দুর্নীতি- শুধু বলরাম কেন চড় খাবে? by আলী ইমাম মজুমদার

মাননীয় অর্থমন্ত্রী অতি সম্প্রতি হলমার্ক গ্রুপসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতিমূলক ঋণ বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত ঋণকে বড় অঙ্কের অর্থ নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, সংবাদমাধ্যম এটা নিয়ে অতিরিক্ত প্রচারণা করে দেশের ক্ষতি করছে।
এ টাকার সিংহভাগ সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে নেওয়া। আর এ ঋণকে কেন্দ্র করে সোনালী ব্যাংক বোর্ড ভেঙে দেওয়া-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রস্তাবকে তিনি ‘এটা তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত’ বলে বিতর্কের ঝড় তুলেছেন। এই আর্থিক লেনদেনকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দ্রুততার সঙ্গেই তদন্ত শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে বিশদ আলোচনার আগে সাম্প্রতিক কালের দুর্নীতিঘটিত আরেকটি ঘটনা পাঠকের সামনে আনতে চাই।
মাননীয় যোগাযোগ ও রেলপথমন্ত্রী তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রায়ই রাস্তাঘাট ও রেলযোগাযোগব্যবস্থা তদারক করতে গোটা দেশে অবিরাম ছুটছেন। সম্প্রতি দেশের উত্তরাঞ্চলে মন্ত্রী গিয়েছিলেন রেলযোগাযোগের তদারকিতে। সফরটি নতুন একটি মাত্রা লাভ করে। রেলওয়ের বলরাম নামের একজন অ্যাটেনডেন্টকে যাত্রীদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে মন্ত্রী চপেটাঘাত করে বসেন। বিষয়টি শুধু আইনের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্যই নয়, অশোভনও বটে। পরদিন অবশ্য তিনি ভুল বুঝতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রীর মর্যাদা, সরলতা ও ভালো কাজ করার জন্য তাঁর ব্যাঘ্রতা বিবেচনায় বিষয়টির এখানেই ইতি ঘটতে পারে। কিন্তু জিজ্ঞাসা থেকে যাবে, বলরাম কত টাকা ঘুষ খেয়েছিল? তার পদ ও ক্ষমতা বিবেচনায় আমার মনে হয়, সাকল্যে সেদিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা হতে পারে। এর ভাগও হয়তো বা অন্য আরও দু-একজনকে দিতে হতো। হয়তো বা সে প্রায়ই এরূপ ঘুষ নেয়। তা যোগ করলেই বা কত দাঁড়াবে? কেউ মনে করতে পারেন, আমি বলরামের পক্ষ নিচ্ছি। আদৌ তা নয়। এ ধরনের বলরামদের জন্য রেলে চড়তে আমরা অনেক সময়ই বিড়ম্বনায় পড়ি। কমবেশি যা-ই হোক, ঘুষ গ্রহণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে এটুকু তো বলতে পারি, চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ যদি বড় অঙ্কের না হয়, তা হলে বলরামের দুর্নীতিটি হিসাবেই আসার কথা নয়।
ভুয়া কাগজপত্রে জালিয়াতির মাধ্যমে বড় অঙ্কের আলোচিত ঋণটি এ দেশের ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি বলে গণমাধ্যমে অভিযোগ আসছে। এ ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে বেশ কয়েক ধরনের ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারেন। যেমন—ঋণ গ্রহণকারী মূল ব্যক্তিরা, ব্যাংক কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট শাখায় যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে ঋণ মঞ্জুরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যাঁরা জড়িত অনুমোদনের সঙ্গে, সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তার চেষ্টা ছিল ঘটনাটি চাপা দিয়ে রাখার, যাঁরা দূরনিয়ন্ত্রণে বিষয়টি প্রভাবিত করেছেন আর যাঁদের প্রশ্রয়ে চক্রটি দুঃসাহসী হয়েছে। দুদকের তদন্ত চলছে সবার বিরুদ্ধে। এটা যথেষ্ট দীর্ঘায়িত হতে বাধ্য। সন্দিগ্ধ যাঁরা, তাঁদের প্রথম দুটো শ্রেণী চিহ্নিত। ব্যাংকিং সেক্টরের এ চাঞ্চল্যকর ঘটনা দ্রুত কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দেশবাসীকে কিছুটা আশ্বস্ত করত। ভীত হতেন—এ ধরনের প্রয়াসে আরও যাঁরা রত আছেন, তাঁরা। দ্রুত মামলা