ময়নার একদিন by উত্তম সেন

মস্ত বড় দোকান এটা। ভেতরে হাজার রকম জিনিসে ঠাসা। কী নেই সেখানে! শহরের নামীদামি লোকজন আসেন এখানে বাজার করতে। দোকানের সামনে ফুটপাত ছাড়িয়ে রাস্তায় সারি সারি গাড়ি। দোকান থেকে সওদা নিয়ে যাঁরা বেরোন, তাঁদের বড় বড় প্যাকেট, ঝুড়ি কিংবা ব্যাগভর্তি জিনিসগুলো গাড়িতে তুলে দেওয়া পর্যন্ত ওদের কাজ।


দোকানের ভেতর লোকজন ঢুকছেন আর সওদা নিয়ে বেরোচ্ছেন; তারপর গাড়িতে উঠেই চলে যাচ্ছেন নিজেদের মতো।
দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ময়নার বেশ ভালো লাগে। বাইরে থেকে কাচের দেয়াল ভেদ করেও স্পষ্ট দেখা যায় সবকিছু। দোকান থেকে একজন মহিলা হন্তদন্ত হয়ে গাড়িতে উঠে যাচ্ছেন। তাঁর মালামাল দোকানের লোকটার হাত থেকে নিলেন ড্রাইভার। তারপর গাড়ির পেছনে বুটে রেখে আটকে দিলেন। গাড়িটা স্টার্ট নিয়েই দে ছুট। কিন্তু ওই গাড়িটা যেখানে ছিল, ঠিক সেখানেই পড়ে আছে, ওটা কী!
দোকানটার সামনে ওদের মতো ছেলেমেয়ে কিংবা ওদের মা-বাবারা কাছাকাছিই ভিড়তে পারেন না। গুন্ডার মতো দেখতে দারোয়ানেরা প্রথমে বাঁশির হুইসেল, তারপর পুলিশের মতো লাঠি নিয়ে তেড়ে আসেন ওদের দিকে, তাই ময়নার সাহস হয় না পড়ে থাকা জিনিসটা দেখার। ভেতরে তার তীব্র উত্তেজনা; তার মন বলছে—দামি জিনিস ওটা! বুকে আস্তে আস্তে সাহস জমা করতে থাকে সে। তারপর পোশাকি দারোয়ানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখতে থাকে। হ্যাঁ, বেশ বড়সড় একটা আস্ত চিংড়ি মাছ। পাগুলো বেশ লম্বা লম্বা। ঝলমলে আলো গায়ে পড়ে চিংড়িটাও আলোকিত! লোভ আর সামলাতে পারে না ময়না। কেউ কিছু বোঝার আগে এক দৌড়ে চিংড়িটা হাতে নিয়েই ভোঁ-দৌড়। ছুটতে ছুটতে সে বারবার দেখে মাছটাকে। মাছটা ঠান্ডা; যেন এইমাত্র বরফ থেকে তোলা, হবেও হয়তো। ডাস্টবিনটার কাছে এসে থামল সে। জায়গাটা অন্ধকার, ফ্রকের ভেতরের পকেটে মাছটা রেখে নিশ্চিন্ত হলো।
দিন-রাত চিৎকার-চেঁচামেচি, দুর্গন্ধময় বস্তিটার ভেতর ঢুকলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবু আসতে হয়। কারণ, এ বস্তিতে পায়রার খোপের মতো তাদেরও থাকার একটা জায়গা আছে। মা অন্যের বাসায় কাজ করেন। বড় ভাই একটা জুতার দোকানে কাজ শিখছে। ময়নাকে অবশ্য কিছু করতে হয় না ছোট বলে।
তার বাবা আছে কি নেই—কিছুই জানে না সে। মাও কিছু বলেন না। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘বাবা আমাদের ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকে।’
কোথায় থাকে? তাদের ছেড়ে কেনই বা থাকে জানার ইচ্ছে থাকলেও কাউকে জিজ্ঞেস করে না।
ময়নাদের ঘরের ভেতর ৪০ ওয়াটের একটা ইলেকট্রিক বাতি জ্বলে। শুধু তাদের নয়, এ বস্তিতে যারা থাকে সবার ঘরেই। ঘরে আলো দেখে ময়না বুঝতে পারে, তার মা ফিরেছে। ঘরে ঢুকতেই হাঁক ছাড়েন মা, ‘ঘরের ঝাঁপটাও ভালোমতো না লাগাইয়া গেছিলি কই? আর পারি না।’ জবাবে কিছুই বলে না ময়না। সে কি চিংড়িটার কথা মাকে বলবে? একটু সময় নিয়ে মনে মনে ঠিক করে, নাহ্, বলবে না। কারণ, চিংড়িটা তিন ভাগ করলে তার ভাগে যা পড়বে, তাতে মন ভরবে না।
মা আর ভাই তাকে ছাড়া কিছুই খায় না। এমনকি মিলাদ শেষে তবারক কিংবা জন্মদিন, বিয়ে, আকিকার উচ্ছিষ্ট খাবারও ঘরে এনে তিনজন মিলে খায়। কিন্তু চিংড়ি কোনো দিন খায়নি সে, স্বাদটাও তার অজানা। ময়না ভাবে, চিংড়িটার ভাগ কাউকে না দিয়ে একাই খাবে সে।
