বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতায় জীবন ও মানুষ by সাইফুজ্জামান

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী। গবেষণা, শিল্প সাহিত্য সমালোচনা, প্রবন্ধ রচনা ও গল্প উপন্যাস রচনায় তাঁর দতা সর্বজনবিদিত। বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবনকে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর স্পর্ধিতভাবে স্পর্শ করেছেন। শিল্পের দৈশিক ও আনত্মর্জাতিক পরিসরে তার রচনা বিশেষভাবে পরিচিত। জীবনের জাগরণ অন্বেষা তার সাহিত্য কৃতির মৌল উপাদান। গদ্য রচনায় তিনি যতখানি দ, কবিতা ও শিল্পের তত্ত্বতালাশেও ততখানি সচেতন ও বিশ্বসত্ম। পঞ্চাশ দশকে একদল তরম্নণ সাহিত্যিক সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় যে সম্ভাবনাকে লালন করেছিলেন, যা পরবতর্ীতে উত্তীর্ণ হয় বিশাল সফলতায়। আব্দুর রশীদ খান ও মোহাম্মদ মামুন সম্পাদনা করেন 'নতুন কবিতা' সঙ্কলন। দশম শ্রেণীর ছাত্র বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের একটি কবিতা ঐ সঙ্কলনে স্থান পায়।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের উলেস্নখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : আমাদের মুখ, পুরানা বৃরে ডালপালা, আসবাবহীন ঘর, বুকের মধ্যে নদী, তোমাদের দেয়া নীলশার্ট পরে। গ্রন্থভুক্ত কবিতাতে স্বদেশ, সাধারণ মানুষ, বহমান উত্তরাধিকার, চেনাজনপদ ও ব্যক্তি অনুভূতি সংযুক্ত হয়েছে। আমরা যারা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা পড়ি তারা জেনে যাই তার কবিতা কতটা মানবিক, কত না রহস্যের! বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর দীর্ঘদিন কবিতা লিখছেন, কিন্তু গ্রন্থ প্রকাশে দীর্ঘ সময় বিলম্বিত হয়েছে। এই বিলম্বিত সময় ধরে লেখা যায় তার আবেগকে স্থিত আর কবিতাকে নন্দন শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করার ব্যাপারে তিনি ব্যয় করেছেন। 'আমাদের মুখ' কাব্যগ্রন্থ ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত। ৩৮টি কবিতা অসম্ভব প্রাণস্পন্দন ধারণ করে। এ গ্রন্থের কবিকে পতন ও দুযের্াগগ্রসত্ম হয়েও বাঁচার ব্যাকুলতায় কাতর হতে দেখি। মানবজীবনের অনুভূতি, স্বদেশপ্রেম ও ব্যক্তির বোধকে অবলম্বন করে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর কবিতা রচনা করেন। বাইরে তুষার পড়ছে। মানব-মানবী সানি্নধ্য চেতনায় অধীর। ব্যক্তির মনের রসায়ন নিংড়ে যে পঙ্তিমাালা রচিত হয় তা আবেগাকীর্ণ। প্রেমিক কবি বিচ্ছেদ থেকে জেনে নেয় মিলনের অর্থ। তিনি উচ্চারণ করেন_ আমরা এক সময় প্রেমিক ছিলাম/এখন আর নই/ তোমাকে ফের দেখার পর/ এইতো আমার হাত তোমার চোখে/ এইতো আমার শরীর/ তোমার বুক এবং আমার মুখের মধ্যে/এখন দূরত্ব/এই হচ্ছে বিচ্ছেদ (আমরা এক সময় : আমার মুখ) প্রেমিকা চলে যাওয়ার পর প্রেমিকের অনুভূতি কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রকাশ করেছেন। বিধ্বসত্ম প্রেমিক তার প্রেমিকার চলে যাওয়ার পর পেশাদার টু্যরিস্ট বনে যায়। তার জন্য নির্ধারিত দুনিয়াজোড়া ক্যাথিড্রাল ও মসজিদ। প্রেম ধ্যানস্থ। প্রেমিক হৃদয় প্রেমিকার জন্য ব্যাকুল পুরোন স্মৃতি তার চোখের সামনে দুলে ওঠে। তার বেঁচে থাকাও যেন অর্থহীন। সে কেবল পেশাদার টু্যরিস্ট হতে পারে। পুজারী প্রেমিকের সঙ্গে একাত্ম পাঠক খুঁজে পায় তার নিজস্ব প্রেমের অবয়বকে।