মাদ্রিদে তিন বাঙাল by মুনতাসীর মামুন

(পূর্ব প্রকাশের পর) ৭ প্রদর্শনী দেখে কাইয়া ফোরামের সামনের ফুটপাথে দাঁড়ালাম। রোদ গনগনে। শুকনো রোদ, ব্রহ্মতালুতে এসে আঘাত করে। আর এরা বলে কি না মনোরম সামার। না, সেটাও বোধহয় ঠিক নয়। তা হলে স্পেনে দুপুর বেলাটা জাতীয় 'সিয়েসত্মা' হিসেবে পালন করা হতো না।


দুপুরে খাঁটি স্পেনীয়রা বেরোয় না। সে সময় নিদ্রা যায় অথবা ঝিমোয়। এটাই সিয়েসত্মা। তাপ কমলে বেরোয়।
এখন সিয়েসত্মার সময়। রাসত্মাঘাট অনেকটা ফাঁকা। আমাদের মতো টু্যরিস্টরাই আনাগোনা করছে। েিদ পেয়েছে প্রচ । কোন্ দিকে যাই_ পুবে, না পশ্চিমে? পশ্চিমে যেহেতু স্টেশন সেদিকেই রওয়ানা হলাম। স্টেশনের কাছেই রেসত্মোরাঁ-টেসত্মোরাঁ থাকার কথা বেশি। অনুমানটা মিলে গেল। ফুটপাথজুড়ে রেসত্মোরাঁ। কাঁচের জানালায় বা দরজায় মেনু টাঙানো। টু্যরিস্টদের ভিড় বাড়ছে। রোদ থেকে বাঁচার জন্য ও একই সঙ্গে পেট শানত্ম করার জন্য আশ্রয় নিচ্ছে রেসত্মোরাঁয়। দু'_একটির মেনু পড়লাম। ঘোড়ার ডিম কিছুই বুঝলাম না। হাশেম ভাই বললেন, 'কী অর্ডার দিতে কী অর্ডার দেব, আরেক মুশকিল। স্যান্ডউইচ বা হাল্কা কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখ।'
বললাম, 'সেই বিখ্যাত সাইন দু'টি খুঁজছি_ বড় আকারের 'এম' অথবা দাড়িঅলা এক প্রবীণের মুখ।' ম্যাকডোনাল্ড অথবা কেএফসি। হাশেম ভাই সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন, 'এতণ এতদূর যে হাঁটলাম, চোখে তো পড়ল না কিছু।'
'হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আশপাশে থাকতেই হবে তাদের। আর সেখানে ভিড় হবে কম। এইসব রেসত্মোরাঁ থেকে খাবারও হবে সসত্মায়।' আমাদের আবার প্রতিটি ইউরো হিসাব করে চলতে হয়।
মিনিট দশেক হাঁটার পর এক কোণে চোখে পড়ল সেই পরিচিত চিহ্ন_'এম'।
ম্যাকডোনাল্ডসের অপরিসর দোকান। লাইন ফুটপাথে এসে দাঁড়িয়েছে। সবারই কি আমাদের মতো ইউরো হিসাব করে চলতে হয়? লাইনে দাঁড়াই সবার শেষে। দোকানের ভেতর ঢোকার পরই হাশেম ভাইকে বলি, 'কোথাও একটা টেবিল দখল করম্নন, দাঁড়িয়ে তো খাওয়া যাবে না।' আমি সিঁড়ির গোড়ায়। সেখান থেকে কাউন্টারের দূরত্ব অনেক। হাশেম ভাই তাঁর চিরাচরিত জাপানী বিনয়ে বললেন, 'আরে, তুমি দু'টি ট্রে সামলাতে পারবে না। কষ্ট হবে। আমিও লাইনে থাকি।'
'দেখেন হাশেম ভাই', চটে গিয়ে বললাম, 'আপনার এইসব বৈষ্ণব ভদ্রতা ছাড়েন তো। দুটো ট্রে নিতে কষ্ট হবে কেন? দু'জনের খাবার এক ট্রেতেই নেব। জায়গা না পেলে খেতে ভাল লাগবে? গিয়ে বরং জায়গা খোঁজেন।'
