বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক কি পঙ্গু শিশু হয়ে যাবে? by প্রফেসর রঞ্জন দেবনাথ

২০১০ সালের প্রথম দু'দিন শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় রবিবার তিন তারিখে নতুন একটি 'পঙ্গু' তফসিলী ব্যাংকের জন্ম হলো। এর জন্মদাতা বাংলাদেশ সরকার। একই তারিখে দুটো ব্যাংক 'মারা' গেল বা উঠে গেল। যে দুটো ব্যাংক 'মারা' গেল তার জন্মদাতাও ছিল বাংলাদেশ সরকার।
এর অর্থ যিনি জন্মদাতা তিনিই মারলেন দুটো ব্যাংক। অর্থাৎ দুটো ব্যাংকের জায়গায় জন্ম নিয়েছে একটি ব্যাংক। এর নাম 'বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড' বা 'বিডিবিএল'। যে দুটো ব্যাংকের স্থলে 'বিডিবিএল'-এর জন্ম হলো সে দুটো ব্যাংক হচ্ছে : বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস)। পরেরটি ব্যাংক হিসেবে পরিচিত হলেও প্রকৃত অর্থে ব্যাংক ছিল না। প্রথমটি অর্থাৎ বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের জন্ম ১৯৭২ সালে। প্রাক-স্বাধীনতাকালে দুটো অর্থিক প্রতিষ্ঠান ছিল। এর একটির নাম 'ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব পাকিস্তান' (আইডিবিপি) এবং অন্যটি ছিল 'এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব পাকিস্তান' (এডিবিপি)। ১৯৭২ সালে ঐ দুটো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায় ও সম্পদ নিয়ে গঠিত হয় যথাক্রমে 'বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) এবং বাংলাদেশে কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)।' একটির কাজ হয় শিল্পায়নের জন্য অর্থ যোগান এবং অন্যটির কাজ হয় কৃষির উন্নয়নে অর্থ যোগান। পরবতর্ীকালে শিল্পে অর্থ যোগানের জন্য আরও একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। আর সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস)। এর জন্ম হয় ১৯৭৩ সালে। যতদূর মনে পড়ে দুটোর মধ্যে 'এরিয়া অব ওয়ার্কে' একটা পার্থক্য টানা ছিল। 'বিএসবি' অপোকৃত কম টাকার শিল্প ঋণ দিত এবং 'বিএসআরএস' দিত বড় আকারের শিল্পঋণ। উল্লেখ্য, দুইয়েরই প্রধান কাজ ছিল শিল্পের জন্য অর্থ সরবরাহ করা। আমানত সংগ্রহ করার কাজ তাদের মুখ্য ছিল না। শিল্প ব্যাংকের কিছু শাখা সারা বাংলাদেশে ছিল। খুবই সীমিত আকারে এই ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করত। 'বিএসআরএস' বাণিজ্যিক ব্যাংক-এর অনুমতি পায় অনেক পরে যখন এ প্রতিষ্ঠানটি লোকসানের ভারে আর চলতে পারছিল না। আলোচ্য দুটো প্রতিষ্ঠান ৩৬-৩৭ বছর কাজ করে ২০১০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে আইনগতভাবে উঠে গেল এবং তিন তারিখ থেকে নতুন ব্যাংক কাজ শুরু করল। কাজ শুরু করল পুরনো প্রতিষ্ঠান দুটোর দায়-দেনা নিয়েই। উঠে গেল কী আপসে? না আপসে উঠে যায়নি। দীর্ঘদিন যাবত এ দুটো প্রতিষ্ঠান খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। প্রাণবায়ু যায় যায় অবস্থায় ছিল। এরা যেসব প্রতিষ্ঠানে ঋণ দিয়েছে সেগুলোর প্রায় সবই ঋণখেলাপীতে পরিণত হয়েছে। বস্তুতপ েএ দুটো প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস করুণ ইতিহাস। তারা ক'জন সফল শিল্পোদ্যোক্তা তৈরি করেছে তার সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ হলে জাতি অনেক কিছু জানতে পারত। শিল্প ব্যাংক এবং শিল্প ঋণ সংস্থা কতজন খেলাপী শিল্প মালিক তৈরি করেছে তার ইতিহাসও জানা থাকা দরকার। কী মূল্যে (প্রাইস) কতটা শিল্পসম্পদ এ দুটো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করতে পেরেছে তা জানালেও জাতির কিছুটা শিা হতো। যাক, এ সব তো হবে না। এখন বাস্তবতা হচ্ছে সব রোগের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার বিশ্বব্যাংকের চাপে সরকার অনেকদিন সময় নিয়ে শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থাকে একীভূত করেছে। একীভূত নতুন শিশুর নতুন নাম হয়েছে 'বিডিবিএল'। নতুন পরিচালনা পর্ষদ হয়েছে। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু শিশুটি যে পঙ্গু তার কী হবে? বাস্তবে দুটো পঙ্গু বৃদ্ধের জায়গায় জন্ম নিল একটি পঙ্গু শিশু।
