগান থেকে চলে যেত পশ্চিমের বাগানে। পরদিন দূরবর্তী মামাবাড়ি গিয়ে দেখা কাশফুলের স্বর্গীয় দৃশ্যটি বিরল ক্ষণে আজও আমার মনের দৃষ্টিগোচর হয়।
তবে শরতের সেরা ডালি কাশফুলকে আমি পরিপূর্ণরূপে পেয়েছি অনেক পরে, আরেকটি উপকূলীয় জেলা নদীবহুল পটুয়াখালীর প্রশাসক থাকাকালে—খালের পাড়ে, বিলের ধারে, চরের কিনারে। সেই শারদীয় দৃশ্যটি যেন আদৌ এই লোকের ছিল না, ছিল অমর্ত্যলোকের। কাশের এক জাতভাইয়ের নাম কুশ। কুশও শরৎকালেই ফোটে। তবে বাংলাদেশে কুশ খুব কম বলে সর্বত্র দ্রষ্টব্য কেবল কাশই। ঘাসের মতো দেখতে, এই পূতপবিত্রদর্শন উদ্ভিদটি আখের মতো লম্বা হয়। কাশকে চেনা যায় পাতার ধার দেখে। কারণ, কুশপাতার গায়ে কোনো ধার নেই।
কাশফুল ফোটে শরতের শুরুতেই। সাদা মেঘের ভেলার তলে দীর্ঘ কঞ্চির মাথায় কাশফুলের সাদা ঢেউ শরতের একক বৈশিষ্ট্য। থোকা থোকা ছোট-বড় সাদা মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ। মাঝে মাঝে ক্ষণস্থায়ী বৃষ্টি ফেলে সেই মেঘ হয়ে যায় আরও হালকা, আরও সাদা। তারই ছায়া পড়ে নদীর ধারের কাশফুলে। সঞ্চরমাণ হালকা মেঘে ছাওয়া প্রগাঢ় নীল আকাশতলে কাশফুলের ছায়া পড়ে বর্ষাশেষের নদীগুলোর ভরা জলে।
ধবধবে সাদা মেঘের পটভূমিতে শরতের আকাশ আশ্চর্য উজ্জ্বল দেখতে। আকাশের পাল তোলা মেঘের বিপরীতে নদীনালার পাল তোলা নৌকা। এমনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ক্যানভাসে ধবধবে সাদা কাশফুল দুলে দুলে জলভরা নদীর কূলে কূলে দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে একসময় হারিয়ে যায় ঘুম ঘুম অস্পষ্ট স্বপ্ন ছড়িয়ে। গোটা অভিজ্ঞতাটাই যেন চেনা-জানা এই মর্ত্যলোকের নয়। নিসর্গবিদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া তাঁর বিখ্যাত গাছপালা তরুলতা গ্রন্থে লেখেন জীবনানন্দ দাশ কাশবনে দেখেছেন আকাঙ্ক্ষার রক্ত:
সেই কুহকের থেকে এসে/রাঙা রোদ, শালিধান, ঘাস, কাশ, মরালেরা বার-বার রাখিতেছে ঢেকে/আমাদের রুক্ষ প্রশ্ন, ক্লান্ত ক্ষুধা, স্ফুট মৃত্যু—আমাদের বিস্মিত নীরব/রেখে দেয়— পৃথিবীর পথে আমি কেটেছি আঁচড় ঢের, অশ্রু গেছি রেখে:/তবু ঐ মরালীরা কাশ ধান রোদ ঘাস এসে-এসে মুছে দেয় সব।
শরৎকালের একটি গানে রবীন্দ্রনাথও গেয়েছেন: আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা—/নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা\/এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,/এসো নির্মল নীলপথে,
তবে তাঁর খাম্বাজ রাগে এবং দাদরা তালে বাঁধা এই গান ছিল আমার ছাত্রজীবনের প্রিয়তম:
শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি।
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি\
শরৎ, তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে
বনের-পথে-লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হূদয় ওঠে চঞ্চলি\...
