বইপত্র- জননী সাহসিকার বহু বর্ণিল স্মরণ-আখ্যান by আখতার হুসেন

সুফিয়া কামাল স্মারকগ্রন্থ—সম্পাদনা পরিষদ: আনিসুজ্জামান, আয়শা খানম, সুলতানা কামাল ও মফিদুল হক \ প্রকাশক: সুফিয়া কামাল স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনা পরিষদ \ প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০১১ \ প্রচ্ছদশিল্পী: কাইয়ুম চৌধুরী \ ভেতরের স্কেচ: হাশেম খান \ মূল্য: ৭৫০ টাকা।


আমাকে আমি নিজে তুলে ধরছি আমার মতো করে এবং তার যে বয়ান বা বিবরণ, তাকেই অভিহিত করি আমরা আত্মজীবনী, আত্মকথা বা আত্মস্মৃতি বলে। আত্মজীবনী বা আত্মকথায় লেখক নিজের অনেক কিছু উহ্য রাখতে পারেন, তাঁর স্মৃতিসিক্ত কোনো কোনো ঘটনা কিংবা বহুজনের সঙ্গে তাঁর সাম্পর্কিক সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ না-ও মনে হতে পারে। ফলে আত্মজীবনী অনেক ক্ষেত্রেই, ব্যতিক্রম তো ব্যতিক্রম, একরোখা হয়ে উঠতে পারে। তাই আত্মজীবনী বা আত্মস্মৃতির সঙ্গে স্মারকগ্রন্থের পার্থক্যটা সত্যিই চোখে পড়ার মতো। শুধু তা-ই নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আলোচ্য ব্যক্তির জীবনী রচনার ক্ষেত্রে স্মারকগ্রন্থ হয়ে উঠতে পারে সমূল সমাচারধৃত বহুকৌণিক, বহুবর্ণিল তথ্যের আধারবিশেষ। একটি নির্দিষ্ট সমাজ ও সময়ের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ব্যক্তির আত্মজীবনী যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সমগুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য ব্যক্তির স্মরণে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থে আশ্রিত বহুজনের স্মৃতিনিঃসৃত নিবন্ধ ও রচনার ধারা। তেমনি একটি সুঋদ্ধ জৈবনিক আকরবিশেষ সুফিয়া কামাল স্মারকগ্রন্থ।
সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯) শুধুই তো কবি ছিলেন না, ছিলেন এ দেশের পশ্চাৎপদ নারী জাগরণযজ্ঞের উজ্জ্বল মশালবাহী সাহসী যাজ্ঞিক ও যাত্রী। যে পরিবেশে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা, অবরোধপ্রথার বেড়াজাল ছিন্ন করে মুক্ত আলো-হাওয়ার জগতে বেরিয়ে আসা, বাংলার মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার সাহচর্যধন্য হওয়া, ভারত বিভক্তির পর কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে নতুন করে নারী শিক্ষার প্রসার ও নারী জাগরণসম্পৃক্ত প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি নিজের সাহিত্যজীবনের গতি অব্যাহত রাখা, কম কথা নয়! এবং পাকিস্তান কায়েমের যে ভাবগত আন্দোলনে তিনি শামিল হয়েছিলেন, কালক্রমে সে বিষয়ে তাঁর মোহমুক্তি শুধু ঘটেনি, তার করালগ্রাস থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রামে নেমেছিলেন জীবন বাজি রেখে। এ রকম যে মহীয়সী কবি ও মহিমময় নারীনেত্রী, তাঁরই স্মরণে এই স্মারকগ্রন্থ। কত বর্ণিল, কত সংগ্রামবহুল তাঁর জীবন, কতটা মমতাময়ী ও অভিযানী ছিল তাঁর জীবনচক্র, তাঁর চরিত্র ছিল কতটা দৃঢ়, দার্ঢ্য ও ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর—তাঁকে অন্তরঙ্গভাবে জানতেন, এমন ৮৩ ব্যক্তির স্মৃতিচারণায় এসবই উঠে এসেছে সুচারুভাষ্যে। তাঁকে যে ‘জননী সাহসিকা’ অভিধায় অভিহিত করা হয়, সে তো আর এমনি এমনি নয়!
এ গ্রন্থের একটা ছোট্ট অসঙ্গতি, ব্যক্তিগতভাবে আমার চোখে ধরা পড়েছে, সেটাকে সহজেই সামাল দেওয়া যেত। শুধু স্মৃতিচারণ মূলক লেখাগুলো পৃথক করা যেতে পারত। তাঁর সাহিত্য-কৃতী, রাজনীতি ও সমাজভাবনার বিশ্লেষণমূলক লেখাগুলো পৃথক অধ্যায়ে ধারণ করা যেতে পারত। সম্ভবত ব্যাপারটা ঘটেছে লেখকদের নাম বর্ণক্রমানুসারে বিন্যস্ত করার ফলে। সম্পাদনাগত এই ত্রুটিটুকু বাদ দিলে প্রতিটি বিষয়ের লেখাই তথ্যসমৃদ্ধ। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছে তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিচারণামূলক রচনাগুলো। সুফিয়া কামালের জীবনের এমন বহু অনালোকিত দিক এসব লেখার ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে, যা সত্যিকারভাবে চিত্তাকর্ষকই শুধু নয়, তাঁর জীবনী রচনার অনুকূল অমূল্য তথ্যেরও আধার।
কবির প্রশস্তিসূচক দুটি কবিতাও আছে এ গ্রন্থে। লিখেছেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও সন্তোষ গুপ্ত। আছে তথ্যসমৃদ্ধ ও আগ্রহসঞ্চারী চারটি ইংরেজি নিবন্ধ। পরিশেষে যোগ করা হয়েছে তাঁর সালওয়ারি জীবনপঞ্জি। গ্রন্থের শুরুতেই আছে আর্ট পেপারে মুদ্রিত কবির নানা বয়স ও কর্মকাণ্ডের দুর্লভ সব ছবি। সুফিয়া কামাল সেখানেও ভয়ানকভাবে জীবন্ত।
বইটির সম্পাদকমণ্ডলী একটু দেরিতে হলেও একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এ জন্য তাঁরা অশেষ অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।
নারী জাগরণের সামাজিক ইতিহাস যাঁরা পড়তে আগ্রহী, তাঁদের সংগ্রহে এই স্মারকগ্রন্থ হয়ে উঠবে একটা অমূল্য সংযোজন।

No comments

Powered by Blogger.