হাশেম ভাই ভাগ্যক্রমে দু'জনের একটা টেবিল পেয়ে গ্যাট হয়ে বসেন। সেখানে ব্যাগ রেখে দখল পাকাপোক্ত করে খবরটা জানিয়ে আমার ব্যাগটাও নিয়ে যান। লাইন যেন নড়ে না। আধঘণ্টা পর কাউন্টারের সামনে পেঁৗছাই। কাউন্টারে মেয়েটিকে আমেরিকান মনে হয়। কী লাগবে ইংরেজীতে জানাই। মেয়েটি 'সি' 'সি' করে ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে থাকে। আবারও বলি, বিশেষ করে হাশেম ভাইয়ের জন্য ডায়েট কোলার কথাটা। মেয়েটি হঠাৎ হাতের ইশারায় আমাকে থাকতে বলে কিচেনের দিকে চলে গেল। মিনিটখানেক পর ফিরে এল এক সুদর্শন তরম্নণকে নিয়ে। আমি আবার অর্ডার রিপিট করি। তরম্নণটিকে উপমহাদেশের বলেই মনে হয়। সে মেয়েটিকে কাসত্মিলীয়তে অর্ডার অনুবাদ করে দেয়। মেয়েটি আবারও 'সি' 'সি' করতে থাকে। হঠাৎ মনে হয়, ছেলেটি বাংলাদেশের কিনা দেখা যাক। জিজ্ঞেস করি 'বাঙালি?' উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তরম্নণের মুখ। একগাল হেসে বলে, 'হঁ্যা, আমার নাম মাসুম। আপনি?'
নাম বললাম।
'বলেন কী!' একটু উত্তেজিত হয়ে ওঠে। 'তাই তো বলি। প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল আপনিই মুনতাসীর মামুন। কিন্তু ভরদুপুরে আপনি মাদ্রিদে তো থাকতে পারেন না। কারণ আপনি এলে তো আমাদের জানার কথা। তাই তো ধাঁধা লেগে গেল। এক সপ্তাহ আগেও আপনার লেখা পড়েছি।' এক নাগাড়ে সে কথা বলে দম নেয়, তরম্নণীর দিকে তাকায়, তারপর বলে, 'চিনত্মা করবেন না। সব বুঝিয়ে দিচ্ছি', বলে তাকে নিয়ে কিচেনে ঢুকল। এক মিনিট পর ফিরে বলল, 'সব বুঝিয়ে দিয়েছি। মেয়েটি হাঙ্গেরীর, ইংরেজী বোঝে না। ইংরেজী কেউ বললে আমাকে ডেকে নেয়।' মেয়েটি ফিরে এসে ক্যাশবক্সের বোতাম টেপাটিপি করতে থাকে।
'আমার ডিউটি। আমি ভিতরে যাচ্ছি। আপনি পিস্নজ, আপনার এখানকার টেলিফোন নম্বরটা লিখে মেয়েটিকে দিয়ে যাবেন। পিস্নজ।'
হাশেম ভাই টেবিল দখল করে রেখেছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। খাবারের ট্রে নামিয়ে টেলিফোন নম্বরটা লিখে ফের কাউন্টারে ফিরে মেয়েটিকে দিই। মাসুম তাকে বলে গিয়েছিল আমি নম্বর দেব। সে ফের বলে, 'সি' 'সি'। ফিরে এসে টেবিলে প্রথমে এক ঢোক একেবারে শীতল কোক গিলি। গরম আলুভাজা সসে মাখতে মাখতে হাশেম ভাইকে মাসুমের কথা বলি। তিনিও এক টুকরো আলু মুখে ফেলে উৎসাহের সঙ্গে বলেন, 'তা হলে তো ভাল হয়। সে যদি সময় দিতে পারে তাহলে হয়ত ঘোরাফেরা যাবে। মাদ্রিদ খানিকটা দেখতে পাব।'