শিউলিবনের বুক যে ওঠে আন্দোলি\
শিউলি ফুলটির রং অনুজ্জ্বল হলেও কমলার সঙ্গে সাদার মিশ্রণ বড়ই মধুর সুন্দর, গন্ধও তেমনি মন্দমধুর। ফুলটির বড়ই তাড়াহুড়া। সমস্ত বিশ্বসংসার যেন স্বল্পায়ু এই গন্ধবিধুর ফুলটির প্রতি অধীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে—তাই তার ক্ষুদ্র মুখখানির প্রস্ফুটিত লাজুকতার ভাগ বিলাতে হবে সবাইকে। সে কারণেই তার ফোটামাত্রই ঝরে পড়ে বিদায় হওয়া। আসলে শরতের প্রতীক শিউলি ফুলের সূর্যাস্তের পরে ফোটা এবং সূর্যোদয়ের আগে ঝরার কারণ আরও অনেক গভীরে এবং অজানা অতীতে নিহিত, যা ব্যাখ্যাত আছে গ্রিসের ও ভারতবর্ষের পুরাণকথায়।
শেফালির বৈজ্ঞানিক নাম নিক্ট্যান্থাস আরবরট্রিসটিস। নিক্ট্যান্থাস মানে ‘রাতের ফুল’, আরবরট্রিসটিস অর্থ ‘বিষাদিনী তরু’। এই নামকরণের পেছনে একটি প্রাচীন উপকথা আছে। অসাধারণ লাবণ্যময়ী এক গ্রিক রাজকন্যা ভালোবাসল উজ্জ্বল সূর্যকে। কিন্তু মন ভরে ভোগ করে প্রেমাস্পদ তার থেকে মুখ ফেরাল। লাঞ্ছিতা রাজকন্যা এমন অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করল। তার কবর থেকে বেরোল একটি পুষ্পবৃক্ষ। গাছটির শাখায় শাখায় ফুলে ফুলে ফুটে উঠল বিষাদিনী রাজকন্যার যত দুঃখ। রবি-প্রেমিকার অকৃত্রিম প্রেমের সব সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হলো ফুলটির বর্ণে-গন্ধে-লাবণ্যে। কিন্তু সে ফোটে কেবল সূর্যাস্তের পরে এবং ঝরে সূর্যোদয়ের আগে—যেহেতু প্রতারক সূর্যকে সে সইতে পারে না। এই গ্রিক রূপকথাটির ভারতবর্ষীয় ভাষ্যটি পাওয়া যাবে শিবকালী ভট্টাচার্য রচিত চিরঞ্জীব বনৌষধি শীর্ষক গ্রন্থে।
ঝরা শেফালির আস্তরণে গাছতলার মাটি ঢাকা পড়ে যায়। কমলা রঙের বোঁটা ওপর দিকে থাকে, নিচের দিকে থাকে শুভ্র পাঁচটি যুক্ত পাপড়ি। সূর্যোদয়ের পরও কিছুক্ষণ তার মিষ্টি-মধুর সুগন্ধ অবশিষ্ট থাকে। সম্ভবত সূর্যের স্মরণার্থেই। শিউলি বড় দুঃখময়ী। নজরুল তাঁর গানে ‘সন্ধ্যায় ফোটা ভোরে ঝরা’ শিউলির দুঃখের গাথা গেয়েছেন—‘তোমারি অশ্রু জলে শিউলি-তলে সিক্ত শরতে/ হিমানীর পরশ বুলাও ঘুম ভেঙে দাও...’।

আমি তখন সদ্য শহরবাসী গ্রামীণ কিশোর, যার মন বসে না শহরে। মন বসানোর জন্য আমার প্রথম শহুরে বন্ধু আজিমপুর কলোনির ৪২ নম্বর বিল্ডিংয়ে তার বাসা থেকে বেরিয়ে আমাকে নিয়ে ১৬ নম্বর বিল্ডিং পর্যন্ত চক্কর দিত। কারণ, সেকালে কেবল কলোনির জানালাতেই কিছু কুমারী-মুখ ফুটে থাকত। হাঁটতে হাঁটতে সে আমাকে শহুরে জটিল গল্প শোনাত। আমার কাছে কেমন বিদঘুটে মনে হতো। কিন্তু আমার গ্রামীণ সরল গল্প শুনে সে মুগ্ধ হতো—বিশেষ করে সেই প্রথম দেখা শরৎ আর শিউলির গল্প। এতখানি যে সে আমার গ্রাম দেখতে অধীর হয়ে উঠল।