দায়ের এবং ইতিমধ্যে চিহ্নিত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার কি খুব কড়াকড়ি হয়ে যাবে? জাতীয় সংসদের কতিপয় প্রবীণ সদস্য এই দাবি করেছেন। অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের কে জেনেশুনে অন্যায় করেছেন এবং ঘটনা চেপে রাখার চক্রান্তকারীদের অনুসন্ধান করে চিহ্নিত করতে কিছুটা সময় লাগবে। তখন তাঁদের অভিযোগভুক্ত করা যাবে। এরূপ মামলা হয়ে সাজা হওয়ার অনেক দৃষ্টান্তই আছে। আর দূরনিয়ন্ত্রণে প্রভাব সৃষ্টিকারী আর প্রশ্রয় দানকারীদের, আমাদের দেশে সংঘটিত এ ধরনের অর্থনৈতিক অপরাধে তদন্তকারী ব্যক্তিরা খুঁজে বের করার সাহসই পাবেন না, যেমনটা অতীতেও পাননি। তবে সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে চাইলে সেটাও অসম্ভব হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অর্থমন্ত্রী যেভাবে বিষয়টি দেখছেন, এতে এটুকু আশা করা অর্থহীন। প্রথম চারটি গ্রুপের লোকদের যদি সঠিকভাবে শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে যথোপযুক্ত সাজা দেওয়া যায়, তাহলে এ ধরনের ঘটনা অপরাধীদের কিছুটা হলেও সতর্কসংকেত দেবে।
অর্থমন্ত্রী মেধা ও মননে বর্তমান মন্ত্রিসভার অন্যতম সেরা ব্যক্তি। সরকারি দায়িত্বে থেকে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণের কোনো অভিযোগ নেই তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি কেন এ ধরনের বেশ কিছু ক্ষেত্রে চরম বিতর্কিত বক্তব্য দেন, তা বোধগম্য নয়। শেয়ারবাজার ধসে তাঁর বক্তব্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে সন্দিগ্ধ অপরাধীদের বিরুদ্ধে তিনি কোনো ব্যবস্থাই নেননি। আলোচিত ব্যাংকঋণ সম্পর্কে তাঁর দুটো বক্তব্যই নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে জনগণকে। অবশ্য পরে তিনি বলেছেন, এ টাকা উদ্ধার ও অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। এ ঘটনায় গণমাধ্যমের ভূমিকাকে কেন তিনি নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন, তা-ও আমাদের বোধগম্য নয়। এ গণমাধ্যমই তো ঘটনাটি জনসমক্ষে এনে কিছুটা সতর্কসংকেত দিচ্ছে অপরাধীদের। তারা ব্যাংকিং সেক্টর তথা দেশের শুভাকাঙ্ক্ষী বলেই বিবেচিত হওয়া উচিত। অর্থমন্ত্রীর বিভিন্ন বক্তব্যে এত বৈপরীত্য থাকা সত্ত্বেও প্রশংসনীয়ভাবে আমরা দেখি, তিনি পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আবেগাশ্রয়ী পথে না গিয়ে একটি বাস্তবসম্মত সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন। তাঁর কার্যক্রমে এ বৈপরীত্য আমাদের আশাহত ও ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষুব্ধ করে।
সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো থেকে সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী ব্যক্তিদের ফায়দা লোটার ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেনি। অনেক আগে থেকেই এসব ঘটে চলছে। এমনকি সামরিক শাসকেরা যখন রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তাতে যোগদানকারী ব্যক্তিদের অন্যতম আকর্ষণ বা ক্ষেত্রবিশেষে প্রলোভন বা শর্ত থাকে এ ধরনের ঋণ পাইয়ে দেওয়ার। সরকারের আশীর্বাদধন্য লোকদের অনেকেই তা পরিশোধ করেন না। বেনামিতে এ ধরনের ঋণখেলাপিরা কেউ কেউ বেসরকারি ব্যাংকের মালিক হয়ে গেছেন। খুব কম ক্ষেত্রেই এ ধরনের ঘটনায় ন্যায়সংগত প্রতিকার পাওয়া গেছে। কয়েক বছর আগে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের উদ্যোক্তারা প্রায় ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিলে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়, বরখাস্ত করা হয় এমডিকে আর পুনর্গঠিত হয় ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক বসিয়ে ব্যাংকটিকে নতুনভাবে চালুর ব্যবস্থা নেয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের টাকা হাতিয়ে নেওয়া ব্যক্তিরা পার পেয়ে যান সহজবোধ্য কারণেই। যথোপযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ ও তাঁর সঙ্গে নিষ্ঠাবান ব্যাংক কর্মকর্তা যুক্ত না থাকায় মামলাগুলোর রায়ও প্রায়ই ব্যাংকের বিপক্ষে যায়। এ যেন ইচ্ছা করেই ওয়াকওভার দেওয়া বা পাতানো খেলা। এতে আত্মসাৎকারীদের লোভ দিনে দিনে বাড়ছে। তাঁরা গ্রহণ করছেন নতুন নতুন প্রক্রিয়া। সহায়তাকারী ব্যক্তিও থাকেন ব্যাংকের ভেতরে-বাইরে। হয়তো বা তাঁরা নিজের গরজেই তাঁদের ডেকে নিয়ে আসেন।