ধীরে ধীরে খাই। ম্যাকডোনাল্ডসের ভেতরটা তো ঠারয়ে আসি। ফুটপাথ তেতে আছে। রোদ মনে হয় আরও গনগনে। বলি, 'হাশেম ভাই, আজ আর ঘোরাঘুরি বাদ দিই। বরং প্রাদোটা দেখি, কাছেই। এয়ারকন্ডিশন থাকবে। আর এখানে এলে তো সবাই যাবেই প্রাদোতে। প্রাদো না দেখে গেলে দেশের বুদ্ধিজীবীরা তো পাত্তাই দেবে না। নিতানত্ম গ-মূর্খ বলবে।'
'কথাটা ঠিকই বলেছ', হাসিমুখে বলেন হাশেম খান, 'তবে, আমাদের বুদ্ধিজীবী ও আর্টিস্ট মহলে জিজ্ঞেস করো তো কয়জন প্রাদো সম্পর্কে জানে।'
বললাম, 'রাসত্মা পেরোন। আইল্যান্ডে গাছের ছায়ায় হাঁটি। না হলে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে।'
আমরা যে রাসত্মা ধরে হাঁটছি তার পাশেই প্রাদো। বা প্রাদোর সীমানা শুরম্ন। খানিকটা পথ এগুতেই ভেতরে ঢোকার রাসত্মা। এদিক দিয়ে প্রাদোয় ঢোকা যায়। চত্বরে ঢুকে দেখি, বিরাট লাইন। এ সময় এত বড় লাইন হওয়ার তো কথা নয়। ব্যাগ থেকে মাদ্রিদ সম্পর্কিত প্যাম্ফলেটটি বের করি। আজ একটা নির্দিষ্ট সময়ে ফ্রি ঢোকা যাবে। সেই সময়টা আসবে আরো ৪৫ মিনিট পর। ফ্রি ঢুকলে থাকা যাবে ঘণ্টাখানেক। আর যে শেষ ব্যক্তিটি হয়ত ঢোকার পর সময় পাবে আধঘণ্টা। পাটোয়ারি বুদ্ধি যথেষ্ট। ঘণ্টাখানেক ফ্রি দিয়ে কর্পোরেট সোস্যাল ওয়ার্ক করা হলো। ব্যবসায়েও ৰতি হলো না।
'লাইনে দাঁড়াবে নাকি?' জিজ্ঞেস করেন হাশেম ভাই।
'না।' মাথা নেড়ে জানাই, 'আর দাঁড়াতে পারব না। আর আমরা তো প্রাদো দেখতে চাই।'
'বা, মার্কিন, জাপানীরাও তো ফ্রি ঢোকার আশায় দাঁড়িয়ে আছে।'
'আমরা ডেভলপ্ড কান্ট্রির লোক,' বলি আমি, 'আমরা দাঁড়াতে অভ্যসত্ম নই। চলুন।'
টিকেট কাউন্টারটা বেজায় ফাঁকা। দু'জনেই এখন সিনিয়র সিটিজেন বটে তবে স্পেনীয় হলে হয়ত খানিকটা সুবিধা পাওয়া যেত। এখন বেশ চড়া দামেই টিকেট কিনতে হলো। তারপর আনুষঙ্গিক নিরাপত্তা চেকিংয়ের পর পা রাখলাম প্রাদোতে।
যে চিত্রশালা গড়তে লেগেছে প্রায় ৩০০ বছর সে চিত্রশালা আমি বা আমরা কয়েক ঘণ্টায় দেখে শেষ করব এমন চিনত্মা করা মূর্খতা। আর যে প্রাদো ইউরোপে বিখ্যাত। মাদ্রিদে মাসখানেক থাকলে জিরিয়ে জিরিয়ে প্রাদো দেখতে পারতাম। আমরা যারা হঠাৎ হঠাৎ কোথায় যাই বা ঘুরে বেড়াই তাদের পৰে যৌবন বাঞ্ছনীয়। কোন শহরে নিদেন পৰে মাসখানেক না থাকলে, শহরটা অনুভবে আসে না। আমাদের জন্য প্রকৃষ্ট হচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু ছবি দেখা।
