শিল্পীর ভুবন- জীবনের কথকতা by জাফরিন গুলশান

‘মেয়েদের জীবন গল্পে ভরা। প্রত্যেক মেয়ের জীবনে আলাদা আলাদা গল্প থাকে। বৈচিত্র্যময়। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, ছেলেদের জীবনে এ রকম বিচিত্র গল্প নেই।’ দিন শেষের আলো-আঁধারির খেলায় শিল্পী রোকেয়া সুলতানা বলছিলেন তাঁর জীবনের নানা কথা।


সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব নেবরাস্কায় ফুলব্রাইট স্কুলারশিপে রিসার্চ সম্পন্ন করে দেশে ফিরেছেন। বাংলাদেশের কোনো নারী শিল্পীর এটাই প্রথম এ ধরনের বৃত্তি লাভ।
ফুলব্রাইট রিসার্চ প্রোগ্রামে তাঁর বিষয় ছিল কেমিক্যাল ফ্রি ও লেস টক্সিক উপায়ে ছাপচিত্রের পদ্ধতিবিষয়ক গবেষণা। তিনি জানালেন, ‘আমেরিকার শিল্পচর্চা আমাদের চেয়ে ভিন্ন। ওখানে ছবি আঁঁকাআঁকির পাশাপাশি আমাকে ওদের ওদের জীবনাচারও সম্পর্েকও জানতে হয়েছে।’
আমেরিকায় দীর্ঘ ১১ মাসের অবস্থানে বেশ কটি ওয়ার্কশপ ও সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। নিজের শিল্পকর্ম দেখিয়েছেন। শিল্পী রোকেয়া সুলতানা মনে করেন এই বিনিময়টা খুব জরুরি। শিল্পের ক্ষেত্রে বিনিময় যত হয় নতুনত্বের পথে তত এর সম্ভাবনা ও শক্তি বৃদ্ধি পায়। আর একজন শিল্পীর জন্য সৃজনশীলতায় কোনো দেশ-সীমানা নেই।
শিল্পী রোকেয়া সুলতানা সব সময় একজন কর্মোদ্যমী মানুষ। তিনি একই সঙ্গে চিত্রশিল্পী, ছাপচিত্রী এবং একজন শিক্ষক। তিনি মনে করেন তাঁর শক্তি তাঁর ছাত্ররা। ‘ওদের কাছ থেকে আমি প্রতিনিয়ত শিখি। এবং ওদের সঙ্গে সবচেয়ে সহজভাবে মিশতে পারি। আমেরিকার শিক্ষাদানের পদ্ধতি আমাদের চেয়ে আলাদা। ওদের মতো করতে চাইলেও সম্ভব না। আমাদের সীমাবদ্ধতা অনেক। ওদের স্কুল থেকেই আর্টের ফাউন্ডেশন কোর্স চালু আছে। ফলে ছাত্ররা পরে অনেক কনসেপচুয়াল কাজ করে, নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে ভাবে।’
ছোটবেলায় অনেক ভাইবোনের মধ্যে বেড়ে ওঠা রোকেয়া সুলতানার সব সময় নিজস্ব একটা কল্পনার জগৎ ছিল। এখনো আছে। তাই নিজেকে তিনি খানিকটা নিভৃতচারী মনে করেন। মনে করেন, তাঁর মতে অন্যদের সঙ্গে, আড্ডায় বেশি সময় ব্যয় করলে শিল্পের সাধনায় ব্যাঘাত ঘটে। শিল্পগুরু শফিউদ্দিন আহমেদ এবং মোহাম্মদ কিবরিয়ার স্নেহধন্য ছাত্রী ছিলেন। কাছে থেকে দেখা এই দুজন মানুষ তাঁর শিল্পগুরু। ১৯৮৭ সালে ঢাকা চারুকলায় ভর্তি হওয়া ছাপচিত্র বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী তিনি। বললেন, ‘আমরা প্রথম ছিলাম তো, আমাদের সামনে সিনিয়র ছাত্রদের কাজ দেখার সুযোগ ছিল না। আমার প্রথম উডকাটটা এত বাজে হয়েছিল যে আমি কেঁদেছিলাম। তবে আমি সব সময় ভালো করতে চেয়েছি। চেষ্টায় কমতি ছিল না কখনো।
‘আমার শিল্পকর্ম হলো আমার জীবনের কথা। ডায়েরির মতো। জীবন চলার পথে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, ছবিতে সে সবই এঁকেছি। আর সত্যি বলতে আমার কৌতূহল বেশি। সবই জানতে ইচ্ছে করে, পরখ করে দেখতে ইচ্ছে করে।’
দীর্ঘ একটা সময় মার্কিন দেশে কাটিয়ে এসে শিল্পের নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন জাগছে তাঁর মনে। ‘এখনকার বিশ্বে কোনটা আর্ট আর কোনটা আর্ট না—এটাই একটা বড় প্রশ্ন! শিল্পচিন্তা এবং শিল্পকর্ম যেকোনো মাধ্যমেই করুক না কেন, একজন শিল্পীর কাজ তখনই সফল, যখন তা মানোত্তীর্ণ এবং সময়োত্তীর্ণ হয়।’
কয়েক মাসের মধ্যে আমেরিকায় আঁঁকা নতুন শিল্পকর্ম নিয়ে একক প্রদর্শনী করবেন তিনি। তাই তাঁর এখনকার আঁকা ছবি নিয়ে মুখ খুলতে চান না রোকেয়া সুলতানা। সবাইকে চমক দিতে চান। কাজেই তাঁর নতুন ও নতুন ধরনের শিল্পকর্ম দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে।

রোকেয়া সুলতানা: জন্ম ১৯৫৮, চট্টগ্রামে। ১৯৮৩ সালে এমএফএ (ছাপচিত্র) বিশ্বভারতী শান্তি নিকেতন থেকে। ১৯৮০ সালে বিএফএ (ছাপচিত্র) ঢাকা চারুকলা। ১০টি এককসহ বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। দেশে ও বিদেশে বহু সম্মাননা পেয়েছেন। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, নরওয়ে, মিসরসহ বহু দেশে জাতীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর কাজ সংগৃহীত হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগের চেয়ারম্যান।

No comments

Powered by Blogger.