শুঁটকি উৎপাদনে ব্যসত্ম হাজারো জেলে_- মুখর সোনাদিয়া

বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা দ্বীপাঞ্চল সোনাদিয়া। স্থায়ী কোন বসতি নেই এ দ্বীপে। অথচ সাগরের এ শানত্ম দ্বীপটিতে এখন হাজারো মানুষের পদচারণা। দ্বীপজুড়েই চলছে সমুদ্র থেকে আহৃত মাছ শুকিয়ে শুঁটকি উৎপাদনের ব্যসত্মতা। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দ্বীপটির চেহারা পাল্টে যেতে শুরম্ন করবে।


প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে বহুল প্রত্যাশিত ডিপ সি পোর্ট (গভীর সমুদ্রবন্দর) নির্মাণ কাজ শুরম্ন হতে যাচ্ছে।
উজ্জ্বল সম্ভাবনার হাতছানি
সোনাদিয়ায় স্থায়ী কোন বসতি নেই। লাগোয়া মহেশখালী, কুতুবদিয়া দ্বীপের অসংখ্য মৎস্যজীবী এখন এখানে গড়ে তুলেছে অস্থায়ী স্থাপনা। চলছে সমুদ্র থেকে আহৃত নানা প্রজাতির মাছকে রোদে শুকিয়ে শুঁটকি উৎপাদন। শীত সাগরের শানত্ম সময় অর্থাৎ বর্ষার আগ পর্যনত্ম দ্বীপে অস্থায়ী বসতি স্থাপনাকারীদের এ তৎপরতা চলবে। কোটি কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদন হয়ে থাকে এ দ্বীপে। কিন্তু এখানকার মৎস্যজীবীরা এখন জানে অদূর ভবিষ্যতে শুঁটকি উৎপাদন ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাবে। সোনাদিয়ায় সূচনা হবে নতুন সভ্যতার। সমুদ্রগামী বিশ্বের বড় বড় জাহাজের আগমন ঘটবে এ দ্বীপে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার চলবে এ দ্বীপে।
সরেজমিনে আলাপকালে বসতি স্থাপনকারীরা জানান, গেল নবেম্বরের শুরম্ন থেকে দ্বীপে তাদের আগমন ঘটে। অনত্মত ২০ হাজার জেলে রয়েছেন এ দ্বীপ ঘিরে। দাদন ব্যবসায়ীদের পুঁজিতেই মূলত সোনাদিয়ায় বড় বড় এলাকা দখল নিয়ে শুঁটকি তৈরির কেন্দ্র বানানো হয়েছে। বাঁশপাতা দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ঘর এবং মাছ শুকানোর হ্যাঙ্গার সোনাদিয়ায় এখন পরিচিত দৃশ্য। মার্চের পরে সমুদ্রের উত্তালতায় শুরম্ন হতেই মৎস্যজীবীরা তাদের বসতি গুটিয়ে নেন। কাদা বা মাটির কোন চিহ্ন নেই এ দ্বীপে। পলি আর বালি। মরম্নভূমি বললেও কোন দ্বিধা নেই। পূর্ব-পশ্চিম আড়াআড়ি লম্বা দ্বীপটি পর্যটকদের জন্যও রীতিমতো আকৃষ্ট করতে পারে। তবে যাতায়াত বা অন্য কোন সুযোগসুবিধা এখানে নেই। এলাকার জেলেরা জানান, জোয়ারের সময় সোনাদিয়া ১৫ থেকে ২০ ফুট সমুদ্রপৃষ্ঠে থেকে উঁচুতে দাঁড়িয়ে থাকে। বর্ষায় সাগরপৃষ্ঠের সঙ্গে প্রায় মিলিয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ই হচ্ছে এ দ্বীপের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি। তবে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও এখন নানা শঙ্কা জাগছে। পরিবেশবিদদের ধারণা, সামনের দিনগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা সোনাদিয়ায় বাড়লে অনত্মত ২ ফুট উচ্চতা হ্রাস পাবে। তবে গভীর সমুদ্রবন্দরের স্থাপনা যেহেতু এখনও নির্মাণ শুরম্ন হয়নি তাই সংশিস্নষ্টরা এ বিষয়টিকে আগেভাগেই পরিকল্পনায় আনবে।
সমৃদ্ধ অর্থনীতির স্বর্ণদ্বার
সোনাদিয়ার কিনারা অত্যনত্ম খাড়া। তাই মহেশখালীর পশ্চিমে আড়াআড়ি ১২ কিলোমিটার এলাকায় জেটি তৈরির জন্য অত্যনত্ম উপযোগী। দ্বীপটির আয়তন প্রায় ৭ বর্গকিলোমিটার। ৭০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে এখানে। দেড় শ' প্রজাতির প্রাণী রয়েছে সোনাদিয়ায়। বাইন, কেওড়া এবং কেয়া উলেস্নখযোগ্য প্রজাতির গাছ উপকূলীয় এলাকায়। ৭/৮ একর জমির ওপর বন গড়ে উঠলেও দসু্যরা এগুলো কেটে নিয়েছে। দ্বীপে অস্থায়ী বসতি স্থাপনকারীদের জ্বালানির জন্য কোন ব্যবস্থা না থাকায় উপকূলীয় বনের গাছগুলোই কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সোনাদিয়ায় আধুনিকতা বলতে কিছু নেই। তবে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক বিসত্মৃত রয়েছে। এখানকার লোকজনের নিত্যসঙ্গী রেডিও। পুরো দ্বীপে একটি মাত্র দোকানে মোবাইল ফোনের চার্জের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বিদু্যতের কোন ব্যবস্থা নেই এখানে। বসতি স্থাপনকারীরা পুরো ছয় মাসের জন্যই রসদপত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে এ দ্বীপে আসে। সরকারের প্রসত্মাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে জেলেদের মাঝে কোন কানাঘুষা বা আগ্রহ নেই। তারা জানেও না সোনাদিয়া দ্বীপ মৎস্যজীবীদের জন্য অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবে। এখানে থাকবে না শুঁটকির কোন গন্ধ। গভীর সমুদ্র থেকে মাছ নিয়ে আসা ট্রলারও আর থামবে না। নতুন সভ্যতার জন্ম নেবে সোনাদিয়ায়। আশপাশের মহেশখালী, কক্সবাজার এবং কুতুবদিয়ার অর্থনৈতিক গুরম্নত্ব বেড়ে যাবে। কক্সবাজারের নাজিরা টেকের দুই কিলোমিটার দূরে গড়ে উঠবে অর্থনীতির নতুন সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর।