প্রাদো বিখ্যাত ধ্রম্নপদী চিত্রকলা আর এল গ্রেকো, গোইয়া আর ভেলাসকেথের জন্য। এভাবে বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন চিত্রশালায় কিছু কিছু করে দেখলে প্রচুর দেখা হয়ে যাবে যা এক শিল্পীকে বোঝার জন্য যথেষ্ট। আমি সেই টেকনিকই গ্রহণ করেছি। সে জন্য কখনও আফসোস করি না।
মাদ্রিদের তখনকার শহরতলিতে বোটানিকাল গার্ডেনের পাশে ১৭৭৫ সালে মাদ্রিদের 'গভর্নর কিং' তৃতীয় কার্লোস সালোন দেল প্রাদো নির্মাণের আদেশ দেন। এক সময় বোধহয় ভাবা হয়েছিল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের একটি সংগ্রহশালা হিসেবে প্রাদোকে রাখা হবে। কিন্তু পরে চিত্রশালা হিসেবেই নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। এর স্থপতি ছিলেন জুয়ান দ্য ভিন্নানুয়েডা। ইতালীয় এবং নব প্যালাডীয় ধাঁচে এর পরিকল্পনা করা হয়। স্যাক্সনির মেরি যোশিফিন এমিলির মাদ্রিদ আগমন উপলৰে ১৮১৯ সালে উদ্বোধন করা হয় প্রাদোর। রাজা সপ্তম ফার্দিনান্দের তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়ের জন্য মাদ্রিদ এসেছিলেন এমিলি।
ইউরোপের রাজরাজড়াদের একটি বৈশিষ্ট্য আছে। তারা প্রায় সবাই শিল্পকলাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছিলেন এবং সংগ্রহ করেছিলেন। প্রাদোকে সবাই সমৃদ্ধশালী করেছিলেন। সম্রাট পঞ্চম চার্লস, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ফিলিপ, বুরবো বংশের চতুর্থ ফিলিপ, তৃতীয় ও চতুর্থ চার্লস সবারই সংগ্রহ জড়ো করা হয়েছে প্রাদোতে। ফলে, ধ্রম্নপদী চিত্রকলা বিশেষ করে স্প্যানিশ চিত্রকরদের এক দুর্লভ সংগ্রহাগারে পরিণত হয়েছে প্রাদো। প্রায় ৫০০০ শিল্পকলার [চিত্রকলা] নিদর্শন সংগ্রহ করেছে প্রাদো। তবে, প্রাদো বিখ্যাত এলগ্রেকো, ভেলাসকেথ এবং গোইয়ার চিত্রকলার জন্য। এই তিনজনের সবচেয়ে বেশি ছবি আছে প্রাদোতে, বিশষ করে গোইয়ার।
কোত্থেকে আমরা শুরম্ন করবো? ঠিক করি নিচতলা থেকে ক্রমেই উপরে উঠবো। তবে এলগ্রেকো, ভেলাসকেথ ও গোইয়ার প্রতি নজর দেব বেশি।
বিশাল পাথুরে হলঘর। একের পর এক হলঘর। আর দু'দিকের দেয়ালে সারি সারি চিত্র। দরজায় গোড়ায় দাঁড়ালেই মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা। ওপরের তলায় কিছু হলঘর আর কিছু প্রকোষ্ঠ। আমরা চোখ বুলিয়ে যেতে থাকি। বিশেষ বিশেষ চিত্রকর্ম হলে ৰণিকের জন্য দাঁড়াই।
