ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু বাঙালির ক্রানত্মিকালের সত্যসন্ধ দলিল by মোহাম্মদ নূরুল হক

ইতিহাসের বিভিন্ন কালখ-ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার বিশ্বসত্ম বিবরণ পেশ করা ঐতিহাসিকের দায়। সে দায় পালনে ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির যৌক্তিক উপস্থাপন যতটা সহনশীল, তার চেয়ে অতিরঞ্জিত বয়নশৈলী স্বয়ং ঐতিহাসিককেও মহাকালের বিচারসভায় সন্দিগ্ধ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। তাই ঐতিহাসিককে নির্মোহ ও নিস্পৃহ না হলে চলে না। কিন্তু ঐতিহাসিক স্বয়ং যদি সে বিশেষ কালখ-ের একজন চাুষ সাী হন, তা হলে তার ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভূতি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে_সন্দেহাতীতভাবে। সেেেত্র ঐতিহাসিককে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার সময় অনত্মরের সততা ও বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকা ছাড়া গতি কী? উপরন্তু চিত্তের দার্ঢ্য ব্যতিরেকে কোন স্পর্শকাতর বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করা তার প েসম্ভব হয়ে ওঠে না। ইতিহাসের কোন কোন অধ্যায় কোন কোন স্বার্থান্ধের ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে অনেক সময় পরবতর্ী প্রজন্মের কাছে বিভ্রানত্মিকর তথ্য পরিবেশন করে প্রকৃত ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে। তখন সাময়িক ধূলির আবরণে ঢাকা পড়ে সত্য; কিন্তু কালের অনিবার্য সত্যের দূত হয়েও কেউ কেউ সে ধূলির আবরণকে মুছে দিয়ে প্রকৃত তথ্য তার জনগোষ্ঠীকে উপহার দেন স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে। উপর্যুক্ত পটভূমির অবতারণা এডভোকেট আবুল খায়ের রচিত ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু গ্রন্থটির পাঠোত্তর উপলব্ধি।

৩২৮ পৃষ্ঠার সুবৃহৎ এ গ্রন্থে ৬৬ অধ্যায় জুড়ে বঙ্গবন্ধুর বংশপরিচয় থেকে শুরম্ন করে, ছাত্রজীবন, রাজনীতিক হিসেবে অভিষেক, ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও তার ভূমিকা, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সম্পর্কের সূচনা, সানি্নধ্য ও মতানৈক্য, ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান, তার স্বাধীনতার ঘোষণা, মুজিবনগর সরকার গঠন, সংবিধান প্রণয়ন, সশস্ত্র উগ্রপন্থিদের দমনসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বর্বরোচিত গণহত্যার কালো অধ্যায় পর্যনত্ম ইতিহাস স্বীকৃত বিষয়গুলোর সাবলিল বর্ণনা। সে বর্ণনায় কোন রঙ আরোপ করেননি। এমনকি ১৯৭৫ সালের পরবতর্ী কালখ-ের নানা ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কেও তিনি কোনরূপ বিতর্কিত বিষয় উত্থাপন করেননি। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠনের যৌক্তিকতাকে তিনি সহমর্মিতা ও মাঙ্গলিক অর্থে বিবেচনা করেছেন। এবং এ প্রসঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধুর যুক্তিগুলোকেই সঠিক ধরে নিয়েছেন। অন্য ঐতিহাসিকদের মত বঙ্গবন্ধুর সে বিশেষ সিদ্ধানত্মের প্রতি সংশয়সূচক কাঁটা এগিয়ে ধরেননি। আলোচ্য ঐতিহাসিক এ গ্রন্থে কেবল ইতিহাস বর্ণনা করেননি। তিনি দীর্ঘ পটভূমি নির্মাণ করে দেখাতে চেয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাসে মরণজয়ী বীর চিনত্মাবিদ, দার্শনিকের মৃতু্য যেমন সাধারণ মানুষকে পর্যনত্ম দেশকাল-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার আসনে বসিয়ে দেয়, ঠিক বাঙালি জাতির মুক্তির অগ্রদূত ও কুশিলব মহান মুজিবুর রহমান সক্রেটিস, ইদিপাস, ইকারম্নস, নেপোলিয়নের মতো ইতিহাসে অমরত্ব পাবেন কি না? ইদিপাস যেমন দেব- দেবীর অশুভ চক্রানত্মকে নস্যাৎ করে পরম সত্যকে উদ্ঘাটন করতে গিয়ে নিজের চোখকে সোনার কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করেছেন, সক্রেটিস যেমন সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য হেমলক পান করেছেন হাসতে হাসতে, ইকারম্নস যেমন নিরাপদ উঁচুতে উড়ে গিয়ে বাবা ডেডেলাসের অমরত্বহীন জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে মহাশূন্যে উড়তে উড়তে সূর্যের কাছাকাছি পেঁৗছে মৃতু্যঞ্জয়ী মরণকে বরণ করে মানব সভ্যতার ইতিহাসে অমরত্বের তিলকরেখা পরেছেন, তেমনি মহান মুজিবও শত্রম্নর চক্রান্তুকে বারবার প্রেম দিয়ে, হৃদয়ের ঔদায্য দিয়ে জয় করতে চেয়েছেন। কিন্তু অকৃতজ্ঞ আর অপরিণামদশর্ীর দল তার অতিমানবীয় গুণাবলীকে দুর্বলতা ভেবে তাকে সপরিবারে হত্যা করার মধ্যদিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পথ পরিষ্কার করতে চেয়েছিল। ইতিহাস সাী সত্য কখনও মুছে যায় না। কালে কালে সত্যসন্ধ লোকের অভিষেকে প্রকৃত সত্য দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। তাই জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব বাঙালির অসত্মিত্বে কতটা শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চার্য তার যৌক্তিক কার্যকারণ সম্পর্ক বর্ণনা করেছেন আলোচ্য ঐতিহাসিক এ গ্রন্থে। এটি নিছক ইতিহাসের ধারা বিবরণী মাত্র নয়; সঙ্গে একজন মুক্তিযোদ্ধা দেশপ্রেমিকের ঐতিহাসিক মূল্যায়নের প্রশ্নে বাঙালির ক্রানত্মিকালের সত্যসন্ধ দলিলও। ইতিহাসের নানা ঘটনাপ্রবাহের ধারাবিবরণীর সঙ্গে সঙ্গে এ গ্রন্থের ১৭৩ পৃষ্ঠা থেকে ৩২৮ পৃষ্ঠা পর্যনত্ম বঙ্গবন্ধুর কৈশোর, ছাত্রজীবন, যৌবন, প্রৌঢ়কালীন বিভিন্ন সময়ের কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র সংকলিত হয়েছে। যা সচরাচর দেখা যায় না। তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য, শিশুপুত্র রাসেলসহ নামাজরত সময়ের আলোকচিত্র, উপমহাদেশের স্বর্ণকণ্ঠ শিল্পী হেমনত্ম মুখোপাধ্যায় ও দৌহিত্র জয়ের একানত্মে কাটানো মুহূর্তের ছবি, নদী ভ্রমণের পথে মার্শাল টিটো ও মাদাম টিটোর সঙ্গে তোলা ছবিসহ অসংখ্য আলোকচিত্রসহ স্বহসত্মে লেখা ডায়েরির একটি পৃষ্ঠা ও দুটি চিঠির ছায়ালিপি। যা সুলুকসন্ধানী পাঠককে অন্যতর তৃষ্ণার পিপাসা মেটাবে। বর্তমান গ্রন্থাকার গ্রন্থাবদ্ধ ছবি ও হাতের লেখা প্রাপ্তির কোন তথ্যসূত্র উলেস্নখ না করায় পাঠক মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক এসবই কি তার ব্যক্তিসংগ্রহ থেকে নেয়া হয়েছে? উত্তর যাই হোক, ছবিগুলো যে কথা বাঙ্ময় ভাষায় প্রকাশ করছে, তাতে লেখকের এটুকু অসতর্কতা পাঠকের সহনসীমাকে অতিক্রম করবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে অসংখ্য বই থাকার পরও আরও একটি বইয়ের প্রয়োজন কী? তার উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখতে হয়।