'বিডিবিএল'কে আমি 'পঙ্গু' শিশু বলছি কেন? বলছি, কারণ তথ্যে দেখতে পাচ্ছি 'বিডিবিএলের' জন্ম হয়েছে ৫৩৪টি মামলা নিয়ে। এই মামলায় আটকা আছে ২,১০০ কোটি টাকা। এ প্রতিষ্ঠানটির অবলোপনকৃত (রিটেন অফ) ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ২,৪৮০ কোটি টাকা। ভাবা যায়, ২,৪৮০ কোটি টাকা অবলোপনকৃত ঋণের বোঝা নিয়ে ছোট্ট একটি ব্যাংক তার যাত্রা শুরু করেছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহেব বৃদ্ধিমান লোক। তিনি বলেই ফেলেছেন আসল একটি কথা। তার মতে, নতুন ব্যাংকটিকে যদি পুরনো কাজে/মন্দ ঋণ আদায়ের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় তাহলে নতুন শিল্পে নতুন ঋণ দেয়ার কাজটি হবে না। যদি তাই হয় তাহলে নতুন শিশুটির প্রয়োজন কী? 'রিটেন অব' ঋণ আদায়ের ব্যবস্থার কী হবে? এর দায়-দায়িত্ব কী সরকার সরাসরিভাবে নেবে? এসব বাজে ঋণ কী বাজারে কোন 'রিকভারি এজেন্সির' কাছে বিক্রি করে দেয়া হবে? দুটোর একটিও সম্ভব নয়।'রিটেন অব' ব্যাড লোন মানে তো আর এ নয় যে এগুলো গেছে। এদের প্রত্যেকটির বিপরীতে মামলা আছে। মামলা সব কোর্টে ঝুলছে। এগুলো হামলার শিকার খেলাপি ঋণ গ্রহীতার প থেকে। তারা বলছে, যে আইনে মামলা হয়েছে সেই 'মানি লোন কোর্ট এ্যাক্টটি' ত্রুটিপূর্ণ। এতে ঋণ গ্রহীতাদের স্বার্থরতি হয়নি। এ কথা বলে তারা অগণিত মামলা হাইকোর্টে ঝুলিয়ে রেখেছে। এর থেকে কোন ব্যাংক রেহাই পাচ্ছে না। এখানে সাহায্য করতে পারে আইন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু খেলাপী ঋণগ্রহীতারা এত শক্তিশালী যে, তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা খুবই কঠিন। এমতাবস্থায় বিডিবিএলের মামলা এবং ব্যাড লোনের ভবিষ্যত কী? দেশে তো এমন কোন এজেন্সিও নেই যারা 'ব্যাড লোন' কিনে ব্যবসা করবে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কথায় আরও একটি প্রসঙ্গ এসেছে। সেটি হলো নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য ঋণ যোগানোর দায়িত্ব। জানি না সরকারের মনে কী আছে। নতুন ব্যাংক যদি নতুন শিল্পে ঋণ দিতে না পারে তাহলে তো 'বিডিবিএল' প্রতিষ্ঠার কোন যুক্তি নেই। যদি শুধু 'রিকভারির' কাজ করতে হয় তাহলে পুরনো প্রতিষ্ঠানেই তা পারত। যেহেতু নতুন প্রতিষ্ঠান হয়েছে সেহেতু নতুন শিল্পে নতুন ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর সেটি করা উচিত তার নিজস্ব সম্পদ/উৎস থেকে। আগে 'বিএসবি' এবং 'বিএসআরএস'-এর ফান্ড আসত সরকারের কাছ থেকে। সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে টাকা যুগিয়ে দিত। আমি মনে করি 'বিডিবিএল' চলা উচিত বাণিজ্যিকভাবে। অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক যেমন তাদের ঋণের টাকার জন্য সংগৃহীত আমানতের ওপর নির্ভর করে তেমনি বিডিবিএলেরও তাই করা উচিত। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শিল্পে টাকা দেয়ার জন্য নানা উৎস থেকে সহায়তাও পায়। কিন্তু তা উপরি হিসেবে। প্রধান উৎস সংগৃহীত আমানত। আমি মনে করি আমানতই হওয়া উচিত 'বিডিবিএলের' সম্পদের প্রধান উৎস। তার বাণিজ্যিক ব্যাংকিংও করবে। এক খাতের লোকসান যাতে তারা অন্যখাতের লাভ দিয়ে পুষিয়ে নিতে পারে তার ব্যবস্থাও বিডিবিএলকে' অগ্রিম নিতে হবে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আশা প্রকাশ করেছেন যে, দু'বছরের মধ্যে 'বিডিবিএল' দতার সঙ্গে কাজ করতে সম হবে। তার আশাবাদের নিশ্চয়ই কোন ভিত্তি আছে। এ সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না। অতএব আগাম কোন মন্তব্য করতে চাই না। তবে দৃশ্যত 'বিডিবিএল' যে পঙ্গু একটি প্রতিষ্ঠান তা বোঝা যায়। সরকার যদি বিশেষভাবে সাহায্য-সহায়তা দিয়ে একে দাঁড় না করায় তাহলে 'বিডিবিএলকে' পুরনো দায়-দেনা এবং পুঞ্জীভূত বাজে ঋণের বোঝা টেনে সোজা হয়ে দাঁড়ানো কঠিন হবে।
