শ্রদ্ধাঞ্জলি- চলে গেলেন সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ by অমর সাহা

চলে গেলেন এই উপমহাদেশের বরেণ্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ। গত মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে কলকাতায় তিনি মারা যান। বেশ কয়েক দিন ধরেই অন্ত্রের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। ৩০ আগস্ট তাঁকে ভর্তি করা হয় কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে আর বাড়ি ফিরতে পারেননি তিনি।


চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
এই প্রথিতযশা লেখকের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুরে, ১৯৩০ সালে। শৈশব-কৈশোরও কেটেছে সেখানে। কিশোর বয়সেই তিনি লোকনাট্য দল ‘আলকাপ’-এর সদস্য হয়ে ঘুরেছেন গোটা পশ্চিমবঙ্গ। তারপর ১৯৬৪ সালে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন কলকাতায়। তিনি রেখে যান স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়েসহ অসংখ্য ভক্ত আর গুণগ্রাহী। মুস্তফা সিরাজের মৃত্যুতে কলকাতার সাহিত্য আর সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। সবার কণ্ঠে ভেসে আসে একটি কথা—বাংলা সাহিত্য হারাল এক বরেণ্য লেখককে। বাংলা সাহিত্যের এই ক্ষতি অপূরণীয়।
আজন্ম ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে লালিত এই বরেণ্য লেখক নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। ছিলেন এক কলমি মুক্তিযোদ্ধা। সেই ১৯৬৮-৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতি যখন উত্তাল, তখন তিনি কলম ধরেছিলেন। লিখতেন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে নানা কথিকা। আর তা নিজে পাঠ করতেন কলকাতার আকাশবাণী রেডিওতে। সেই সময় কলকাতার নাট্যব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্রের সঙ্গে তিনি একত্রে কথিকা পড়েছেন আকাশবাণীতে। আর তখন আকাশবাণীতে বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর এই কথিকা লেখার জন্য তাঁকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন আকাশবাণীর অন্যতম প্রযোজক সরল গুহ। এই কথিকা পড়ার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে চিনেছেন, বাংলাদেশকে ভালোবেসেছেন এবং বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সাল ছিল আমার কাছে এক উত্তেজনার বর্ষ। আমি মনেপ্রাণে বাঙালি, তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আমি এসে দাঁড়িয়েছিলাম মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে। অস্ত্র ছিল আমার কলম। আমি বিশ্বাস করতাম, বাঙালিদের সত্তা পৃথক। তাই বাঙালিদের জন্য চাই পৃথক আবাসভূমি। তাই তো সেদিন কলম ধরেছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। তখন আমি আনন্দবাজার পত্রিকায় কর্মরত। প্রতিদিন খবর রাখতাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের। আর মাপতাম পাকিস্তান কতটুকু মিথ্যা কথা বলেছে, প্রচার করেছে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন, তখন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতার মুজিবকে নিয়ে শীর্ষ রিপোর্টটি লিখেছিলাম আমি।’
আনন্দবাজার পত্রিকায় তিনি কাজ করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর।
তাঁর প্রথম উপন্যাস নীল ঘরের নটি, প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন তিনি। তাঁর লেখা অলীক মানুষ উপন্যাসের জন্য তিনি পেয়েছেন ভারতের সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। উপন্যাসটি ভারতের ১৮টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর উপন্যাস নিয়ে কলকাতায় চলচ্চিত্র হয়েছে।
তিনি লিখেছেন ১৫০টি উপন্যাস এবং তিন শতাধিক ছোটগল্প। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো: তৃণভূমি, কিংবদন্তির নায়ক, উত্তর জাহ্নবী, অলীক মানুষ, মায়ামৃদঙ্গ, পিঞ্জর সোহাগিনী, হিজলকন্যা আসমান তারা ইত্যাদি। তাঁর লেখার জন্য তিনি পেয়েছিলেন দেশ-বিদেশের অন্তত ৫০টি পুরস্কার। পেয়েছিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহ দাস স্মৃতি পুরস্কার, সুশীলা দেবী বিড়লা পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার ইত্যাদি।
মুস্তফা সিরাজের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। বলেছেন, আমি তাঁর গুণমুগ্ধ এবং তাঁর লেখার একান্ত ভক্ত। কেবল সাহিত্যিক হিসেবে নয়, প্রখর পাণ্ডিত্যের জন্যই তাঁর নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর লেখা বাংলা সাহিত্যকে ৬০ বছরজুড়ে সমৃদ্ধ করেছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, বাংলা সাহিত্যের আজ বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ ছিলেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিরাট এক কণ্ঠস্বর। তিনি বলেছেন, তবে আজ এটা ভেবে ভালো লাগছে যে সাহিত্য একাডেমির তাঁকে নিয়ে তৈরি করা তথ্যচিত্রটি তিনি শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে পেরেছেন। কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের প্রয়াণে বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, সিরাজের মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তাঁর লেখায় ছিল অসাধারণ শিল্পকর্ম। সাহিত্যিক আবুল বাশার বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যের বড় মাপের এক লেখককে হারালাম আমরা। তিনি ছিলেন বড় মাপের মানুষও।’ সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার বলেছেন, বাংলা সাহিত্য হারাল এক বরেণ্য লেখককে। এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। সাহিত্যিক শংকর বলেছেন, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের লেখায় ছিল বৈচিত্র্য, ছিল প্রাণশক্তি, ছিল ভালোবাসা।
অমর সাহা
কলকাতা

No comments

Powered by Blogger.