সপ্তদশ শতক থেকে বলা যেতে পারে, বিখ্যাত স্প্যানিশ শিল্পীদের আবির্ভাব, প্রথম দিককার অনেক চিত্রকরের সঙ্গে ইতালি বিশেষ করে ভেনিসের যোগাযোগ থাকলেও স্পেনীয়রা নিজস্ব রীতি তৈরি করতে পেরেছিলেন। ওপরে যাদের নাম বললাম এরা ছাড়াও বিখ্যাত হলেন যোশেপ-ডি-রিবেরা, আলোনসো কানো, সুরিলেস্না, ভালদেস লিল ও ফ্রানসিসকো ডি-জুরবারান। জুরবারানের 'প্রার্থনারত সন্ন্যাসী' তো তাকিয়ে দেখার মতো।
প্রথমে এল গ্রেকোর (১৫৪১-১৬১৪) কথা বলতে হয়। কোন্ দেশের শিল্পী বলব তাঁকে? গ্রীক, না স্পেনীয়? তবে, তাঁর গ্রীক পরিচয় এখন মুছে গেছে। জন্মগ্রহণ করেন তিনি ক্রিটে। তখন তা ছিল ভেনিসের অধীনে। ভেনিসে বিখ্যাত শিল্পী তিশিয়ানের স্টুডিয়োতে প্রথমে তিনি কাজ করেন। ১৫৭৫ সালে তিনি চলে আসেন টলেডোতে [তার কথা পরে আসবে]। সেখানেই আজীবন তিনি বসবাস করেন। সে থেকে তিনি স্পেনীয় শিল্পী।
ভেনেসীয় সংস্কৃতিতে যৌবন কেটেছে এল গ্রেকোর, রোমান ম্যানারিজমে প্রভাবিত হয়েছেন, এর সঙ্গে এসে মিশেছে রহস্যময় টলেডোর নিসর্গ ও জীবনযর্চা। অনেকে মনে করেন তিশিয়ানের স্টুডিয়োতে শিৰা নিলেও তিনতোরেত্তো ও মাইকেল এ্যাঞ্জোলোও তাঁকে প্রভাবিত করেছিল।
ভেলাসকেথের [১৫৯৯-১৬৬০] নামটা বেশ লম্বা চওড়া। দিয়েগো রডরিগুয়েজ দ্য সিলভা ইয়ে ভেলাসকেথ। জন্ম সেভাইয়ায়। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের। শিৰানবিশ শিল্পীর কাজ করেন স্পেনে, তারপর রাজদরবারের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৬৪৮ সালে চতুর্থ ফিলিপ যখন স্পেনের রাজা তখন ভেলাসকেথকে তিনি পাঠালেন ইতালিতে শিল্পকর্ম কেনার জন্য। আলকাজার প্রাসাদ তখন নতুনভাবে গড়া হয়েছে। রাজা আলকাজার সাজাতে চান।
রোম তখন শিল্পকলার আনত্মর্জাতিক কেন্দ্র। সেখানে থাকার সময় ভেলাসকেথ দু'টি প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন যা ১৬৫০ সালে পার্থিননে প্রদর্শিত হয়েছিল। এই প্রতিকৃতির একটি ছিল পোপ দশম ইনোসেন্ট আরেকটি তাঁর সহকারীর। তাঁর সমসাময়িক শিল্পী, শিল্প বোদ্ধাদের মধ্যে এই কাজ স্বীকৃত হয়েছিল। বলেছিলেন একজন, এটি একমাত্র সত্য, বাকি সব শিল্প।
ভেলাসকেথ কম্পোজিশনে জ্যামিতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন, আলোছায়ার ব্যবহারের গুরম্নত্ব দিয়েছেন।
