বেসামরিক বিমান চলাচল- কালো তালিকা থেকে বাংলাদেশের মুক্তি by আলমগীর সাত্তার

বাংলাদেশের আকাশ পরিবহন বিষয়ে বহুদিন পর কিছু ভালো কথা লেখার সুযোগ পাচ্ছি। তিন বছর ধরে আমাদের বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা বা সিভিল এভিয়েশন বিভাগ আইকাওয়ের মূল্যায়নে এসএসসি (সিগনিফিকেন্ট সেফটি কনসার্ন) বা কালো তালিকাভুক্ত ছিল।
সম্প্রতি আমাদের সিভিল এভিয়েশন বিভাগ ওই তালিকাভুক্তি থেকে মুক্তি লাভ করেছে। সঠিক সময়ে এ সংবাদ আমাদের দেশের প্রতিটি পত্রিকা গুরুত্বসহকারেই প্রকাশ করেছে। তবু সব পাঠক এমন একটি অর্জন বা সাফল্যের গুরুত্ব সম্পূর্ণ অনুধাবন করতে পেরেছেন কি না জানি না। দেরিতে হলেও আমাদের সিভিল এভিয়েশন বিভাগের এ সাফল্য সম্পর্কে আমি বিস্তারিত লিখছি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা আনার জন্য ৫০টি দেশ মিলে গঠন করল ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও) নামের সংগঠন। বর্তমানে এ সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ১৯২। বলা যায়, বিশ্বের প্রায় সব দেশের বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা এ সংগঠনের সদস্য।
আইকাও স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রিকমেনডেড প্র্যাকটিসেস রুল নাম দিয়ে বিধিবিধান তৈরি করে সদস্যভুক্ত বেসামরিক বিমান চলাচল বিভাগের কাছে সরবরাহ করে। ওই বিধিবিধান অনুসরণ করে সদস্য সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ নিজ নিজ দেশের জন্য বিমান চলাচলের আইনগুলো তৈরি করে। সিভিল এভিয়েশন বিভাগ আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। তাই তাদের তৈরি আইন হলো রাষ্ট্রীয় আইন। ওই আইন সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ কেন, তাদের বিভাগীয় মন্ত্রীও লঙ্ঘন করতে পারেন না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নিজেদের তৈরি আইনকে সিভিল এভিয়েশন বিভাগের মধ্যম মানের কর্মকর্তারাও অহরহ এযাবৎ লঙ্ঘন করে আসছিলেন। এ কারণেই আমাদের এসএসসি ক্যাটাগরির গ্যাঁড়াকলে পড়তে হয়েছিল।
সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর এয়ারলাইনসগুলোকে যথাযথভাবে আইন মান্য করে চলতে বাধ্য করার দায়দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশন বিভাগের। এ ব্যাপারে কোনো শৈথিল্য প্রদর্শন করা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখেন আইকাও প্রতিনিধিরা। এ প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর আঞ্চলিক অফিস আছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য আইকাওয়ের আঞ্চলিক অফিস আছে কাঠমান্ডু, ব্যাংকক ও শ্রীলঙ্কার কলম্বো শহরে। ওই সব আঞ্চলিক অফিস থেকে মাঝেমধ্যে আইকাও প্রতিনিধিরা এসে পর্যবেক্ষণ বা নথিপত্র অডিট করেন আমাদের সিভিল এভিয়েশন বিভাগের।
যেসব এয়ারলাইনস আইন লঙ্ঘন করে, তাদের কালো তালিকাভুক্ত না করে আইকাও সিভিল এভিয়েশন বিভাগকে কালো তালিকাভুক্ত করে কেন? এর উত্তর হলো, অনেক দেশেই ৩০-৪০টি এয়ারলাইনস আছে। তাই আইকাওয়ের প্রতিনিধিদের পক্ষে প্রতিটি এয়ারলাইনসের কার্যক্রম, অনিয়ম—সবকিছু আলাদাভাবে খতিয়ে দেখা সম্ভব নয়। তাই তাঁরা দেখেন, আইন ভঙ্গকারী এয়ারলাইনসগুলোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশের সিভিল এভিয়েশন বিভাগ কী এবং কেমন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে?
