হারিয়ে গেল বন্ধু কবি সৈয়দ হায়দার by আফরোজা পারভীন

জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের ২০২ নং কেবিনে ভর্তি হয়েছিল সৈয়দ হায়দার। জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়, রাতে তারা দেখা যায়। হায়দার বলেছিল, এই কেবিনটা পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আগেরবার ভর্তি ছিল ২০৫ নং কেবিনে। সে কেবিনটা বড় বদ্ধ, কেমন যেন দম আটকে যায়।


হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে দুয়ারে মৃতু্যর করাঘাত শুনতে পাবে যে কোন মুহূর্তে জেনেও জীবনবাদী ছিল হায়দার। বালিশে মাথা রেখে পর্দা সরিয়ে তারা দেখতে ভালবাসত সে। শেষ শয্যায় শুয়ে কোন মানুষ যে এতটা প্রাণোচ্ছল থাকতে পারে হায়দারকে না দেখলে বুঝতাম না। বরাবরের মতো হাসপাতালেও তার আপ্যায়নের কমতি ছিল না। তার বাড়ি থেকে কেউ না খেয়ে আসতে পারেনি কখনও, হাসপাতাল থেকেও চা কফি না খেয়ে কারও আসার উপায় ছিল না। হায়দারের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের ৭ বছরে কখনও তাকে গম্ভীর দেখিনি। হাসপাতালে রোগ যন্ত্রণার মধ্যেও সেটা অটুট ছিল। ডাক্তার কেমন আছেন প্রশ্ন করলে সে মুখ ভরিয়ে হাসত। কোন কষ্ট আছে জিজ্ঞাসা করলে দুষ্টুমি করে বলত, "শুধু মনে কষ্ট।" ডা. করিম থেকে শুরম্ন করে ডা. তাপস, সুমনসহ হাসপাতালের নার্স ওয়ার্ডবয়রা ভালবেসে ফেলেছিল তাকে। এমন পেশেন্ট তারা বড় একটা পায় না।
লেখালেখির সূত্রেই হায়দারের সাথে পরিচয়। সে পরিচয় থেকে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগেনি। পরিচয়ের পর থেকে আমার প্রতিটি লেখার পেছনে নেপথ্য প্রেরণাদাতা ছিল সে। একই সঙ্গে ছিল কঠোর সমালোচক। হায়দারের সমালোচনা বড় নির্মম। তার কথাগুলো কেটে কেটে বুকে বসত। কিন্তু সেই আঘাতটা যে কত প্রয়োজন ছিল তা আমি অচিরেই বুঝতাম। ওর সমালোচনার কারণেই আমি লেখার প্রতি আরও যত্নবান হতাম। সে যত্নের ছাপ পড়ত পরের লেখায়। আর তখনই বুঝতাম হায়দার আমার কি অকৃত্রিম বন্ধু। আমার এই অকৃত্রিম বন্ধু চলে গেল ২৭ ডিসেম্বর রাত ৯টা ২০ মিনিটে। হয়ে গেলাম বন্ধুশূন্য। আমার পড়াশোনা কম বলে হায়দারের মনে আপে ছিল। কত বই যে সে আমাকে পড়তে দিয়েছে, কত আর্টিকেল যে আমাকে পড়ে শুনিয়েছে বলে শেষ করা যাবে না। কোন লেখা লিখতে গিয়ে আটকে গেলেই আমি ফোন করতাম হায়দারকে। হায়দার আমাকে সাধ্যাতীত সাহায্য করত। এমনও হয়েছে আমার লেখার প্রয়োজনে ও নিজে পড়েছে তারপর বিষয়টা সম্পর্কে জানিয়েছে আমাকে। আমি নিশ্চিত অতি সৌভাগ্যবান না হলে এমন বন্ধু পাওয়া যায় না।
