কাছের সত্যজিৎ by আ মা নু ল হ ক

আমার কলকাতা আসার গোড়ার দিকে প্রগতিশীল মাসিক পত্র 'নতুন সাহিত্য' পত্রিকার সম্পাদক অনিল সিংহের কাছে খবর পেয়ে পূর্ণেন্দু পত্রী নিজেই দেখা করতে এসেছিলেন। সেই থেকে পরিচয়ের সূত্রপাত। ফিল্ম সোসাইটি প্রদর্শনীতেও দেখা-সাাত, আলাপ আলোচনা হতো। পরবতর্ীতে টালিগঞ্জে শূটিং দেখতেও আসতেন মাঝেমধ্যে।


এই সময়েই পত্রী স্টিল ফটোগ্রাফির দিকেও আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং সেই সূত্রে টেকনিক্যাল নানা দিক সম্পর্কে আমার কাছ থেকে তালিম নিতেন।
ষাটের দশকে সত্যজিতের সামগ্রিক চিত্রকর্ম সম্পর্কে কলকাতার অগ্রণী সিনেমা পত্রিকার শারদীয় বিশেষ সংখ্যায় আমার তোলা ছবিসহ পূর্ণেন্দু পত্রীর একটা সচিত্র প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
আমার মতে, বিশেষ অর্থে 'পথের পাঁচালী' থেকেও ভাল ছবি 'অপরাজিত।' এ নিয়েও পত্রীর সঙ্গে কথা হতো। শেষে উৎসাহভরে বললাম : চলুন একদিন আমরা সত্যজিতের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি তুলে ধরি, সেই সঙ্গে তাঁর নিজস্ব মতামত...। সত্যজিতের সঙ্গে দেখা করতে আমার অঢ়ঢ়ড়রহঃসবহঃ না লাগার সুযোগে অচিরেই আমরা দু'জন লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে গিয়ে কথা প্রসঙ্গে জ্ঞাতব্য বিষয়টি তুলে ধরলাম। অনেক কথা হলো। আমার বিশেষ একটা কৌতূহল ছিল, একঝাঁক পায়রাকে কিভাবে সত্যজিৎ এত সার্থকভাবে ছবির বিভিন্ন পর্যায়ে তুলে ধরতে পেরেছিলেন! এমনি নানা বিষয়ে খুঁটিনাটি কথা প্রসঙ্গে যথারীতি হাস্যরসাত্মক কিছু কথাও উঠে আসে। অপুর পিতার মৃতু্যসংশিস্নষ্ট দৃশ্যে একঝাঁক পায়রা নাটকীয়ভাবে উড়ে ওঠার বিষয়টি অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ।
অসুস্থ হয়ে পড়ার প্রথম দিকে স্নান সেরে ঘাটের ৬৪ সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে আসতে যখন পড়ে গেলেন সেই দৃশ্যেও আসন্ন বিপদের প্রতীকী তাৎপর্যব্যঞ্জক একঝাঁক পায়রার সাঁই করে উড়ে যাবার দৃশ্যটির পরিকল্পনা ও গঠন-নৈপুণ্য এককথায় অতুলনীয়। একঝাঁক পায়রাকে বিশেষ মুহূর্তে তাৎণিকভাবে কেমন করে পেয়েছিলেন_আমার সেই প্রশ্নের উত্তরে সত্যজিৎ বললেন : 'পায়রার ঝাঁক ধরে ওড়ার বিশেষ একটা ধরন ল্য করেছিলাম এবং সেই অভিজ্ঞতাটাই শূটিংয়ের সময় কাজে লাগিয়েছিলাম। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে সত্যজিৎ শুধু ঘড়হ-ধপঃড়ৎ ভিত্তিক চলচ্চিত্র সৃষ্টির দ পরিচালকই নন, অপরপ েসম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেেিত তিনি সুচিনত্মিত অভিব্যক্তি প্রকাশ করার তাগিদে বলা যায় বাঁদরকে দিয়েও তাৎপর্যপূর্ণ অভিনয় করিয়ে নিতে সম। তাই তো অপরাজিত এড়ষফবহ খরড়হ ছাড়াও ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের শীর্ষস্থানীয় আরও দুটি ঈৎরঃরপং অধিৎফ ও ঝঢ়বপরধষ অধিৎফ লাভ করেছিল একইসঙ্গে। এটাও একটা উলেস্নখযোগ্য রেকর্ড।