এঁরা সবাই নামকরা তবে খ্যাতিমান হচ্ছেন ফ্রানসিসকো গোইয়া (১৭৪৬-১৮২৮), যাঁকে বলা হয় আধুনিক চিত্রকলার জনক। বারোক যুগের শেষ পর্যায়ের শিল্পী বলা চলে তাঁকে যিনি আবার নতুন শতকের রীতিনীতির সংস্পর্শে শুধু আসেননি, তাকে প্রভাবিতও করেছেন। তাঁর জন্ম জারাগোছায়। ১৭ বছরে মাদ্রিদে আসেন। দু'বার পরীৰা দেন রয়াল আকাদেমি অব সান ফার্নান্দোতে। দু'বারই অকৃতকার্য হন সেটি ছিল তখন চিত্রকলা শেখার কেন্দ্র। গোইয়া ১৭৭১ সালে চলে যান। ফিরে আসেন ঐ বছরেই। তারপরই তাঁর সঙ্গে রাজদরবারের যোগাযোগ হয়। দরবারের কিছু কাজ পান এবং সেই আকাদেমি অব দ্য সান ফার্নান্দোতেই ১৭৮০ সালে শিৰক হিসেবে নিয়োগ পান।
গোইয়ার ছবিতে বৈচিত্র্য লৰণীয়। রাজদরবারের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে প্রচুর প্রতিকৃতি অাঁকতে হয়েছে তাঁকে। অন্যদিকে, ফ্রান্স স্পেন দখল করার পর যে বিদ্রোহ হয় তা তাঁকে আলোড়িত করেছিল। মানুষের সেই মুক্তির স্পৃহা তাঁকে আলোড়িত করে। এ ছবিগুলো খুবই বিখ্যাত যা তার চিত্রকলায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। এনগ্রেভিং করেছেন প্রচুর যা মানুষের জীবনের বিপর্যয় তুলে ধরেছে।
সপ্তাম ফার্দিনান্দের নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসনের সময় তিনি মাদ্রিদ ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে নিভৃতে বসবাস করে অাঁকতেন। কিন্তু, রাজরোষে পড়ার ভয়ে ১৮২৩ সালে ফ্রান্সে চলে যান। সেখানেই মারা যান ১৮২৮ সালে।
এই ইতিহাস জ্ঞানদানের জন্য নয়। প্রাদোতে বিশ্বের বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন শিল্পীর সংগ্রহ আছে তবে প্রাদোতে অধিকাংশ দর্শকই আসে এই তিনজনের ছবি দেখতে, বিশেষ করে নির্দিষ্ট কিছু বিখ্যাত ছবি। আর স্পেনীয় শিল্পকলার ধারাটা বুঝতে হলে এই তিন শিল্পীকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
আমরা দু'জন সারি সারি ছবি দেখে যাচ্ছি বটে কিন্তু সবই যে আকর্ষণ করছিল তা নয়। যেন দেখার জন্য দেখা। আমাদেরও ইচ্ছে ঐ তিনজনের ছবিই ভালভাবে দেখার।
খুঁজে খুঁজে প্রথমে এল গ্রেকোর ছবিগুলো দেখলাম। প্রাদোতে তাঁর বেশ ক'টি তৈলচিত্র আছে যেমন দি এ্যাডোরেশন অব দি শেফার্ডস, দি সান সিয়েশন, ব্যাপটিজম অব ক্রাইস্ট, ক্রাইস্ট ব্যারিং দি ক্রস ইত্যাদি। এল গ্রেকোর বিষয়বস্তু প্রধানত খৃস্ট ধর্ম। স্পেনে তখন ক্যাথলিক ধর্মের প্রবল প্রতাপ। সেই প্রভাব তিনি অস্বীকার করতে পারেননি; তবে, চিত্রগুলোতে মূর্ত হয়েছে বেশি যন্ত্রণা সেটি শারীরিক-মানসিক দু'রকমেরই হতে পারে। আছে নাটকীয়তাও। তাঁর ড্রইং দেখলে মনে হবে, এর প্রথাসিদ্ধ রীতি মানতে তিনি অভ্যসত্ম ছিলেন না। প্রতিকৃতিও এঁকেছেন কিছু। প্রাদোতে আছে দি নাইট উইন হিজ হ্যান্ড অন হিজ ব্রেস্ট। সেখানেও দেখা যায় ফিগারের তুলনায় মুখ লম্বাটে ধাঁচের। গ্রেকো ছবিতে নাটকীয়তা ও রহস্যময়তা ফোটাবার জন্য সাদা-কালো রংয়ের ওপর গুরম্নত্ব দিয়েছেন বেশি।