অবশ্য না বুঝে একটু ইন্ধন আমিও জুগিয়েছিলাম। জানালার কুমারী ফুল দেখতে দেখতে একদিন সে বলল, তার ভেতরে কী যেন কী ফুটে উঠতে চাইছে। আমি বললাম, ওটা কবিত্বের ফুল। ওটিকে পূর্ণ ফোটাতে হলে প্রকৃতির ইন্ধন লাগে। কিন্তু প্রকৃতির আসল রূপ তো শহরে নেই, আছে গ্রামে। তা হলে তো এই শরৎকালটা থাকতেই তোদের গ্রামে যেতে হয়। অতঃপর তাকে বিরত করতে রীতিমতো তর্কই বেধে যায়। সারা জীবন শহরে মানুষ। অনুষঙ্গটি ওর অনভিজ্ঞ ধারণায় অতিশয় মধুর হলেও আমার অভিজ্ঞ চেতনায় নেহাতই অস্বস্তিকর।
তাই প্রথমেই আমি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলাম: বাংলা কবিতায় তুমি যে শরতের সাক্ষাৎ পাও, বাংলার পল্লিতে তার দেখা পাবে না কোথাও। বান-তুফান, বজ্র-বিদ্যুৎ, অভাব-অনটন, তাল পাকানো তাপ আর বর্ষার ঘা শুকায়নি—এমন সব পথঘাট ইত্যাদির নামই শরৎকাল। তবে হ্যাঁ, কেবল সদ্যস্নাত একখানি তকতকে আকাশই পেতে পারো ঝকঝকে রবিকর আর স্যাঁতসেঁতে শশিকরসমেত—তা-ও আবার একবার বেজার হলেই ঝঞ্ঝার ঝঙ্কার। উপরন্তু শরতের গ্রামবাংলা শুধু একতাল থিকথিকে কাদাই নয়, ঘিনঘিনে পোকা আর জলৌকায় মিলে জঘন্য এক জেলখানাও বটে।
হায়, কবির প্রতিক্রিয়া অতিশয় সরল—তবে হেমন্তেই সই। তুই-ই তো বলিস এদেশি বসন্তের কী আর এমন ঐশ্বর্য! চটকদার কয়েকটি জনপ্রিয় ফুল ফোটায়। এর বেশি কী আর আছে তার, গুচ্ছের গণহন্তারক হুল ছাড়া, যা সে বসন্তরোগীর অঙ্গে ফুটায়। আসলে আমাদের কবিরা কেবল শোনেন, দেখেন না; পড়েন, নড়েন না; বোঝেন, খোঁজেন না। তাঁরা শুধুই কবি, জহুরি নন—তাই হেমন্ত চেনেন না। কবিকুলের রবিরও আমি এই একটিই খুঁত বের করেছি যে তাঁর হেমন্তের গানের ডালি তিক্ত গ্রীষ্মের চেয়েই শুধু নয়, রিক্ত শীতের চেয়েও নিঃস্ব। যা হোক, হেমন্ত আসা পর্যন্ত শহুরে কবিবরের গ্রামে যাওয়ার বাসনাটা বাঁচেনি।
এ বড় সৌভাগ্য যে আমার কৈশোরটা কেটেছে জন্মজেলা নোয়াখালীতেই। অন্যথায় বাংলার বিশিষ্ট এই ঋতুটিকে ওই বয়সে বোধের গভীরে এমন করে অনুভব করতাম কি না, জানি না। উপকূলীয় জেলাটিতে শরৎকাল তার বিশিষ্ট রূপটিসহ অমন করে চোখে পড়ে—সেখানকার ভরাট বর্ষার প্রবল বৃষ্টিপাতের অন্তে আসে বলে। নোয়াখালীর বর্ষার ছিল অপরূপ রূপ। দুপুরের রৌদ্রের তাপ না পড়তেই ঘনঘটায় পরিণত হতো চারপাশ থেকে আসা অপরাহ্নিক খণ্ড মেঘের কোলাজ। অতঃপর জড়ো হতে থাকত একের পর এক নীরদপুঞ্জ। কথায় কথায় ঢেকে যেত আকাশ, ঝিলিক দিয়ে উঠত বিদ্যুতের রেখার পর রেখা—ছড়িয়ে পড়ত এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত। গুরু গুরু গর্জনে জমে উঠত বরুণদেবের দিবারাত্রির মাজমা।