মৃতু্যদৃশ্যে একঝাঁক পায়রার নাটকীয়ভাবে উড়ে ওঠার দৃশ্য গ্রহণের পেছনে সম্পূর্ণ অন্যরকম, কিছুটা হাস্যরসাত্মক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল। খাবার ছিটিয়ে দিয়ে পায়রাগুলোকে একত্রিত করে আচমকা গেঁটে ফুটিয়ে শট নেয়া হয়েছিল। গেঁটে ফোটানোর বিকট শব্দই ছিল একত্রিত হওয়া অসংখ্য পায়রার নাটকীয়ভাবে একসঙ্গে উড়ে যাওয়ার মূল রহস্য। এ্যাসিস্ট্যান্টদের অসতর্কতায় ক্যামেরা চলার আগেই বিকট শব্দে গেঁটে ফোটার আওয়াজই ছিল কথিত হাস্যরসাত্মক বিষয়টির কারণ। সত্যজিৎ তাঁর সহজাত প্রবণতায় বিসত্মারিত শুনিয়েছিলেন হাস্যরসাত্মক সেই দিনের ঘটনাটির খুঁটিনাটি কথা।
'পথের পাঁচালী' ও 'অপরাজিত' ছবি দু'টি নিয়ে আমাদের লঘু-গুরম্ন নানা মতামত সাধ্যমতো তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম সেদিন, সেই সঙ্গে সত্যজিতের প্রতিক্রিয়া। সবকিছু শুনে সত্যজিৎ বলেছিলেন, 'অপরাজিত কঠিন ছবি, আরেকবার দেখলে হতো।' সত্যজিতের মনত্মব্যের এইটুকুই আমাদের সামগ্রিক কৌতূহলের সার্থকতা মনে করি।
প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য ঋতি্বক ঘটক ও মৃণাল সেনের মতামতের বিষয়টিও। বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত মনত্মব্যে 'অপরাজিত'-এর শ্রেষ্ঠত্বের কথা তাঁরাও কম বেশি উলেস্নখ করেছেন।
পুরস্কারের দিক থেকে 'পথের পাঁচালী' লাভ করেছে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ ১১টি আনত্মর্জাতিক পুরস্কার। 'অপরাজিত' পেয়েছে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ ৭টি আনত্মর্জাতিক পুরস্কার। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, পুরস্কারের সংখ্যা দিয়ে শেষ বিচারে শিল্পের মহত্ত্ব নির্ধারণ করা না গেলেও শিল্পের গুণ বিচারে পুরস্কারের কথা এবং তার সংখ্যার কথাও প্রাসঙ্গিক আলোচনায় সবসময় উঠে আসে। যত কথাই বলি না কেন, এত বছর পর যখন পেছন ফিরে তাকাই, 'পথের পাঁচালী' তার বিচিত্র বৈভবে হাতছানি দেয়!
সেকালে ভেনিস ফেস্টিভ্যালকেই সৃজনশীল চলচ্চিত্র জগতের শ্রেষ্ঠ উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং সেই সূত্রে প্রথম পুরস্কার এড়ষফবহ খরড়হ-ই বিশ্বসেরা পুরস্কারের মর্যাদা লাভ করত। তৎকালে সারা এশিয়ায় জাপানের কুরোসাওয়া ও ভারতবর্ষের সত্যজিৎ রায় এই দু'জন গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতা তাঁদের নির্মিত ছবি যথাক্রমে 'রসোমন' ও 'অপরাজিত'-এর জন্য এড়ষফবহ খরড়হ পুরস্কার লাভ করেন। দুর্লভ সাফল্যের সংবাদে উলস্নসিত ফিল্ম প্রেমিকের ভিড় জমেছিল কলকাতা বিমানবন্দরে সত্যজিৎকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য। সে এক অভাবনীয় ঘটনা।
লেক টেম্পল রোডের বাসায় সবার সঙ্গে 'পথের পাঁচালী', 'অপরাজিতা' সম্পর্কে নানা ধরনের আলাপ আলোচনাই হতো। কিন্তু এড়ষফবহ খরড়হটা একদিনও নজরে পড়েনি। সত্যজিৎ তাঁর স্বাভাবিক প্রবণতায় পদক জাতীয় জিনিস উরংঢ়ষধু করতেন না। বৌদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একদিন এড়ষফবহ খরড়হ সংশিস্নষ্ট নেপথ্যকাহিনী আমাকে শোনালেন। পদকটি বাড়িতে আসার পর দীর্ঘদিন বাইরেই ছিল। বহু দর্শনাথর্ী আসতেন এবং দেখতেন। 