বিমানের পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান চেয়ারম্যান একসময় আমাদের বিমানবাহিনীর প্রধান ছিলেন। পদমর্যাদায় তিনি এয়ার মার্শাল। তাই তিনি যদি সিভিল এভিয়েশন বিভাগের বড় বড় কর্মকর্তাকে (আইনকানুনের ব্যাপারে) উপেক্ষা করেন, তবু ওই সব কর্মকর্তা নিশ্চুপই থাকেন। ওই সব কর্মকর্তা তাঁর অন্যায় আবদারও রক্ষা করেন। ২০১০ সালের একটি ঘটনার কথা দেশবাসী নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। তখন একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের উড়োজাহাজ লিজ নেওয়া এবং লিজের সময় বাড়ানোর ব্যাপারে বিমানের চেয়ারম্যান অনেক বিতর্কের সৃষ্টি করেন। তখন ব্যাপারটা নিয়ে তখনকার বিমানমন্ত্রী জি এম কাদেরের সঙ্গে চেয়ারম্যানের তীব্র মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে আমরা দেখলাম, জি এম কাদেরকে বিমান মন্ত্রণালয় থেকে সরে যেতে হলো।
এমন শক্তিমানদের অসন্তুষ্ট করার মনোবল ছিল না সিভিল এভিয়েশন বিভাগের বড় বড় কর্মকর্তার।
বিমান ও সিভিল এভিয়েশন বিভাগের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি করার অনেক সুড়ঙ্গ পথ জানা আছে। অমন সুড়ঙ্গপথে সুযোগ-সুবিধা, অর্থকড়ি আদান-প্রদান হয় বলে বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা বিমানসহ ছোট-বড় এয়ারলাইনসের বিরুদ্ধে অবৈধ কাজ করার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি; বরং সুযোগ করে দিয়েছে। আইকাও প্রতিনিধিদের কাছে এসব অনিয়ম গোপন করা যায়নি বলেই আমাদের কালো তালিকাভুক্ত হতে হয়েছিল। ওই তালিকা থেকে মুক্ত হতে না পারলে ইউরোপ, আমেরিকাসহ অনেক দেশে আমাদের ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যেতে পারত।
সিভিল এভিয়েশন বিভাগে ফ্লাইং ইন্সপেক্টর নাম দিয়ে চারজন পরামর্শক আছেন। এঁদের মধ্যে ক্যাপ্টেন রফিউল হক, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ বীর উত্তম, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন—এই তিনজনের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। এঁরা বাংলাদেশ বিমানে আমার সতীর্থ ছিলেন। এই তিনজন সম্পর্কে আমি বলতে পারি যে বাংলাদেশে এঁরাই অভিজ্ঞতম এভিয়েশন-সংক্রান্ত ব্যাপারে। নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এঁরা এর আগে নিজেদের মতো করে কাজ করার সুযোগ পাননি।
অন্যদিকে সিভিল এভিয়েশন বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদ হাসান তাঁর অধীন পরামর্শকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন, উৎসাহিত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি আইকাও প্রতিনিধিদের সঙ্গে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। কনসালট্যান্টদের একটানা পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা এবং চেয়ারম্যানের সহযোগিতার কারণে আইকাও সদর দপ্তর মন্ট্রিয়ল থেকে ১৯ জুলাই ২০১২ তারিখে জানানো হয় বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন বিভাগ এসএসসি ক্যাটাগরি থেকে মুক্ত। আমাদের দেশের অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির ওপর থেকে এমনিভাবে কালো তালিকাভুক্তির জগদ্দল পাথরটি নেমে যায়।
এ বিষয়ে আরও কিছু তথ্য দিচ্ছি, অ্যাপর‌্যাস্ট (এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনাল এভিয়েশন টিম) আইকাওয়ের অঙ্গসংগঠনের মূল্যায়ন অনুযায়ী বাংলাদেশকে এসএসসি ক্যাটাগরিভুক্তি বলে ঘোষণা করা হয় ২০০৯ সালে। ফিলিপাইনকে ওই একই ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয় ২০০৬ সালে। চেয়ারম্যান মাহমুদ হাসান এবং তাঁর সহযোগী কনসালট্যান্টদের মেধা ও প্রচেষ্টার ফলে অল্প দিনেই আমরা ওই ক্যাটাগরি থেকে মুক্তিলাভ করতে সক্ষম হই। ফিলিপাইন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে বিদেশ থেকে এভিয়েশন-বিশেষজ্ঞ এনে কাজ করেও এখনো ওই কালো তালিকাভুক্ত হিসেবে রয়ে গেছে।
সিভিল এভিয়েশন বিভাগের পরামর্শকদের ধন্যবাদ দেওয়ার পাশাপাশি এটা স্বীকার করতেই হবে যে চেয়ারম্যান মাহমুদ হাসান এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন না করলে কাজটি কঠিন হতো।
 আলমগীর সাত্তার: লেখক ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পাইলট।

No comments

Powered by Blogger.