ধর্ম- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা ও সুন্দর পোশাক পরিধান করা মানুষের জন্মগত স্বভাব। নিজেকে সুন্দর রাখার প্রথম এবং প্রধান উপায় হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা।


পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না রাখলে অনেক মূল্যবান জিনিসই মূল্যহীন হয়ে যায়। জীব-জানোয়ার ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য এটাই যে, পশুরা যেমন খুশি তেমন চলে, তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ধার ধারে না; আর মানুষ পরিচ্ছন্ন ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার বিষয়টিকে সাধারণত মানুষ স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করলেও ইমানদার মুসলমানেরা এটিকে ইবাদতরূপে গণ্য করে থাকেন। কেননা, হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের একটি অঙ্গ।’ (মুসলিম)
ইমানদার ব্যক্তিমাত্রই একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ। তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অঙ্গীভূত করে এটি নিয়মিত পালন করেন। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি কম করে হলেও প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের আগে পবিত্রতা অর্জনের জন্য অজু করেন। তিনি দৈনিক পাঁচবার অজু করার জন্য ১৫ বার হাত, পা, নাক, মুখ ও চোখ পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করেন। সময়মতো দিনে একবার গোসল করেন। পোশাক-পরিচ্ছদ সব সময় ধুয়েমুছে পরিষ্কার রাখেন। ইমানদার ব্যক্তির বসতবাড়ি ও ঘরের আঙিনা পরিচ্ছন্ন থাকে। তিনি মনে করেন যে, তাঁর সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠলে তাঁর দেহ-মন-আত্মাও কলুষমুক্ত হয়ে যাবে। আর নির্মল আত্মা নিয়েই তিনি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র এবং তিনি পবিত্রতাকে পছন্দ করেন, তিনি পরিচ্ছন্ন এবং তিনি পরিচ্ছন্নতাকে পছন্দ করেন।’ (তিরমিজি)
দৈনন্দিন জীবনে মুসলমানদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পূর্বশর্ত অজু করা। দিন-রাতে কেউ পাঁচবার অজু করলে তার দেহ অবশ্যই পরিচ্ছন্ন থাকবে। আর দেহ পরিচ্ছন্ন থাকলে মনও প্রফুল্ল থাকবে। মনোদৈহিক রোগ থেকে বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি পবিত্র মন। যার দেহ ও মন সজীব, রোগব্যাধি তাকে কখনো স্পর্শ করতে পারে না। সাধারণত দেহের যে অঙ্গগুলো অধিকাংশ সময় খোলা থাকে, অজুর বিধানে ওই সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ধৌত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই অঙ্গগুলো দিয়ে মানবদেহে রোগ-জীবাণু প্রবেশের আশঙ্কা বেশি, তাই ওই অঙ্গ বারবার ধুলে জীবাণু আক্রমণ করার সুযোগ পায় না। পবিত্র কোরআনে অজুর নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা নামাজের জন্য প্রস্তুত হবে, তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল, হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করবে এবং তোমাদের মাথা মাসেহ করবে এবং পা গ্রন্থি পর্যন্ত ধৌত করবে।...আল্লাহ তোমাদেরকে কষ্ট দিতে চান না। বরং তিনি তোমাদের পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর নিয়ামত পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৬)
মহানবী (সা.) ছিলেন পরিচ্ছন্নতার এক উজ্জ্বল প্রতীক। তাঁর সব কাজকর্ম ছিল গোছানো। তিনি ঘরের সবকিছু পরিপাটি করে রাখতেন। শয়নের আগে রাসুলুল্লাহ (সা.) বিছানা ঝাড় দিতেন। জুতা, কাপড় ইত্যাদি পরিধানের আগে তিনি ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করে নিতেন। নবীজি সুগন্ধি পছন্দ করতেন। সৌন্দর্যের প্রতীক ফুলও তাঁর খুব প্রিয় ছিল। নবী করিম (সা.) রাতে ঘুমানোর আগে এবং ঘুম থেকে জেগে মেসওয়াক করতেন। (যাদুল মায়াদ) মেসওয়াক মুখের রোগ-জীবাণু ধ্বংসের প্রধান হাতিয়ার। এটি মুখের দুর্গন্ধ প্রতিষেধক। নামাজি ব্যক্তি নিয়মিত মেসওয়াক ব্যবহারের কারণে অসংখ্য রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি পায়। জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও নবীজি মেসওয়াক করার জন্য বারবার ইশারা করছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টদায়ক না মনে করতাম, তাহলে প্রত্যেক নামাজের অজুর সঙ্গে তাদের মেসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।’ (বুখারি) তিনি আরও বলেন, ‘মেসওয়াক মুখকে পরিষ্কার করে, আর আল্লাহর কাছে এ আমল বেশি পছন্দনীয়।’ (নাসাঈ)
রাসুলুল্লাহ (সা.) রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা ইমানি দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেছেন। আমাদের দেশের আবহাওয়ার কারণে আমরা পরিষ্কার থাকার চেষ্টা করলেও তা পারি না। বাতাসের সঙ্গে সর্বক্ষণ ধুলাবালু উড়ছে, যার কারণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে সব সময় খেয়াল রাখতে হবে। আমরা যে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশে বসবাস করছি, তা থেকে মহানবীর (সা.) মুখনিঃসৃত বাণী আমাদের উত্তরণের পথ দেখাতে পারে। রাস্তায় যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা না ফেলে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনগুলো ব্যবহারে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। খোলা ডাস্টবিনগুলো প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষিত করে চলেছে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। যারা বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি আত্মার পবিত্রতা অর্জন করতে পারবে, তারাই সফলকাম। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে সেই ব্যক্তি, যে পবিত্রতা অর্জন করে।’ (সূরা আল-আ’লা, আয়াত: ১৪)
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য চাই সুস্থ পরিবেশ। নিজে একা পরিষ্কার থাকলে চলবে না; আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ইত্যাদি আমাদের সেই পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ—এ সবকিছুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও আবর্জনামুক্ত রাখতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারতপক্ষে চেষ্টা করতে হবে। শুধু বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা যথেষ্ট নয়; অন্তরের পরিচ্ছন্নতাও আমাদের অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুনাহের কালিমা থেকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ইসলামের দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা যদি পরিচ্ছন্নতাকে মেনে চলি, তাহলে রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে পারি। আল্লাহ পাক আমাদের সুন্দর-পরিচ্ছন্ন একটি সুশীল সমাজ গড়ার তাওফিক দান করুন!
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.