বাতাস উদ্দাম হয়ে নারকেল-সুপারির মাথা নুইয়ে দিত, আলুথালু করত তাদের সুবিন্যস্ত কেশরাশি। অনেক নরম গাছের ডাল ভেঙে, পাতা ছিঁড়ে, ফুল উড়িয়ে নিয়ে ছড়িয়ে দিত ঘাটে, মাঠে, বাটে আর সাদা মাটির রাস্তার বুকের ওপরে। সে এক লন্ডভন্ড কিন্তু প্রচণ্ড সুন্দর দৃশ্য রচিত হয়ে যেত চোখের পলকেই। ডাল, পাতা, ফুল—সবই তালগোল পাকিয়ে ঘুরতে থাকত ছোট ছোট ঘূর্ণিতে। সে দৃশ্যও ছিল বড়ই মনোহর, অন্তত আমার প্রাণোচ্ছল কৈশোরবীক্ষণে।
তারপর আসত টপটপ করে বড় ফোঁটার বৃষ্টি এবং দেখতে দেখতে সৃষ্টি হয়ে যেত মোটা মোটা ধারার—এককথায় যাকে বলে মুষলধারা। সঙ্গে চলত প্রথমে সুমধুর মেঘগুড়গুড়, পরক্ষণেই কর্ণবিদারী বজ্রনির্ঘোষ। আকাশজুড়েই চলত বিদ্যুৎকটাক্ষ, দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ত বিদ্যুৎমালা। তীক্ষ আলোকরেখায় চৌচির হতো কৃষ্ণাম্বর, আর তার তলায় মুহুর্মুহু বজ্রাঘাতে কম্পমান হতে থাকত সন্ত্রস্ত পৃথ্বী।
মাঝেমধ্যে ঝড়-তুফানের বায়ুসেনারা ছত্রীসেনার মতো আকাশের সব প্রান্ত থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ত আমাদের গাছগাছালির শান্তির নীড়টির ওপর। তার পরই শুরু হতো বিমানসেনাদের হানা বরুণবাণ—নিষ্কৃতিহীন, বিরতিহীন ও শেষহীন। গাছের মাথার ওপর দিয়ে, মাঠের খোলা বুকের ওপর দিয়ে, আমাদের বাড়ির চারপাশের দিঘিসমান পুকুরগুলোর দোলা লাগা বুকের ওপর দিয়ে অজস্র ধারায় ছুটে আসত বৃষ্টি, দূরের আকাশ থেকে, কাছের গাছ থেকে। একসময় আচমকাই থেমে যেত। ততক্ষণে আনচান করে উঠত আমার কিশোর মন-প্রাণ, হয়তো বা অকালীন প্রেমেই ভরে উঠতে চাইত প্রকৃতির প্ররোচনায়।
সারা দিনের ঘন অন্ধকার রাত্রিশেষে একসময় পশ্চিমের পড়ন্ত রৌদ্রের ঝলক ঝিকমিক করে হেসে ছড়িয়ে পড়ত, হয়তো বা সারা দিনের বিমর্ষ পৃথিবীটাকে বিদায়ী করমর্দনস্বরূপ দিবসের শেষ আলোর রেশটুকু দেখিয়ে পরের দিনটির জন্য সামান্য ভরসা দিয়ে যাওয়ার জন্য। তখন আবার ঘাসের ডগায় জলবিন্দুতে লেগে যেত সোনার আভা। পরের সকালে আলো ফুটলেই দেখা যেত আগের বিকেলের বর্ষাস্নাত গাছপাতা, নারকেল বন, মাঠের ঘাস আরও শ্যামল রং আরও সুচিক্কণ হয়ে উঠেছে! এই উপকূলীয় জেলায় রুদ্র বৈশাখও গৈরিক সন্ন্যাসী নয়—শ্যাম সুশোভন। আমাদের এই গ্রামে আষাঢ়ের আগেই এসে যায় বর্ষা। আবার আশ্বিনের আঙিনা ছাড়িয়ে কার্তিকেও এখানে শেষ হতে চায় না শরতের এলোমেলো বরিষণ।
এই শ্যামল দক্ষিণ বাংলার লবণার্দ্র ভূমিতে ঝাউ আর নারকেলই সুন্দরতম উদ্ভিদ। ঝাউয়ের মাথায় বাতাসের গুঞ্জন, ক্রন্দন, এবং দীর্ঘশ্বাস। নারকেলের পাতায় বাতাসের খেলা, সূর্যের রশ্মি আর চন্দ্রের রজতবৃষ্টি—এ না দেখলে বাংলাদেশ দেখা সম্পূর্ণ হয় না। সে অর্থে বলতে গেলে উত্তরবঙ্গের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার মুখ দেখেননি, যেমন দেখেছেন দক্ষিণবঙ্গের জীবনানন্দ দাশ।