'৭০-এর দশকের অন্যতম কবি সৈয়দ হায়দার। লিখেছে গান থেকে শুরম্ন করে ছড়া পর্যন্ত। বেতারকে খুব ভালবাসত হায়দার। তাই শত ব্যসত্মতার মধ্যেও বেতারে সময় দিত সে। তার 'কোন সুখবর নেই' এবং 'অাঁধারের শেষ ভালবাসি' কবিতার বই দুটি সুধী মহলের মনোযোগ কেড়েছিল। আলোচিত হয়েছিল ধ্বংসের কাছে আছি ও ভুলগুলো নাড়া দেয়। প্রকৃতিপ্রেমী এই কবি বৃ, নদী, মাঠ, বন, মাটি, মানুষ নিয়ে লিখেছে প্রচুর। তার কবিতার বড় অংশ জুড়ে আছে প্রেম এবং দেশপ্রেম। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে বাজে তার লেখা অনেক গান। একসময় সাংবাদিকতা করেছে। দীর্ঘদিন একটানা কলাম লিখেছে খবরের কাগজ এবং আমার দেশে। গদ্য নিয়ে প্রচুর কাজ করার ইচ্ছে ছিল হায়দারের। ইচ্ছে ছিল একটা পত্রিকা বের করার। পত্রিকার নাম খুঁজছিলাম আমরা।
৬ মাস পর পূর্ণ অবসরে গিয়ে পূর্ণ উদ্যমে পত্রিকার কাজে মনোনিবেশ করার ইচ্ছে ছিল তার। হলো না, কিছুই হলো না। ১৯৫০-এ যে জীবনের শুরম্ন শেষ হলো তা ২০০৯-এর শেষাংশে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে।
আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ছোট্ট একটা গ্রম্নপের মতো ছিলাম। বন্ধুদের প্রচুর খাওয়াত সে, প্রচুর আড্ডা দিত। আড্ডাই যেন ছিল তার জীবনীশক্তি। আমরা বন্ধুরা মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতাম। এই বেড়ানোর নাম আমরা দিয়েছিলাম 'গতি ভ্রমণ।' এ গতি ভ্রমণ ছিল বড় আনন্দের। মনে পড়ে একবার গতি ভ্রমণে বেরিয়ে পুরো ময়মনসিংহ চষে ফেলেছিলাম চার আনা দামের সিঙ্গাড়ার খোঁজে। পেয়েছিলাম শেষ পর্যনত্ম। আর কখনও আমাদের গতি ভ্রমণে যাওয়া হবে না। মনটাই যে ভেঙ্গে গেল।
এমনটা হবে কখনও ভাবিনি। আমাদের কোন হিসেবের মধ্যেই ছিল না হায়দারের মৃতু্য। কখনও একটা নাপাও খেতে দেখিনি তাকে। বলত, "ডাক্তারের কাছে গেলেই এক শ' একটা অসুখ বের করে। কাজেই যত ডাক্তার এড়ানো যায় ততই মঙ্গল।" আমাকে মাঝে মাঝে উপদেশ দিয়ে বলত, "বেশি করে পানি খাবে আর বেশি করে হাঁটবে। তাহলে সব অসুখ পালাবে।" আমার কাশির কথা ভেবে সুন্দরবনের খাঁটি মধু এনেছিল, চ্যবনপ্রাশ এনেছিল কলকাতা থেকে। পুরো বেনাপোল ঘেটে কাজের মেয়ে যোগাড় করেছিল। আমি বিদেশে থাকা অবস্থায় ভাবী (হায়দার ভাইয়ের স্ত্রী) টিফিন কেরিয়ারে করে প্রতিদিন খাবার পাঠাত ছেলেমেয়েদের জন্য। সে টিফিন কেরিয়ারটা আজও রয়ে গেছে। যতবার টিফিন কেরিয়ারটার দিকে চোখ পড়ছে ততই চোখ ভরে আসছে জলে।
ও প্রচুর হাঁটত। ওয়েট কমছিল দ্রম্নত। জিজ্ঞাসা করলে বলত, হাঁটি আর ডায়েট করি তাই ওজন কমছে। বিশ্বাস করেছিলাম। আজকের দিনে ওজনটা এক বিরাট সমস্যা। ওজন যদি কমানো যায় এর চেয়ে সুখের কি হতে পারে। বুঝিনি ভেতরে ভেতরে ওর সমসত্ম শক্তি, স্বাস্থ্য, জীবন রস কেড়ে নিচ্ছে নীরব ঘাতক ক্যান্সার।
