প্রসঙ্গ ইসলাম 0 সরল জীবন সুন্দর জীবন by অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

সুন্দর জীবনের জন্য প্রয়োজন সরল জীবন। অল্পে তুষ্টি সরল জীবনের জন্য অপরিহার্য। পৃথিবীতে যে মানুষটি এলো সে ধীর লয়ে বড় হতে হতে দেখতে দেখতে নির্দিষ্ট বয়সে উপনীত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো_ এটাই তো বাস্তবতা, এটাইতো সত্যি। এই বাস্তবতাকে এই সত্যকে অস্বীকার করার কোন জো নেই।
জীবনের পরতে পরতে সময়কে অতিক্রম করতে হয় মৃতু্যর দোরগোড়ায় পৌঁছার জন্য। মানুষের পার্থিব জীবনের মেয়াদকাল খুবই সীমিত। মানবজীবনের মেয়াদের অবসান ঘটে মৃতু্যর মধ্য দিয়ে। মৃতু্য মানে জীবনের অপর পারে যাবার সেতু। মৃতু্যর মধ্য দিয়ে আখিরাতের জীবনে প্রবেশ ঘটে।
প্রিয় নবী সরকারে দো আলম নূরে মুজাসসম হয়রত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : পৃথিবীটা আখিরাতের শস্যত্রে। পৃথিবীতে সৎকর্ম করো যাতে আখিরাতে পুণ্যের ফসল কাটতে পারো।
জীবন সম্পর্কে কবি উমর খৈয়ামের একটি রুবাই-এর মধ্যে সুন্দর ব্যাখ্যা রয়েছে। কবির সেই রুবাই-এর বাংলা তরজমা এই রূপ : জ্ঞানী-গুণীদের বাদ দিয়ে এই বুড়ো খৈয়ামের কাছে এসো/ একটা জিনিস নিশ্চিত জেনো যে, জীবন আছে/একটা জিনিস নিশ্চিত জেনো যে, জীবন উড়ে যায়।...
পৃথিবীর এই ণস্থায়ী জীবনকে সহজ-সরলভাবে কাটিয়ে দেয়ার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সুখ। সৎচিন্তা ও সৎকর্মের দ্বারা সুশোভিত করার মধ্যেই রয়েছে জীবনের সত্যিকার সার্থকতা। মানবিক মূল্যবোধ বিকশিত হয় সহজ-সরল জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে। সহজ-সরল জীবন মানুষকে আদর্শবান করে তোলে। একজন ন্যায়পরায়ণ, সত্যনিষ্ঠ, প্রজ্ঞাবান এবং প্রকৃত সংযমী মানুষের নিকট পার্থিব জীবনের বিলাস-ব্যসন, ঐশ্বর্য ইত্যাদি আকর্ষণীয় হতে পারে না। পার্থিব জীবন কর্মের জীবন, আমল করার জীবন। যে যতো নেক আমল করবে সে ততো সফলতা হাসিল করতে পারবে। জীবনের নানামাত্রিক গতি এক মোহনায় স্থিত হতে পারে সৎ কর্ম করার মাধ্যমে। সৎকর্মের দ্বারা মানুষ মানবতার মঞ্জিলে উপনীত হতে পারে।
পার্থিব জীবনে মানুষ নিজেকে ইনসানে কামিল বা পূর্ণ মানব পর্যায়ে পৌঁছতে পারে তখনই যখন সে আল্লাহর খাস বান্দা হয়ে যায়। আল্লাহর কুরবত ও রিযামন্দী তথা আল্লাহর নৈকক্র ও সন্তুষ্টি হাসিল করার মধ্য দিয়েই মানুষ সার্থক জীবনের আস্বাদন লাভ করতে পারে।
আল্লাহকে হাজির-নাযির জেনে যে মানুষ নিজের জীবনকে আল্লাহর রাহে পরিচালিত করে সে মানুষ প্রকৃত অর্থেই মানবতার গুণ হাসিল করতে সমর্থ হয়। ইলমে তাসাওউফের বিভিন্ন সবক যোগ্য পীরের প্রত্য তত্ত্বাবধানে অনুশীলন করতে পারলে নিজেকে নূরের বিভায় উদ্ভাসিত করা যায়।
আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, আমাদের এ পৃথিবী থেকে আগে হোক পরে হোক চলে যেতে হবে অন্যলোকে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে: হুয়াল্লাযী খালাকাকুম্ মিন তীনিন ছুম্মা কাদা আজালা-ওয়া আজালুম মুসাম্মান 'ইনদাহূ ছুম্মা আনতুম তামতারূন_ তিনি (আল্লাহ)-ই তোমাদেরকে মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর এক কাল (আজালা) নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, আর একটি নির্ধারিত কাল আছে যা তিনিই জানেন, এতদসত্ত্বেও তোমরা সন্দেহ করো। (সূরা আন'আম : আয়াত ২)।
সূরা আন'আমের ঐ আয়াতে কারীমায় স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে মানুষের জন্ম হয়, তারপর তাকে এই পৃথিবীতে মানুষের জীবন বা আয়ুষ্কাল আল্লাহ জাল্লা শানুহু নির্ধারণ করে দেন। সূরা ইমরানের ১৪৫ নম্বর আয়াতে কারীমায় ইরশাদ হয়েছে : ওয়ামাকানা লিনাফসিন আন তামূতা ইল্লা বিইয়তিল্লাহি কিতাবাম মুআজ্জালা_ আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কারো মৃতু্য হতে পারে না, যেহেতু তার মেয়াদ অবধারিত।
সহজ-সরল জীবন যাদের তাদের মনন পরিচ্ছন্নতার দ্বারা বিকশিত হয়। তাদের চাওয়া-পাওয়ার মাত্রা বেশি হয় না। তারা অল্পেই তুষ্ট থাকে। ইলমে তাসাওউফে কানায়াত বা অল্পে তুষ্টির ফয়েজ বা প্রাচুর্য প্রবাহ লাভ করার জন্য একটি বিশেষ মুরাকাবা রয়েছে। এই সবক অনুশীলন করে এক অনন্য জীবনানুভূতি লাভ করা সম্ভব হয়, যা সরল জীবন গড়ে তোলে।