রাতের খাবার সেরে ওরা শুয়ে পড়ে চাটাইয়ের ওপর। রাত ১০টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বস্তির সব বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়, এটা বস্তির মালিকের হুকুম। পরের দিন সন্ধ্যা ছয়টায় আবার বাতি জ্বালানো হয়। এক চাটাইয়ের মাঝখানে মা আর দুই পাশে ওরা দুই ভাইবোন। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নাক ডাকতে ডাকতে মা আর ভাইয়া ঘুমের দেশে হারিয়ে যায়।
ময়না ফ্রকের ভেতরের পকেটে রাখা মাছটা বের করে। গভীর মমতায় মাছটাকে গালে ছোঁয়ায়, আদর করতে গিয়ে চিংড়ির সুচালো শিঙের খোঁচা লাগে, যন্ত্রণা হলেও মুখে কোনো শব্দ করে না। সকালে মা আর ভাই বেরিয়ে গেলে চিংড়িটা ভাজা করে খাবে সে একাই। উত্তেজনায় কিছুক্ষণ কাটে তার, তারপর নিরাপদ স্থান অর্থাৎ তেলচিটচিটে চ্যাপ্টা বালিশটার নিচে চিংড়িটা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।
কিসের অসহ্য কামড়ে ঘুম ভাঙে ময়নার। সারাটা শরীর ফুলে ফুলে আছে। সে বুঝতে পারে, এসব পিঁপড়ের কামড়। তড়াক করে উঠে পড়ে সে। ভোরের আলো ফুটেছে। সে দেখল মা আর ভাইয়া নেই। সানকিতে পান্তাভাত, লবণ আর বাসি কিছু ডাল রেখে যান মা। এটা মায়ের প্রতিদিনের কাজ। পুরো শরীরে পিঁপড়ের আসা-যাওয়া, অসহ্য লাগে তার, এমন কেন হলো! মা বলেন, বাড়িতে যদি পিঁপড়ের ভিড় বেড়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে ভারী বৃষ্টি হবে।
কিন্তু কয়েক দিন ধরেই তো শরীর পোড়া রোদ, মেঘের কোনো চিহ্নই নেই।
অস্বস্তিতে সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। তার এখন মূল কাজ হচ্ছে চিংড়ি ভাজার প্রস্তুতি। চিংড়িটার খোসা ছাড়াতে হবে, পরিষ্কার করে ধুয়ে লবণ, হলুদ মেখে গরম তেলে ভেজে নবাবজাদির মতো পান্তা ভাত খাবে। ভাবতেই জিবে জল আসছে। মহাখুশিতে বালিশটা তুলেই চোখ দুটো তার ছানাবড়া। হাজার হাজার পিঁপড়ে তার বালিশজুড়ে। চিংড়িটা বালিশের তলায় নেই। দু-একটা খোসা দেখা যাচ্ছে এদিক-সেদিক। আর লাইন ধরে পিঁপড়ের দল সারিবদ্ধভাবে ঘরের বেড়ার নিচের ফাঁকা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চিংড়িটা কোথায়!
পিঁপড়ের দলকে অনুসরণ করতে করতে উঠোনে নেমে এল সে। পিঁপড়ের দলটার মুখ দেখতে চায় সে, কিন্তু ওরা গতিপথ পরিবর্তন করায় বুঝতে পারে না। একসময় পিঁপড়েদের বড় দলটাকেই পেয়ে যায়। নোংরা নর্দমার শেওলা ধরা দেয়াল দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। অগ্রভাগের দলটা বেশ বড় টুকরা নিয়ে তরতর করে নামছে। হঠাৎ পায়ে আবার পিঁপড়ের কামড়ে তার চোখ পড়ে লম্বা একটা কালো কাঠির দিকে। কাঠি নয় ওটা, চিংড়ির পা। চিংড়ির আস্ত শরীরটা টুকরো টুকরো করে লুটে নিয়ে গেছে পিঁপড়ের দল।
ময়নার চিংড়ি ভাজা খাওয়া আর হলো না। কোনো দিন আর খাওয়া হবে কি না, কে জানে! হঠাৎ চোখ ফেটে জল এল তার। পিঁপড়ের কামড়ের যন্ত্রণায় নয়, ময়না কাঁদছে কষ্টে। মা আর ভাইয়া তাকে ছাড়া কিছুই খায় না; আর সে স্বার্থপরের মতো একাই খেতে চেয়েছিল চিংড়িটা!

No comments

Powered by Blogger.