হায়দারের দেশের বাড়ি ফকিরহাটের সাতসৈয়া গিয়েছি। সারা গ্রাম ঘুরেছি আমি, কবি আতাহার খান, কবি আবু করিম, কবি শিহাব সরকার, পাখি বিশেষজ্ঞ শরীফ খান, নুরম্নল আমিন আর সাংবাদিক বেনজির আহমেদ। দেখেছি গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতার সে কত প্রিয়। গ্রামের মানুষ তাকে জড়িয়ে ধরেছে, তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য ডেকেছে। বৃদ্ধা মাকে পাগলের মতো ভালবাসত সে। মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করত ফোনে। মায়ের সামান্য অসুস্থতায়ও পাগল হয়ে উঠত। আজ সেই মাকে নিজ চোখে দেখতে হলো সন্তানের অকাল মৃতু্য। একমাত্র পুত্র সৈয়দ অপার শুদ্ধর জন্য ছিল গভীর ভালবাসা। ভালবাসা ছিল প্রিয়তমা স্ত্রী খুকু ভাবীর জন্য। সারাণ ভাবীর অসুস্থতা নিয়ে চিন্তা করত। কে জানত ভাবির আগেই হায়দার চলে যাবে! ফকিরহাটের কণ্ঠস্বর সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদের নেপথ্যে বরাবর কাজ করেছে সে। কণ্ঠস্বরের অন্যতম উদ্যোক্তা মিজান সম্পর্কে হায়দারের ভাইপো। কি বিশ্বাসই যে করত মিজানকে। আর কি যে ভালবাসত। কত মানুষ হায়দারের ছায়ায় বড় হয়েছে, ঢাকা শহরে এসে হায়দারের বাড়িতে থেকে খেয়ে লেখাপড়া করেছে, চাকরি খুঁজেছে, অনেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মানুষকে ভালবাসত হায়দার। তার মধ্যে গরিব মানুষের জন্য ছিল তার গভীর মমতা। বন্ধুদের সন্তানদের সে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসত। হায়দার বহুবার আমাকে বলেছে, "সব পুত্রই আমার পুত্র।" আমার ছেলে পান্থকে আর নিজের ছেলে শুদ্ধকে কখনই আলাদা করে দেখেনি সে। পান্থ ফটোগ্রাফি করে। নিজের তোলা একটা দোয়েলের ছবি হায়দারের ড্রইং রম্নমে টানিয়ে দিয়ে এসেছিল সে। তখন কে জানত হায়দার নিজেই দোয়েল হয়ে পালিয়ে যাবে।
হাসপাতালে ভর্তি হবার পর কখনও মনোবল ভাঙ্গতে দেখিনি তার। একদিন শুধু অস্ফুট কণ্ঠে বলেছিল, "লেখাগুলো শেষ করতে পারব তো! কিছুই যে লেখা হলো না। গদ্য নিয়ে বড় একটা কাজ করার ইচ্ছে ছিল...।" স্ত্রী খুকু ভাবীর জন্য শেষ দিকে বড়ই অস্থির ছিল সে। তাই তো ডাক্তারের হাত ধরে আকুতিভরা কণ্ঠে বলেছিল, "আমাকে আর মাত্র একটা মাস বাঁচিয়ে দেন ডাক্তার সাহেব।" হায়দার আমার কাছে একটি কাঠের বুদ্ধমূর্তি চেয়েছিল। বন্ধুত্বের এত বছরে কখনও সে আমার কাছে কিছু চায়নি। এটাই ছিল তার প্রথম এবং শেষ চাওয়া। আমি মায়ানমার যাচ্ছি শুনে সে বলেছিল, "পপী, আমার জন্য একটা কাঠের বুদ্ধমূর্তি এনো।" হায়দার আমি তোমাকে একটা কাঠের বুদ্ধমূর্তি দিতে চাই। কিন্তু কোথায় কিভাবে দেব বলো তো হায়দার।

No comments

Powered by Blogger.