কবি ও নাট্যকার সিকান্দার আবু জাফর যেমন বাংলার ভাগ্যবিড়ম্বিত নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ব্রিটিশদের প্রচারিত কামুক, অপরিণামদশর্ী, দুর্বল শাসক, বাঈজী ও শরাবে মশগুল অযোগ্য খল নায়কের অপবাদ থেকে মুক্তি দিয়ে দুইশ' বছরের মেঘাবরণকে সরিয়ে দেশপ্রেমিক প্রজাহিতৈষী, স্ত্রীপ্রেমে একনিষ্ঠ স্বামী ও আত্মত্যাগী বীরের মর্যাদার আসন ফিরিয়ে দিয়েছেন 'সিরাজউদ্দৌলা নাটকে। ব্রিটিশ রাজত্বকালে ব্রিটিশদের প্রচারিত তথ্যই মানুষ জেনেছে, শুনেছে; সত্যসন্ধ মানুষ প্রতিবাদও করেছে হয়তো।
কিন্তু প্রতিবাদ সাধারণ্যে পেঁৗছাতে পারেনি শাসকবর্গের কুচক্রী মনোভাব ও নিপীড়নমূলক আচরণের কারণে। উত্তরকালে শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের যাঁতাকলে কিছুসংখ্যক উচ্চবিলাসী অপরিণামদশর্ী বর্বর সেনা অফিসারদের হাতে মৃতু্যবরণ করার পর পরবতর্ী শাসকগোষ্ঠী মহান মুজিবের নামের পাশাপাশি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও কলঙ্কিত করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। বাঙালির জীবনে ঘটে যাওয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন গর্বিত যোদ্ধা এই লেখক আবুল খায়েরও। তাই তার কলমে যুদ্ধের ভয়াবহতা, পাকিসত্মানি শাসকচক্রের ক্রুরতা, শঠতামী, মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজনীয়তা তার কাছে অনিবার্য হয়ে উঠেছে বলেই, ইতিহাসে বিভ্রানত্মি এড়িয়ে, দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রশ্নে, অখ- পাকিসত্মানের প্রধানমন্ত্রীর হওয়ার লোভনীয় প্রসত্মাব এড়িয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অবহেলিত একটি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিতে গিয়ে জীবন আর মৃতু্যর মাঝখানে দাঁড়িয়ে যে বিশাল সিংহ হৃদয় জীবন দিয়ে মহত্তম সত্য প্রতিষ্ঠা করে গেলেন, তারই সত্যসন্ধ বিবরণ পেশ করেছেন। সে সঙ্গে দার্ঢ্যের সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের যুদ্ধকালীন ও স্বাধীনতা-উত্তরকালে রহস্যজনক ভূমিকা, আতাউল গণি ওসমানী ও মওলানা ভাসানীর মতানত্মরের রহস্য উদ্ঘাটনের পথে সন্ধিগ্ধ প্রশ্নের কাঁটাটি এগিয়ে দিয়ে অনুসন্ধিৎসু পাঠককে অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখো দাঁড়াতে প্রলুব্ধ করবে। গ্রন্থটির শুরম্নতে রয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বাণী এবং ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর একানত্ম সহচর ও মন্ত্রিসভার সদস্য প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। লেখক আবুল খায়েরের এমন সৎ সাহসিকতার জন্য জাতির কাছে ধন্যবাদার্হ্য হবেন নিঃসন্দেহে। আমি এই ঐতিহাসিক গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও নিবিড় পাঠ প্রত্যাশা করি সহৃদয় হৃদয়সংবেদী সত্যসন্ধ পাঠকের কাছে।

No comments

Powered by Blogger.