শিল্প পুঁজি সরবরাহই দেখা যাচ্ছে প্রধান কথা। এর জন্য বিশেষভাবে 'বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড' নামীয় ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠার সময় 'বিএসবি এবং 'বিএসআরএস'-এর কাজও তাই ছিল। ৩৬-৩৭ বছর পর আমরা পেলাম অশ্বডিম্ব। এটা যাতে না হয় সেই প্রার্থনা করি। আর এ প্রসঙ্গে আমার একটা কথা রেকর্ড করে রাখতে চাই। আমাদের দেশে সরকার এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের মাথায় একটা জিনিস কাজ করে। আর সেটি হচ্ছে সরকারী সহায়তা। শিল্প উদ্যোক্তারা মনে করে তাদের পুঁজি দেয়ার জন্য বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠান দরকার। এসব প্রতিষ্ঠান সুলভে পারলে বিনা সুদে ঋণ দেবে, ঋণের ওপর সুদ মাফ করে দেবে ইত্যাদি। সরকারের যেহেতু শিল্পপতিদের প্রতিনিধি থাকে সেইহেতু সরকারও তাই ভাবে। সরকারী সহায়তা ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়_ এ ধরনের কথা প্রতিদিন ব্যবসায়ীদের মুখে শুনি। এর মধ্যে একটি হচ্ছে শিল্পঋণ। শিল্প চালাতে তো বিকল্প পুঁজির ব্যবস্থাও আছে। শিল্পের মালিকরা পুঁজি বাজারে যেতে পারেন। আমাদের পুঁজির বাজার আগের অবস্থায় নেই। ৫০০-৬০০ কোটি টাকা একটি কোম্পানিই পুঁজি বাজার থেকে সংগ্রহ করে নিচ্ছে চোখের সামনে। দেশে বহু প্রাইভেট কোম্পানি আছে যারা ভাল ব্যবসা করছে। তাদের মুনাফার কথা বাজারে যা শোনা যায় খুবই আকর্ষণীয়। এসব ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বলা যায় চুটিয়ে ব্যবসা করছে। তাদের বিত্ত-সম্পদ বাড়ছে শনৈঃ শনৈঃ। দেশের বাইরেও তাদের অনেকের প্রচুর ধনসম্পত্তি রয়েছে বলে জানা যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা কেউ পুঁজি বাজারে যাচ্ছে না। এরা কেউ প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করছে না। অথচ সভা-সমিতিতে দেখা যাচ্ছে এরাই সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। সরকার তার কোম্পানিগুলোকে কেন পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করছে না এটা একটা বড় অভিযোগ তাদের। অথচ তারা তাদের কোম্পানিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করে তাদের লাভে সাধারণ মানুষকে অংশীদার করছে না। তারাই বেসরকারী ব্যাংকের মালিক। তারা সুদের হার কমায় না লেন্ডিংয়ের ওপর। অথচ সরকারকে বলে লেন্ডিং রেট কমানোর ব্যবস্থা করতে। এ এক অদ্ভুত দেশ। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা কেন পুঁজি বাজারে যাবে না এটা আজ একটা বড় প্রশ্ন। তারা কেন শুধু প্রাক-ঋণের আশায় বসে থাকবে? শিল্পঋণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান নয়। এর জন্য বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠান দরকার। বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠান শিল্প ব্যাংক এবং শিল্প ঋণ সংস্থা চলল না। যে টাকা তারা দিয়েছে তা আদায় হচ্ছে না। এমতাবস্থায় কী শিল্পপতিদের শেয়ার বাজারে যাওয়ার কথা বলা যায় না? তারা ঐ বাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করলে অনেক লাভ তাদের। কোম্পানির লাভ হলে লভ্যাংশ দেবে, না হলে কিছু দেবে না। পুঁজির ওপর লাভ না হলে শেয়ার বাজারে কোন খরচ নেই। ব্যাংক থেকে টাকা নিলে লাভ-লোকসান নির্বিশেষে সুদব্যয় বহন করতে হবে। এতে ব্যাংকের ওপর বোঝা কমে। বাণিজ্যিক ব্যাংক সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যবসা অধিকতর নিষ্ঠার সঙ্গে করতে পারে। জানি না কেন সরকারও এভাবে চিন্তা করে না, ব্যবসায়ীরাও করে না। আমি মনে করি 'বিডিবিএল' কোন সমাধান নয়। শিল্প পুঁজির কত শতাংশ 'বিডিবিএল' যোগাবে? শেষ পর্যন্ত শিল্পপতিদেরকে পুঁজি বাজারে আসতেই হবে। এ কাজটা তারা উদ্যোগ নিয়ে করলে ভাল। নতুবা এমন ব্যবস্থা করা দরকার যাতে তারা পুঁজি বাজারে যেতে উৎসাহিত অথবা বাধ্য হয়।

No comments

Powered by Blogger.