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর উচ্চারণ করেন : 'বিশ্বাস থেকে ফুল ফোটে/নদী বয়/ধর্ম হয়। এটা চিরনত্মন সত্য। দৃশ্যমান বস্তুর সঙ্গে অদৃশ্য বস্তুর মেলবন্ধন তার কবিতায় সক্রিয়। তার কবিতার প্রধান অংশজুড়ে রয়েছে 'প্রেম'। এ প্রেম থেকে কাম প্রবৃত্তি, জৈবিক রসায়নে জাড়িত মানব মন পৃথিবীতে অসত্মিত্ব চেতনায় আচ্ছন্ন হয়। তিনি সচেতনভাবে বলেন : আমি তোমাকে বিশ্বাস করতাম। যেমন করি তোমার চোখ/তোমার হাত/ তোমার বুক/আমার মধ্যে রেখে গেলে দুনিয়া জোড়া ক্যাথিড্রাল এবং মসজিদ/আমাকে তুমি বানিয়ে দিলে পেশাদার টুরিস্ট (আমি তোমাকে : আমাদের মুখ)
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতায় অনেক উজ্জ্বল দর্শনজাত পঙ্ক্তি পাওয়া যায়। তিনি প্রেম ও ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন : শরীরের সঙ্গে শরীর/ এই হচ্ছে ঈশ্বর। বিষণ্নতায় নিমগ্ন পঙ্ক্তি আশার আলোড়নে উদ্দীপ্ত : আজ থেকে আগামীতে পেঁৗছবার জন্য/ তোমার কাঁধে হাত দিয়ে আমরা তাকাই। য় এবং বিষণ্নতার সর্ব গ্রাসের দিকে/এখানে কেউ ভালো থাকে না। তুমি ভালো থেকো (ইতিহাস বিষয়ক)
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর রাজনীতি সচেতন। তাঁর কবিতায় সমাজচিত্র অঙ্কিত হয়। জীবনের জটিল চাহিদা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সাধারণভাবে প্রকাশ করেন। ছোট ছোট বাক্য অসাধারণ মমতা ও আবেগে প্রথিত করে তিনি যে পঙ্ক্তিমালা নির্মাণ করেন তা আমাদের সমাজ প্রগতির অগ্রবতী ভাবনায় আলোড়িত। মানুষ, স্বদেশ, প্রেম আর নগরজীবনের টানাপোড়েন তার কবিতায় উঠে আসে। ব্যক্তি অনুভূতি সমষ্টির ভাবনাকে গ্রথিত করে।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পুরনো বৃরে ডালপালা। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত। বাঙালীর প্রাত্যহিক জীবনের টানাপোড়েন এই কাব্যগ্রন্থের মূল উপজীব্য। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও স্বৈরশাসনের কালাকানুন জগদ্দলপাথরের মতো এক সময় চেপে ধরেছিল। তিনি এই সমাজচিত্রে উদ্বেলিত। শানত্মির স্বদেশ ও সংঘাতমুক্ত সমাজের প্রতীায় উন্মুখ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর উচ্চারণ করেন :
