বউবাজার- স্বাধীনভাবে কেনাকাটা নানাবয়সী মহিলার

সালেহা বেগম দোকানে বসে নানান ধরনের তরিতরকারি নিজের হাতে মেপে দিচ্ছেন। কেউ নিচ্ছে এক কেজি পটোল, কেউবা বেগুন। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ১১টা পর্যনত্ম এখানে বসে তিনি তরকারি বিক্রি করেন। স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যাবার পর এখানে সবজির দোকান দিয়েছেন তিনি। এ দোকানের আয় দিয়ে তার সংসার চলে।
ডেমরার কুতুবখালী বউবাজারে গেলে এমন দৃশ্য দেখা যায় নিত্যদিন। শুধু সালেহা বেগম নয়, আশপাশের প্রায় সব দোকানিই মহিলা। মহিলারা সব দোকানে পণ্য বিক্রি করেন। আবার ক্রেতাদের অধিকাংশও মহিলা। সববয়সের মহিলার পদধ্বনিতে বাজারটি জমজমাট হয়ে ওঠে। সে কারণে এর নাম হয়েছে বউবাজার। এ বাজারে সবজি, মাছ, মাংসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই কিনতে পাওয়া যায়। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণীর মহিলারা এ বাজারের ক্রেতা। এখন স্থানীয় এলাকাবাসী ছাড়াও কাজলা, পাইটি, শনিরআখড়া, রায়েরবাগ, মাতুয়াইল, কোনাপাড়া এলাকাসহ আশপাশের এলাকার বউরা বউবাজারে এসে আনাজ, মাছ-মাংস কিনে দ্বিধাহীন বাড়ি ফিরছেন। নানা বয়সী মহিলা স্বাধীনভাবে কেনাকাটা করছেন। একই সঙ্গে তাঁরা পরস্পর কুশল বিনিময়ও করছেন। ব্যাগে ভরে নিয়ে যাচ্ছেন সজনে ডাঁটা, পটোল, লাউশাক, মরিচ-পেঁয়াজ। পুরম্নষদের আর বাজার করার চিনত্মা নেই। বউবাজারের বউরা সব সমস্যার সমাধান করছেন। এলাকার গৃহবধূরা এখানে সবজি বিক্রি করেন। সাধারণত স্বল্প আয়ের মহিলারা এখানে দোকান দিয়ে সবজিসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রি করে তাঁদের সংসার চালান।
সরেজমিনে বউবাজারে গিয়ে জানা গেছে, ডেমরার কুতুবখালী এলাকায় প্রায় এক যুগ আগে কাঁচাবাজার বা সবজিবাজার গড়ে ওঠে। কুতুবখালী-কাজলা সড়কের দু'পাশে এ বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রায় দেড় শ' দোকান। সেই সব দোকানে বেচাকেনা করছেন মহিলারা। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ১১টা পর্যনত্ম এসব দোকানে বেশ ভিড় থাকে। আশপাশের বসত্মিবাসী মহিলারা এখানে এক সময় সবজি বিক্রি করতেন। তখন ক্রেতাও ছিলেন বসত্মিবাসী মহিলারা। পরে এই বাজারে বাড়তে থাকে ক্রেতা। বৃদ্ধি পায় সবজির আমদানি। বউবাজারের একটি সবজি দোকান চালান বিলকিছ বেগম (৩৪)। বিলকিছ বেগম জানান, তাঁর স্বামীকে সমিতি থেকে (এনজিও) ৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দেন ব্যবসা করার জন্য। কিন্তু এক সময় তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। দু' ছেলেমেয়ে নিয়ে পড়েন বিপদে। পরে তাঁর স্বামী আরেকটি বিয়ে করে। এ অবস্থায় বিলকিছ বেগম আবার একটি সমিতি থেকে ঋণ নেন। এ টাকা দিয়ে বউবাজারে তাঁর স্বামীর ফেলে যাওয়া দোকানটি আবার চালু করেন তিনি। প্রতিদিন গ্রাম থেকে লোক এসে তাঁর দোকানে সবজি দিয়ে যান, যা আয় হয় তা দিয়েই চলে তাঁর সংসার। ১২ বছরের ছেলে লোকমান মামাবাড়ি কুমিলস্নার পাঁচকিদ্দা গ্রামে থেকে লেখাপড়া শিখছে। ছোট মেয়ে আয়েশা তাঁর কাছেই থাকে। শুধু বিলকিছই নন, ছায়েরা, হালিমা, কুলসুম, আলেহা, হুরবানু, রহিমা, মমতাজ, রিজিয়া, আলোমতিসহ আরও অনেক বিধবা কিংবা স্বামী পরিত্যক্ত মহিলার দোকান আছেন বউবাজারে। যাঁরা জীবনযুদ্ধে হার না মেনে বেছে নিয়েছেন সংগ্রামের পথ।