গোপাল হালদার রূপনারাণের কূলে নামক স্মৃতিকথায় তাঁর ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত দেখা ‘আশ্চর্য নোয়াখালীর নদীর “শর”’ শিরোনামক অধ্যায়ে লিখেছেন, নোয়াখালীর বাগ্রীতিতে নদীতে বান ডাকে না, ‘শর’ আসে। আমার মতে, নোয়াখালীর ‘বান’ ধ্বনিসাম্যে ‘বাণ’ আর অর্থসাম্যে ‘শর’ হয়েছে—কারণ ওই তুলনারহিত ‘শর’ সমুদ্রদেবতা বরুণদেবের স্বহস্তে নিক্ষিপ্ত ‘বরুণবাণ’। নোয়াখালীর উপকূলীয় মেঘনার মোহনায় শরতের এই ‘শর’ অদ্ভুত এক ভয়ংকর কাল।
আমি প্রথম ওই দুর্ধর্ষ শর দেখেছিলাম আমার গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের নদীর ধারে সদলবলে গিয়ে, চাপরাশির হাট মাইনর স্কুলের ছাত্র থাকাকালে। প্রকৃতির ওই রুদ্ররোষটি দেখতে স্কুলটি ছুটি দিয়ে দিত প্রতিবছরই ভাদ্র মাসের অমাবস্যার আগের দিনটিতে শর দেখার জন্য। ওই দিনটিতেই নাকি বছরের সবচেয়ে বড় ‘শর’ আসে। শর দেখাটা ছিল মুক্ত প্রকৃতির রুদ্রসুন্দর রূপ দেখিয়ে ছাত্রদের নিসর্গমনস্ক করে তোলার একধরনের ব্যবহারিক ক্লাস।
শরতকালের প্রথম মাসের এই রূপটি জবর ভয়ংকর হলেও অপূর্ব সুন্দরও বটে। কিন্তু দ্বিতীয় মাস আশ্বিনের বর্ষসেরা ঝড়-তুফান তো শুধুই ভয়ংকর। সেই ঝড়ের ঝাপটা আমাদের উঠানের সামনের সবচেয়ে লম্বা নারকেলগাছটির ঝাঁকড়া মাথাটিকে নুইয়ে বাসঘরের সিঁড়ি ছুঁইয়ে—শারদ তাণ্ডবদর্শনে কৌতূহলী এই কিশোরটিকে যেন কুর্নিশ করাত। আমাদের গ্রামের দক্ষিণের নদীটিকে সংজ্ঞামতে নদী বলা যায় না, কারণ তার ওপার নেই—ওপারে আছে উপসাগর আর মহাসাগর। বস্তুত ওটা ছিল মেঘনা নদীর মোহনা, যার শহরপার্শ্বস্থ অংশের স্থানীয় নাম ‘জালছিঁড়া’। কারণ সেখানে স্রোতের তোড়ে জেলেদের বড় বড় ফোকরওয়ালা জালও ছিঁড়ে যেত।
জোয়ার আসত পুব দিক থেকে। আকাশের নীলের নিচে দেখা যেত প্রথম আভাস, অতি ক্ষীণ সাদা রেখা। শোনা যেত ক্ষীণ দূরাগত শব্দ। অনেক আগেই পাওয়া যেত সেই শরের সুদূরাগত হুহুংকৃত ঘোষণা—‘শর’ আসছে। মিনিট দশেক যেতে না যেতেই সেই শব্দ হয়ে উঠত দুন্দুভি, তার পরে ঢক্কানিনাদ। সেই সাদা রেখাটি আসলে একটা ঘনকৃষ্ণ উঁচু ঢেউয়ের মাথায় ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে পড়া সফেন হাস্য, যা মুহূর্তে হয়ে উঠত লক্ষ দানবের সখেদ অট্টহাস্য। শত শত দর্শকের মুখে তখন কেবল তিনটি শব্দ উচ্চারিত হতো—‘শর আইয়ের্ রে’। একেকবার লোপ পায় শরের ইস্রাফিলের শিঙার মতো বজ্রনিনাদ, আবার মাথা তুলে আরও উগ্র হয়ে ওঠে চলমান সেই ক্রূর ভ্রুকুটি।