ফাশব্যাক সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর
সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে অনত্মত ৫ বছর আগে থেকে জরিপ কাজ শুরম্ন হয়। জাপানী প্রতিষ্ঠান মেসার্স প্যাসিফিক কনসালট্যান্ট লিমিটেড বঙ্গোপসাগরের ৯টি পয়েন্টে সম্ভাব্যতা জরিপ চালিয়ে ৭টিতে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের উপযুক্ততা পায়। এর মধ্যে সোনাদিয়াকে সবচেয়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হিসেবে উলেস্নখ করা হয়। এ দ্বীপে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের সম্ভাব্যতা ৮৪ দশমিক ২৯ ভাগ। ১৬টি বিষয়কে সমুদ্রবন্দর স্থাপনের ব্যাপারে গুরম্নত্ব দেয়া হয়। এ দ্বীপের সবচেয়ে বেশি উলেস্নখযোগ্য দিক হচ্ছে জনমানবহীন হওয়ায় কোন বসতিকে উচ্ছেদ করতে হচ্ছে না। সোনাদিয়া দ্বীপের পুরো জায়গাই সরকারী। তাই হুকুম দখল নিয়ে জটিলতাও নেই। ড্রেজিংয়ের প্রয়োজনীয়তা নেই সাগরের এ অংশে। সোনাদিয়া দ্বীপের সঙ্গে নাব্য ১৪ মিটার। ডিপ সি পোর্টের জন্য এটি অত্যনত্ম নিরাপদ। ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ অর্থাৎ ওয়্যার হাউস, শিল্প বেল্ট এবং যোগাযোগের জন্য যথেষ্ট সুবিধা রয়েছে সোনাদিয়ায়। জলবায়ু এবং মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ জাহাজ চলাচলের জন্য সোনাদিয়ায় সবচেয়ে উপযোগী। পরিবেশবান্ধব হওয়ায় সোনাদিয়াকে ডিপ সি পোর্টের উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। তিন ধাপে ১১ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। সোনাদিয়াতে বাসত্মব কাজ শুরম্ন হতে পারে আগামী বছরের ডিসেম্বর মাসে। সরকার ইতোমধ্যে জেটি স্থাপনের পরিকল্পনা ও ঠিকাদার নিয়োগসহ নানা প্রক্রিয়া শুরম্ন করেছে। প্রথম দফায় ৪টি জেটি নির্মাণের কাজ শুরম্ন হবে। ২০১৫ সালের মধ্যে জেটির প্রথম ধাপের আংশিক নির্মাণ শেষ হতে পারে বলে ইতোমধ্যেই সরকার ঘোষণা দিয়েছে। ২০২০ সালে পূর্ণাঙ্গ ৪টি জেটি চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। সোনাদিয়া নিয়ে তিন ধাপের মূল পরিকল্পনায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে প্রকাশ করেছে ৩শ' মিটার দৈর্ঘ্যের চারটি জেটিসহ ১ দশমিক ২ কিলোমিটার বন্দরের অংশ নির্মিত হবে। এসব জেটির ব্যাকআপ থাকবে ৭২ মিটার। ব্যয় হবে ৭ হাজার কোটি টাকা (১ হাজার ৫৮ মিলিয়ন ডলার)। মধ্যবর্তী পরিকল্পনায় আরও ১ হাজার ৮শ' মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ১৭টি জেটি নির্মিত হবে। এ সময় বন্দরের দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ১ কিলোমিটারে উন্নীত হবে। জেটির ব্যাকআপ ফ্যাসিলি দাঁড়াবে ৩৩২ হেক্টর। শেষ ধাপে ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে (৩ হাজার ১৯০ মিলিয়ন ডলার) আরও ৩৭টি জেটি নির্মাণ হবে। পূর্ণাঙ্গ ডিপ সি পোর্টে ব্যয় দাঁড়াবে ৬ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা। ৩৭টি জেটিতে বিশ্বের বড় বড় মাদার ভেসেলগুলোর আগমন ঘটবে সহজে। সোনাদিয়ার সঙ্গে মূল ভূখ- আরাকান সড়কের সংযোগ এবং রেলপথের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। ২০৫৫ সালের মধ্যে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে। এ গভীর সমুদ্রবন্দরটি মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকাসহ বিসত্মীর্ণ এলাকার ৪০ কোটি মানুষের চাহিদা পূরণে সম হবে।
_মহসিন চৌধুরী, সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে ফিরে

No comments

Powered by Blogger.