এল গ্রেকো থেকে ভেলাসকেথের সংগ্রহের পরিমাণ বেশি প্রাদোতে। প্রায় কুড়িটির মতো ক্যানভাস দেখলাম বোধ হয়। এর একটা বড় অংশ প্রতিকৃতি, রাজা তৃতীয় ও চতুর্থ ফিলিপ, রাজভ্রাতা, রানী, রাজকন্যা প্রমুখের। ধমর্ীয় বিষয় নিয়েও ছবি আছে কয়েকটি। এ ছাড়াও আছে রোমের ভিলা মেডিসি, হরিণের মাথা, আত্মপ্রতিকৃতি প্রভৃতি। তবে গোইয়া ছাড়িয়ে গেছেন সবাইকে। প্রাদোতেই বোধ হয় গোইয়ার সবচেয়ে বড় সংগ্রহ। প্রথম জীবনে করা তার বড় বড় কাটর্ুনগুলো মন প্রফুলস্ন করে তোলে। ট্যাপেস্ট্রির জন্য এগুলো করা হয়েছিল। যেমন, প্যারাসোল বা ছাতা, রংয়ের বর্ণচ্ছটা চোখ ধাঁধিয়ে দেয় বা অন্ধ বা ধোপানী। অন্যদিকে স্পেনীয় বিদ্রোহের ওপর অাঁকা 'দ্বিতীয় মে', 'তৃতীয় মে' যে সব ছবির প্রতিলিপি এতদিন দেখেছি বা নাম শুনেছি সেগুলোর সামনে দাঁড়াতেই শিহরণ জাগে। ১৯৭১ সালের কথা মনে হয়। প্রতিকৃতিও আছে বেশ কিছু। তবে চতুর্থ চার্লসের পরিবার উলেস্নখ করার মতো।
দল বেঁধে দর্শকরা দেখতে যান 'নগ্ন মাজা' এবং 'বস্ত্রাবৃত মাজা' ছবি দু'টিকে। প্রাদোর নির্দেশিকায় ছবি দু'টির কথা বিশেষভাবে উলেস্নখ্য।
অনেকের মতে ডাচেস অব আলভার প্রতি তার ছিল দুর্দানত্ম প্রেম ছিল। সেটি এক তরফা কি না সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। মাজা মনে করা হয় তারই ছবি এবং তাহলে ধরে নিতে হবে দু'তরফেই প্রেম ছিল। ১৮০২ সালে তাঁর মৃতু্য গোইয়াকে দারম্নণভাবে মর্মাহত করেছিল। 'নগ্ন মাজা'র ধরনের ছবি পরবতর্ীকালে ইমপ্রেশিস্টরা অনেক এঁকেছেন। এবং এ ছবিটি দেখলে বোঝা যায় কেন গোইয়াকে আধুনিক চিত্রকলার জনক বলা হয়।
লিখতে তো সামান্য সময় লাগল। কিন্তু সত্যি বলতে কি প্রাদো দেখতে দেখতে কানত্ম হয়ে পড়েছিলাম। আগের ভ্রমণজনিত কানত্মি তো ছিল। বিশাল বিশাল হলঘর, পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে একতলা থেকে আরেকতলা ওঠা। মাঝে মাঝে হলঘরে রাখা আসনে বসে জিরিয়ে নিয়েছি।
আমার আবার খুব ইচ্ছে ছিল সুরিলেস্না ও ব্রম্নগেলের ছবি বিশেষভাবে দেখার। প্রথমজন স্পেনীয়। দ্বিতীয় জন ফেমিশ। এ ছবিগুলো আবার খুঁজে পেতে বের করতে হলো।