'পথের পাঁচালী' নির্মাণের সময় আর্থিক কারণে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে সোনার গহনাপত্রও বিক্রি করতে হয়েছিল_সে কথা আজ অনেকেরই জানা। অনেক দিন পর দু'-একটা গহনা আবার নতুন করে তৈরি করার আগ্রহে বাড়িতে শ্যাকড়া ডাকা হলো। গহনা সংশিস্নষ্ট আনুষঙ্গিক নানা কথা প্রসঙ্গ শেষে কৌতূহলবশত বহুল আলোচিত সিংহমূর্তিটি তাকে দেখিয়ে প্রশ্ন করা হলো : 'এবারে বলুন কিসের তৈরি এটি?' কষ্টিপাথরে দু'-এক ঘষা দিয়েই উত্তেজিত শ্যাকড়া মশায় বলেন : 'করেছেন কী? এ যে সলিড গোল্ড! এখনি সিন্দুকে ভরে ফেলুন।'
গুরম্নত্বর অসুস্থ হয়ে পড়ার প্রাক্কালে ফরাসী রাষ্ট্রপতি ফ্রাসোয়া মিতেরাঁ স্বয়ং কলকাতায় এসে সত্যজিৎকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান 'লিজিয়ন অব অনার' পেঁৗছে দিয়ে যান। সেও এক দুর্লভ সম্মান।
আরেকটি পুরস্কার যা চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তাঁর সামগ্রিক শিল্পকৃতির মর্যাদাস্বরূপ প্রদত্ত সেই অস্কার পদকটির কথাও বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য। অস্কারপ্রাপ্তির সংবাদে খুশি হয়ে সত্যজিৎ বলেছিলেন : 'শেষে অস্কারটাও এলো। তাহলে তো পুরস্কারের আর কিছু বাকি থাকলো না।' অস্কারকে সত্যজিৎ সিনেমার নোবেল পুরস্কারের সঙ্গেও তুলনা করেছেন।
হলিউডে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কারটি গ্রহণ করার কথা থাকলেও দুর্ভাগ্যবশত দুরারোগ্য রোগে আক্রানত্ম হয়ে কিনিকে শয্যাশায়ী থাকার কারণে অস্কার কমিটি আনত্মরিক শ্রদ্ধাবশত উচ্চপদস্থ তিনজন প্রতিনিধি মারফত হাসপাতালেই সত্যজিতের হাতে পদকটি তুলে দেবার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
মনে পড়ে, পদকটি হাতে নিয়ে সত্যজিৎ বলেছিলেন : 'অস্কারটা বেশ ভারি।' ভারি হওয়ার আসল কারণ সীসার তৈরি বলে। পদকটির গায়ে সোনার প্রলেপ বিধায় দেখতে সোনার মতো মনে হলেও ঝড়ষরফ এড়ষফ নয়। দামী ধাতু নির্মিত পদকের মূল্যমানের সঙ্গে পুরস্কারের গৌরবের সম্পর্কের কথা অস্কার প্রবর্তকগণ মনে করেন না তাই এ ব্যবস্থা।
বিশ্বব্যাপী যে পদক বিষয়ে এত কথা লেখা হয়, এত কিছু বলা হয়, এত কথা শুনি আমরা, কল্পনার দুর্লভ সেই বসত্মটিকে একবার ছুঁয়ে দেখাও তো ভাগ্যের ব্যাপার! প্রথম দেখে ও হাতে তুলে নিয়ে তাই নিজেকে ধন্য মনে করেছি।
ভারি তো বটেই, পদকটি ভীষণ চকচকে। এই চাকচিক্যময় অবয়বকে ভিত্তি করে ক্যামেরার কৌশলে যদি আলোর বিচ্ছুরণ ঘটানো যায় তাহলে হয়ত তা প্রতিভার দু্যতিময় প্রতীকী ব্যঞ্জনার চিত্ররূপ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে সেই ভরসায় সাধ্যমতো তিন দিন ছবি তুলেছিলাম। কিভাবে ছবি তোলা যায় ভেবে কিছুটা বিব্রতবোধ করলাম এই জন্যে যে, একমাত্র যাঁর হাতে পদকটি মানায় সেই প্রতিভাধর ব্যক্তিটি আর নেই_এই কথা ভেবে। ছবি তোলার এই সমস্যার কথা পূর্বাহ্নেই অনুমান করে ঢাকা থেকে সত্যজিতের একখানা ফটোগ্রাফ সঙ্গে এনেছিলাম যার সামনে পদকটি রেখে ছবি তুললে কাঙ্ৰিত ফল লাভ কিছুটা হলেও হতে পারে।
-প্রকাশিতব্য গ্রন্থের
অংশবিশেষ।

No comments

Powered by Blogger.