বউবাজারে কাঁচামালের দোকান হালিমার। এক বছর আগে তাঁর স্বামী আলাল মারা যান। আলাল ওই দোকানটি চালাতেন। স্বামী মারা যাবার পর তাঁর সংসারে নেমে আসে অনটন। তখন হালিমা নিজে স্বামীর দোকান চালানোর সিদ্ধানত্ম নেন। হালিমা বলেন, বউবাজারে দোকান চালিয়ে অন্য মহিলারা সংসার চালাতে পারলে তিনি পারবেন না কেন? এরপরই শুরম্ন হয় হালিমার পথ চলা। দু'ছেলে, এক মেয়ের জননী হালিমা বলেন, পাশের বসত্মিতে তিনি ভাড়া থাকেন। মেয়ে লিপির বিয়ে দিয়েছেন কয়েকদিন আগে। বউবাজারের সবজি দোকানি নাহার (৩০)। তাঁর বাড়ি রূপগঞ্জের দাউদপুর এলাকায়। তাঁর এক ছেলে। তিনি দুই বছর ধরে এখানে সবজি বিক্রি করছেন। নাহার জানান, প্রতিদিন ১০০ টাকা আয় হয়। এ টাকায় তিনি ছেলের পড়ার খরচ চালান। গরিবের দোকানদার শাহিদা (৩০)। স্বামী গফফার। তাঁর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। দুই ছেলেমেয়ে। মেয়ে স্কুলে পড়ে। শাহিদা চনপাড়া বসত্মিতে মায়ের কাছে থাকেন। সংসার চলে না। ভাতের খুব কষ্ট। এ জন্য সামান্য টাকা পুঁজি নিয়ে তিনি দোকান খুলেছেন বউবাজারে। তাঁর দোকানে বিক্রি হয় আদা, রসুন, শুকনামরিচ, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ। তিনি ছোট ছোট ভাগ করে বিক্রি করেন। প্রতি ভাগের দাম দুই টাকা। শাহিদা জানান, বউবাজার তাঁর ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করেছে। বউবাজারের বউরা এ কারণে তাঁর খুব আপন। বউবাজারের আরেক সংগ্রামী নারী কুলসুম (৩৭)। প্রায় ১৮ বছর আগে স্বামী তাঁকে ফেলে চলে যায়। সেই থেকে তাঁর কোন খোঁজ নেই। বাড়ি বাড়ি গরম্ন-ছাগলের ভুঁড়ি কলিজা বিক্রিও করেছেন ফেরি করে। ৭/৮ বছর আগে তিনি বউবাজারে একটি কাঁচামালের দোকান দিয়েছেন। প্রতিদিন তিনি এ দোকানে কাঁচামাল বিক্রি করেন। আলাদা লোক আছে তাঁর, যাঁরা কাঁচামাল এনে দেয়াসহ সব কাজ করে দেয়। তিনি শুধু বিক্রি করেন। দু'মেয়ে রোকসানা ও রওশন আরার ইতোমধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে আশরাফকে কিনে দিয়েছেন রিকশা। বউবাজারের দোকানি আশা, ময়না, লিলি, ছলেমাসহ অনেকে এ প্রতিনিধিকে বলেন, প্রায় একযুগ আগে বাজারটি এখানে বসেছে। তাঁরা বলেন, সেই সময় এই এলাকায় প্রচুর মানুষ ফেরি করে সবজি বিক্রি করতেন। ঘন বসতি হবার কারণে এখানে ফেরিওয়ালার উপস্থিতি একটু বেশি ছিল। তখন স্থানীয় মানুষ ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে এসব ফেরিওয়ালার বসার জায়গা করে দেন। বাড়ির পাশে হওয়ায় এলাকার বউ-ঝি'রাই এ বাজারে আসতেন বাজার করতে। কয়েক মহিলা এ সময় সবজি বিক্রি করতেন। দিনে দিনে দোকানির সংখ্যা বাড়তে থাকে।। এই বাজারে বিক্রেতা ও ক্রেতাদের অধিকাংশই মহিলা হওয়ায় স্থানীয় মানুষ এর নাম দেন 'বউবাজার'। বউবাজার পরিচালানা করার জন্য আছে একটি কমিটি। তবে কমিটির সকলে পুরম্নষ। কমিটিতে কোন মহিলা নেই। এই কমিটি বাজারের শানত্মিশৃঙ্খলা, পরিষ্কার-পরিছন্নতা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে। কমিটির সদস্য ১২ জন।
এ বাজারে কেনাকাটা করার সময় কথা হয় গৃহবধূ পারভিন, মারজান, হাসিনা, মাকসুদা, চম্পা, স্বপ্না, শাহনাজ, স্বর্ণাসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করতে পারি। কোনো সমস্যা কোনোদিন হয়নি। পুরম্নষরা এ নিয়ে কোনো ঝামেলা করেনি। দামও কম। মহিলা বিক্রেতারা সঠিক ওজন দেন।
_মীর আব্দুল আলীম, রূপগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.