এখানে উল্লেখ্য, যারা তাকওয়া অর্থাৎ সাবধানতা ও সংযম অবলম্বন করে তারা পাপ-পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে অনায়াসে। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত উবায় ইবনে কা'ব রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহুর নিকট হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু তাকওয়ার সংপ্তি ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন : আপনি কি কখনো কণ্টকাকীর্ণ রাস্তা পাড়ি দিয়েছেন?
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন: হঁ্যা। হযরত উবায় ইবনে কা'ব রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু আবার জিজ্ঞাসা করলেন : আপনি সেই কন্টকাকীর্ণ রাস্তা কিভাবে পাড়ি দিয়েছিলেন?
হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু : আমি সাবধানতা অবলম্বন করে দ্রুতগতিতে ঐ রাস্তা অতিক্রম করেছিলাম। হযরত উবায় ইবনে কা'ব (রাদি) বললেন : এটাই তাকওয়া।
প্রিয় নবী সরকারে দো আলম নূরে মুজাসসম হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলায়হি ওয়া সাল্লাম খুবই সহজ-সরল জীবন নির্বাহ করতেন। তাঁর পবিত্র জীবনে আড়ম্বরের কোনই লেশ ছিল না। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত 'আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস'উদ রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন : আমি একদিন হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলায়হি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে দেখলাম যে, তিনি একটা খেজুরের মাদুরের ওপর শুয়ে আছেন। মাদুরের দাগ তাঁর পবিত্র দেহে (জিস্ম মুবারক) লেগে গেছে। আমি বললাম : হে আল্লাহর রসূল! আপনি যদি ইজাজত দেন তাহলে এর উপর আমি কিছু বিছিয়ে দেই। এ কথা শুনে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু 'আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন: পার্থিব বিষয়-বৈভব দিয়ে আমি কী করবো? একজন মুসাফির দীর্ঘ পথ চলতে চলতে ণিকের জন্য গাছের ছায়া বসে। পরণেই সে তা পরিত্যাগ করে চলে যায়। পৃথিবীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো সেই রকমই। (তিরমিযী শরীফ)।
হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন : আমি একদিন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু 'আলায়হি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাাত করতে গিয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে অবলোকন করলাম যে, তাঁর দেহ মুবারকে একখানা অতি সাধারণ চাদর রয়েছে, ঘরে একখানা বিছানাবিহীন খাটিয়া রয়েছে যার উপর খেজুরের অাঁশ ভরে তৈরি একটা বালিশ রয়েছে। ঘরের এক কোণে সামাণ্য কিছু যব রাখা একটা পাত্র রয়েছে। তাঁর কদম মুবারকের দিকে রয়েছে একটা পশুর চামড়া এবং মস্তক মুবারকের দিকে লটকানো রয়েছে একটি পানির মশক। এই অবস্থা দেখে আমার দুই চোখে অাঁসু এসে গেল। আমাকে কাঁদতে দেখে তিনি আমার এই ক্রন্দনের কারণ জানতে চাইলেন। আমি বললাম : হে আল্লাহর রসূল! আমি কেন কাঁদবো না! যে দড়ি দিয়ে আপনার খাটিয়াখানা বানানো হয়েছে তা আপনার পবিত্র দেহে গভীর দাগ করে দিয়েছে। আপনার এই ছোট্ট কটি কতোটুকুই বা বসবাসযোগ্য। পারস্য সম্রাট কিসরা এবং রোম সম্রাট কায়সার এক আল্লাহর ইবাদত করে না অথচ তারা পার্থিব বিলাস-ব্যসনে ভাসছে। আর আল্লাহর রসূল হওয়া সত্ত্বেও আপনি এই ধরণের সাধারণ জীবন যাপন করছেন; তা কি সহ্য করা সম্ভব? হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) এ কথা শুনে বললেন : হে ইবনে খাত্তাব! এটা কি তুমি পছন্দ করো না যে, ওরা পার্থিব জীবনে ভোগ করবে আর আমি আখিরাতে? (বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ)।
ইসলামে বৈরাগ্য সাধনের অনুমোদন নেই এটা যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি অল্পে তুষ্ট থেকে সরল জীবন যাপনের তাকিদ দেয় ইসলাম। ইসলাম হচ্ছে আসসিরাতুল মুস্তাকীম অর্থাৎ সহজ সরল পথ।
লেখক : উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আঞ্জুমানে তোয়াজিয়া, সাবেক পরিচালক, ইলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।

1 comment:

  1. webwinkel beginnen product webwinkel beginnen groothandel

    Feel free to visit my blog; Webwinkel beginnen ervaring

    ReplyDelete

Powered by Blogger.