আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসঃ আলো-আঁধারির খেলায় আলোহীন জীবনচক্র by ইসমাইল হোসেন

সন্ধ্যার কিছু পর রাজধানীর ইন্দিরা রোডে আলো-আঁধারির খেলা। ফুটপাতে ৬ বছরের রাসেলের দুরন্তপনা। সমবয়সী আরও কয়েকজন এ খেলায় রত। ফুটপাতের ঝুপড়ি ঘরে রাসেলসহ অন্যদের বাবা-মায়ের দৃষ্টি নেই এদিকে।

ফুটপাতের আরেক বাসিন্দা নাসিরের এক ছেলে পলাশ। ৫ বছরের পলাশও দুরন্তপনায় মত্ত পাশের পার্কে। তার বাবা-মায়েরও খেয়াল নেই সেদিকে।
ফুটপাতের ঝুপড়ি ঘরে ক্লান্ত ছেলে ফারুককে ভাত বেড়ে দিচ্ছেন তাদের মা। সারাদিন রিকশা চালিয়ে ফিরেছেন ঝুপড়ি ঘরে। প্রভাতে ফের রিকশা নিয়ে বের হবেন, তাই দ্রুত খেয়ে ঘুমাতে হবে ফারুককে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ফারুকের বয়স ১৮ কিংবা ১৯ বছর। ছোট বেলা থেকেই মায়ের সঙ্গে থাকেন ফার্মগেটের ফুটপাতে। লেখাপড়া শেখেননি দুই ভাইয়ের কেউই। বড় ভাই ফুটপাতের চা-সিগারেটের দোকানদার।

রাজধানীর ফার্মগেটের এ রকমই অন্তত ২০/৩০টি পরিবার এমন ঝুপড়ি ঘরে থাকেন। সেখানে রয়েছে অন্তত অর্ধশত শিশু। এরা সকলেই বাধনছাড়া, বঞ্চিত শিক্ষার আলো থেকে।

নিম্নবিত্ত শ্রেণীভুক্ত এসব পরিবারের শিশুদের যে বয়স ও সময়ে তাদের পড়ার টেবিলে থাকার কথা, সে বয়সে তাদের সঙ্গী শিক্ষা নয়। উপরন্তু এখন তারা বাধনছাড়া, অযত্ন-অবহেলা নিত্যদিনের সঙ্গী।

নাসির ও ফারুকেরাও এক সময় এমন দুরন্তপনায় মত্ত ছিলেন। শিক্ষার আলো স্পর্শ করেনি তাদের ললাটেও। এভাবে শিক্ষাহীন ফারুক-নাসিরের মতোই পরম্পরায় এখন ফুটপাতের রাসেল-পলাশের মতো দুরন্ত শিশুগুলোর ভবিষ্যত গড়ে উঠছে। শিক্ষার আলো না পেয়ে অনাদরে-অবহেলায় বেড়ে উঠছে তারা। এদের অনেকেই সমাজে বেড়ে উঠছে সন্ত্রাসী-চোর-ডাকাত হিসেবে।

শুধু ফার্মগেট নয়, রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিতে এমন শিশুর অভাব নেই। দিন-রাতের অধিকাংশ সময় কাটে তাদের অযত্ন-অবহেলায়। শিক্ষার আলো থেকে তারা হচ্ছে বঞ্চিত। চাকচিক্যময় নগরেও এমন জীবনচক্র ভাঙতে পারছে না তারা।

কিছু দিন আগে এখানে একটি বিদেশি সংস্থার মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হলেও এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে।

ফার্মগেটের ফারুক ও নাসির বলেন, ‘‘আমরা শিক্ষা না পেয়ে বেড়ে উঠেছি। সন্তানদের শিক্ষাহীন করতে চাই না।’’

কিন্তু শিক্ষার আলো নেওয়ার প্রয়োজনীয় রসদ নেই তাদের।

সরকারি হিসেবে দেশে তিন কোটির ওপরে নিরক্ষর জনগোষ্ঠী রয়েছে। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসব সুবিধা বঞ্চিত গোষ্ঠীর।

৮ সেপ্টেম্বর শনিবার আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। সাক্ষরতা ছাড়া উন্নতি সম্ভব নয় বলেও মনে করে সরকার। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘সাক্ষরতাই উন্নতি, আসবে দেশে শান্তি’।

দিবসটি উপলক্ষে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন জানিয়েছেন, দেশে তিন কোটির ওপরে নিরক্ষর জনগোষ্ঠী রয়েছে। এই নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতার আওতায় আনতে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

২০০৯ সালের একটি জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ওই সময় দেশে নিরক্ষরের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৭০ লাখ। সরকারের সাক্ষরতা কর্মসূচি কার্যকর থাকায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ নিরক্ষর কমে এসেছে।

মোতাহার হোসেন জানান, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশে সাক্ষরতার হার ৫৯ দশমিক ৮২ শতাংশ।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিরক্ষরতা কমিয়ে আনা হয়েছিলো ৫৫ শতাংশে। এরপর পরবর্তী সরকারের সময় ৬৫ শতাংশ পেরিয়ে যায়। এবার মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে তা কমিয়ে ৬০ শতাংশে এনেছে। 

সরকার ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষর মুক্ত করার অঙ্গীকার করলেও বর্তমান সরকারের মেয়াদে তা সম্ভব কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘২০১৪ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের ঘোষণা থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা একটি ট্র্যাকে পৌঁছাতে চাই।’’

বিদ্যালয়গামী শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, শিশুদের ভর্তির হার ৯৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এদের মধ্যে ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকে। তবে মিড-ডে মিল (দুপুরের খাবার) কর্মসূচি চালু থাকা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার এখন ৯৬ শতাংশ।

শতভাগ জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতার আওতায় আনতে না পারার কারণ হিসেবে আর্থিক সমস্যার বিষয়টি জড়িত বলেও উল্লেখ করেন প্রতিমন্ত্রী।

দেশের মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীকে প্রাথমিক শিক্ষা ও সাক্ষরতা অভিযানে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানান তিনি।

দিবসটি উপলক্ষে শনিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা এবং গোলটেবিল বৈঠক।

কিন্তু ফার্মগেটের রিকশাচালক ফারুক মনে করেন, শুধু সভা-সেমিনার করলেই হবে না। তাদের মতো সুবিধা বঞ্চিত মানুষেরাও যাতে শিক্ষার আলো পান, সে জন্য বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। দারিদ্র্য এবং শিক্ষাহীন জীবন থেকে রেহাই চান ফারুকেরা।

No comments

Powered by Blogger.