আবার পরক্ষণেই তার মাথায় দেখা দেয় সাদা ফেনার রাশি। কী দুর্বার যে তার গতিবেগ, তা বোঝা যায় যখন ‘শর’টি কাছে এসে পৌঁছায়। অথচ আসছে সে যেন অনাদিকাল থেকেই, গুরু গর্জনও ক্রমেই বাড়ছে যেন অনন্তকাল যাবৎ। আসলে ‘শর’ নামক অতিপ্রাকৃতিক এই আগন্তুকের বিলম্বিত আগমনের ক্রমবর্ধিষ্ণু লয়ের মাত্রায় মাত্রায় তার ভয়ংকর রূপটি কেবলই প্রত্যক্ষ হচ্ছে। প্রতিটি ক্ষণেই তার সংক্ষুব্ধ গর্জন মহাপ্রলয়ের মতন আর সব শব্দকে ঢেকে দিচ্ছে।
অবর্ণনীয় সেই রুদ্র ভয়ংকরের রূপ, আর তার বিশ্ববিধ্বংসী গর্জন। ‘ওই, ওই, ওই’ উত্তেজিত কণ্ঠে অপেক্ষমাণ মানুষ চিৎকার করে ওঠে—‘শর, শর, শর’। এবার কিন্তু শর পলক ফেলতে না ফেলতেই এসে যাবে। এবং এসেই গেল অবশেষে—এসে গেল দোতলা-তেতালা সমান উচ্চ এক রুদ্র ঘনকৃষ্ণ তরঙ্গ—যেন এখনই তার তলায় সবকিছু চূর্ণবিচূর্ণ-লীন-বিলীন হয়ে যাবে।
তবে সবকিছুর ওপর শরের অশ্রুতপূর্ব গর্জন আর দুরন্ত দুর্দম গতি। পাড়ে দাঁড়ানো মানুষগুলো সবাই এই অতিপ্রাকৃতিক লীলাদর্শনে অভ্যস্ত, তবু অলৌকিক উত্তেজনায় সবাই অস্থির। কারণ তারা যে এখনই অজ্ঞাত চেতনার অস্পষ্ট অনুভবে অভিভূত হবে, বোধ করবে এক সশঙ্ক বিস্ময়। কীভাবে বোঝানো যাবে এই অলোকসুন্দরের আবির্ভাব এবং অভিভব—যুগপৎ ভয় ও বিস্ময় জাগানো! মহাশক্তির এই অলঙ্ঘ্য শাসন স্রেফ অকল্পনীয়, অবর্ণনীয়, অবিস্মরণীয়!
একসময় দর্শকের চোখের ওপর দিয়ে পার হয়ে গেল যেন লক্ষ কোটি ঐরাবতের একই সঙ্গে উত্তোলিত গগনচুম্বী অগণন শুঁড়। এক নিমেষেই অবশ্য আমাদের পেরিয়ে চলে যায় সেই ‘শর’—পশ্চিমমুখী সমস্ত উপকূল উৎক্ষিপ্ত জলচ্ছটায় চুরমার করতে করতে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দুর্বার বিক্রমে গড়িয়ে আসে এমনি আরও কয়েকটি উগ্র তরঙ্গ, যেগুলোকে স্থানীয় লোকে বলে ‘পাঁচগড়িয়া’। যেন একদণ্ডের মধ্যে সম্পূর্ণ ভরে গেল নদীটির এক বছরের অপূর্ণ বক্ষ। অন্য কথায়—শারদীয় প্রথম অমাবস্যার জোয়ার এল।
সেই শর নোয়াখালী শহরে গিয়ে পৌঁছাবে দুপুর পেরিয়ে। তার আগেই ছুটি হয়ে যাবে স্কুল। অফিস-আদালতও যার যার পন্থায় যথাসম্ভব সময়মতো ছুটির ব্যবস্থা করে নেবে—কারণ শর দেখার নৈসর্গিক নিমন্ত্রণ রক্ষা না করে যে থাকা যায় না। অফিস-আদালতের সাহেবসুবোও এসে দাঁড়াবেন পিয়ন-পেয়াদার সঙ্গে ‘শর’ দেখতে। মেয়ে-পুরুষ, বালক-বৃদ্ধ—সাধারণ-অসাধারণ শর-দর্শনে সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে যাবেন।
কালো মেঘের বর্ষাশেষে সাদা মেঘের শরৎকাল সুন্দর আর ভয়ংকরের এক আশ্চর্য যুগলবন্দী।

No comments

Powered by Blogger.