১. আমি রক্তপাতের বিপরীত (২) বৃষ্টি পড়ছে আমাদের ঘিরে ৩) পতন তাই আমি স্বাধীন।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সাম্যবাদের পূর্ণ একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন। পৃথিবীর মানুষ একে অপরের প্রতিপ এ দৃশ্য তাকে বেদনার্ত করে। মানুষের আবেগ, মানসিক শক্তি ও দেশপ্রেম বাংলাদেশে সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে তিনি এ বিশ্বাস লালন করেন। কিছু প্রশ্নে তার সত্তা উদ্বেল। তিনি বলেন, যারা সমাজতন্ত্র ছেড়ে/এখন পুঁজিপাত হচ্ছে/ টাকার জোরে হৃদয়ের জোর কিনে নিচ্ছে/ টাকা গিলে নিচ্ছে শব্দ/ টাকা নিচ্ছে ভাবনা, তৃষ্ণা/আমার পুরনো বন্ধুরা টাকা মধ্যে ফিরে এসেছে/... দিনের মধ্যে ছায়ার যেমন বদল হয়। তেমনি তুমি এবং পৃথিবীটা বদলে যাচ্ছে। এই দল পরিবর্তন কি পরিবর্তন না বিশ্বাস ঘাতকরা/ হৃদয়ের কিংবা ভাবনার (এই বদল : পুরনো বৃরে ডালপালা)
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর নীতিভ্রষ্ট অর্থলোভী রাজনীতিবিদদের চিহ্নিত করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের পরিবর্তন পৃথিবীজুড়ে কি প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে তা আমাদের অজানা। আমাদের দেশে কিছু রাজনীতিবিদ দ্রম্নত বদলে যান। এই বদলে দেশপ্রেমিক নাগরিকের মনে হতাশা তৈরি করে। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর আশাবাদী। তিনি মনে করেন ভাবনা উজ্জ্বল করা জরম্নরী। অন্ধকারের পাশে আলো থাকে। পথভ্রষ্ট মানুষ অল্প। সৎ মানুষের সংখ্যা বেশি। এই সৎ মানুষেরা আদর্শের পতাকা ধরে রাখে।
কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বিশ্বাস করেন ফায়ার পেস্নস, বই বাঁচার অনুষঙ্গ। তিনি বলেন, আমাদের ভাবনাগুলো মুছতে মুছতে উজ্জ্বল করতে থাকি/ এতো অন্ধকারের মধ্যে/ আলোর দরকার আছে বলে।...ফায়ার পেস্নস, বই, কফি/এখন বাঁচার জন্যে দরকার/ সবকিছু হ্রস্ব হয়ে আসছে (সবকিছু হ্রস্ব হয়ে আসছে)
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ আসবাবহীন ঘর ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থভুক্ত ৬০টি কবিতায় এক নতুন বোধে উদ্ভাসিত কবিকে প্রত্য করে পাঠক। তিনি সখেদে উচ্চারণ করেন 'এই রাষ্ট্রে কেঁদে কিছু হয় না।' পরণে গণতন্ত্রের নতুন এক আদল আবিষ্কার করেন।
তিনি বলেন, আমি টেলিফোন ডিসকানেক্ট করেছি। চিঠিপত্র সরিয়েছি বইপত্র লুকিয়েছি। আসবাবহীন একটা ঘর। তোমাকে চলে যেতে বলেছি। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ, গোয়েন্দারা আসছে কিংবা ক্যাডাররা। এই হচ্ছে গণতন্ত্র এখন আমাদের ভেতর একজন আগে মরবে আমাদের ভেতর একজন আরও কিছু কাল বাঁচবে। (আসবাবহীন ঘর) বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর আধুনিক কবি। তাঁর কবিতা জীবনের জয়গানে মুখর। তিনি অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সম্পর্ক তৈরি করেন দ কারিগরের মতো। স্মৃতি ও সমকাল তাঁর কবিতার বাহক। কবিতা সরল ও সুন্দর বাক্য ও ভাবনায় উদ্দীপ্ত। সমাজের সচেতন নাগরিক হিসেবে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের যা কিছু করণীয় তিনি তা নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাচ্ছেন। দেশ, মানুষ ও সমাজচিত্রের অনুরণন তাঁর কবিতায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর জীবন ও মানুষকে এক ভাবনায় গ্রন্থিত করে তার আধুনিক কবিতা সৃজনে ব্যয় করছেন।

No comments

Powered by Blogger.