তবে এবারের ঘটনাটি আকৃতি ও প্রকৃতির বিবেচনায় অতিমাত্রায় সংবেদনশীল ও চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী। এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি এবং এসব টাকা উদ্ধার অতি যৌক্তিক একটি দাবি। এটা বড় দুর্নীতি নয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনটি তাদের আওতাবহির্ভূত বলে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য প্রচলিত আইন ও বাস্তবতার নিরিখে অগ্রহণযোগ্য ও বেদনাদায়ক। তাঁর এই বক্তব্য বিষয়টির তদন্তকে প্রভাবান্বিত করতে পারে বলে কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করলে অযৌক্তিক বলা যাবে না। সরকার না চাইলে দুদক শত সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি নিয়ে অগ্রসর হয়ে তেমন ফলপ্রসূ প্রতিকার করতে পারবে না।
তাই উল্লিখিত ঘটনার দিন সম্ভাব্য ২০০ বা ৩০০ টাকা ঘুষ গ্রহণের দায়ে রেল কর্মচারী বলরামকে যাত্রীদের অভিযোগে যোগাযোগমন্ত্রী চপেটাঘাত করলেন। এটা আইন বা বিধিসম্মত কিংবা শোভন নয় বটে। তবে অর্থমন্ত্রীর সংস্কৃতি অনুসরণ করলে এ মন্ত্রীও যাত্রীদের অভিযোগের মুখে বলতে পারতেন, গরিব কর্মচারী ১০ বা ২০ টাকা ঘুষ নিতেই পারে। কিন্তু অভিযোগটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে হয়তো বা আবেগতাড়িত হয়েই মন্ত্রী একটি শাস্তি দিয়ে ফেলেছেন। আইনি রাস্তায় গেলে বলরাম চাকরি হারাত আর জেলও খাটত। ঘুষ গ্রহণ মামলা মোকাবিলা করতে গিয়ে হয়তো বা ভিটেমাটিও বেচে দিতে হতো—অবশ্য তা যদি বলরামের থেকে থাকে। কিন্তু চার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি ঋণের বিষয়টি অর্থমন্ত্রী বলতে গেলে সূচনাতেই উপেক্ষা করেছেন। এতে অপরাধীরা আইনের আওতায় আসবেন আর টাকা উদ্ধার হবে। অর্থমন্ত্রীর পরের দিনের এ বক্তব্য বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে ধারণা করলে দোষ দেওয়া যাবে না। তা হলে ২০০ বা ৩০০ টাকা আর সারা জীবনে হয়তো বা কয়েক হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে বলরামরা চড় খাবে কেন? আইন কি তা হলে এখানে নিজস্ব গতিতে চলবে না? যেমনটা চলেনি শেয়ারবাজার যাঁরা লুণ্ঠন করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে। এ ধরনের অপরাধীদের চড় দেওয়ার আইন থাকলেও (আমি এ ধরনের আইনের সমর্থক নই) তা হলে কী পরিমাণ চড় তাঁদের দিতে হতো, টাকার অঙ্কের হিসাবে গুণিতকভাবে তার হিসাব করা খুবই কঠিন। আর সে ধরনের চড় দেওয়ার জন্য মাইনে দিয়ে কত কর্মচারী রাখতে হতো, তা-ও আমি হিসাব করে রাখতে পারছি না। তবে আইনে এসব অপরাধে যে শাস্তি বিধিবদ্ধ রয়েছে, তা যথাযথ ও ত্বরান্বিত করার জন্য দুদকের পাশাপাশি সরকারের সদিচ্ছা আমাদের কাম্য। এ ঘটনা ধামাচাপা দিলে এ ধরনের আর্থিক সন্ত্রাস যাঁরা করছেন, তাঁদের প্রশ্রয় দিয়ে সাময়িকভাবে পার পাওয়া গেলেও অনাগত ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে। আর গুটিকয়েক টাকা ঘুষ গ্রহণের জন্য চপেটাঘাত খাবে শুধু বলরামরা। তবে একদিন তারা সংঘবদ্ধ হয়ে বলতে পারে, শুধু বলরাম চড় খাবে কেন? এ ধরনের অনেক বড় অপরাধীদেরও চড় দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। তখন?
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

No comments

Powered by Blogger.