গত ২৫ বছর পৃথিবীর বিভিন্ন সংগ্রহে প্রায় সবার ছবি দেখেছি, যাদের কথা বললাম। নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটনে যে তাদের দু'একটা ছবি যে দেখিনি তা নয়। হাশেম ভাইও দেখেছেন। তবে, এখানে ওই তিনজনের ছবি বিশেষভাবে দেখার পর মন হলো, চিত্রকলার পাঠে একটা পরিপূর্ণতা এলো।
এল গ্রেকো, ভেলাসকেথ আর গোইয়ার ছবি দেখার পর অন্যসব ছবি দেখার আর উৎসাহ থাকে না। হাশেম ভাইয়েরও এক মত। দু'জনই আমরা বেরিয়ে আসি।
বাইরে বেরোতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। এখনও কড়া রোদ। ঘড়ির কাঁটা ছ'টা পেরিয়ে গেছে। প্রাদোতে বিনামূল্যে এখন ঢোকার সময়। ঢোকার সময় যে লাইন দেখে গিয়েছিলাম তার দৈর্ঘ্য আরো বেড়েছে।
রোদ ঝলমলে সন্ধ্যা। এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে কী হবে? দু'জনে হাঁটতে হাঁটতে প্রাদোর এক পাশে বিরাট চত্বরের দিকে এগোই। দূর থেকেই দেখছিলাম সেখানে বিরাট জটলা। উচ্চস্বরে পপ গানের সুর বাজানো হচ্ছে। চত্বরে পেঁৗছে দেখি সেখানেও এক প্রদর্শনী চলছে।
সকালে যাদের ছবি অাঁকতে দেখেছিলাম, সেসব শিল্পী তাদের অাঁকা ছবি জড়ো করেছেন। বেশ বড়সড় এক বৃত্ত। শিল্পীরা যার যার ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে। বিচারকরা এখন বোধহয় মূল্যায়ন করবেন। হাশেম ভাই বললেন, 'চলো, এবার আমরা একটা ফ্রি একজিবিশন দেখি।'
বিষয়বস্তু সবারই এক, বিভিন্ন রূপে প্রাদো। বিভিন্ন মাধ্যমে অাঁকা। নিছক অ্যামেচারদেরও কিছু ছবি আছে যা দেখলে বোঝা যায়। কিন্তু দু'শোর বেশি ছবি, অধিকাংশ ছবির ৰেত্রে অ্যামেচারিত্বের কোন ছাপ নেই। অনেক ছবি দেখে তো মনে হলো এগুলো যে কোন চিত্রশালা সংগ্রহ করতে পারে।
সেই রোদেই গানের সুর শুনতে শুনতে ছবি দেখি। দেখা মানে কি, এক নজর বুলিয়ে যাওয়া। একটু সময় নেয়া আর ধারণা করা। ফলে, আধ ঘণ্টার মধ্যেই ছবি দেখা শেষ হয়ে যায়।
এবার ফেরার পালা। আবার চত্বর থেকে ফিরে সামনের দিকে এগোই। প্রাদোর একদিকে চলছে স্প্যানিশ শিল্পী সোরাইয়ার চিত্র প্রদর্শনী। ইমপ্রেশিস্ট চিত্রকর। মনির ভাইয়ের প্রিয় শিল্পী। তিনি বারবার বলছিলেন, প্রদর্শনীটি যেন মিস না করি। টিকেট কাউন্টারের দিকে এগোনোর সময় বুঝি দু'জনেই খুব কানত্ম হয়ে পড়েছি। এতো কানত্মি নিয়ে ছবি দেখা যায় না। বললাম, 'চলেন খানিকটা বিশ্রাম নিই।'
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.