রাজশাহী পলিটেকনিকে ছাত্রলীগের হামলায় ছাত্রমৈত্রী নেতা হত- অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত, তদনত্ম কমিটি

রাজশাহী বৃহস্পতিবার রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় ছাত্রমৈত্রীর সহ-সভাপতি রেজানুর ইসলাম চৌধুরী ওরফে সানি (১৮) নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় পলিটেকনিক শাখা ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি কাজী মোতালেব হোসেন জুয়েল এবং অপর সহ-সভাপতি শেফারত হোসেন বুলবুল গুরম্নতর আহত হয়েছেন।


তবে মহানগর ছাত্রলীগ নিহত সানিকে ছাত্রলীগের কর্মী দাবি করে বলেছে, মহাজোটে ভাঙ্গন ধরানোর জন্য পলিটেকনিকের একটি কুচক্রি মহল ছাত্রলীগ ও ছাত্রমৈত্রীর নেতাকর্মীদের ওপর সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। হামলায় পুলিশ কনস্টেবল শহিদুল ইসলাম ও আশরাফ আলীও আহত হয়েছেন।
এদিকে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় বুলবুলকে সঙ্গাহীন অবস্থায় বিকেলেই উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী থেকে ঢাকায় স্থানানত্মর করা হয়েছে। অন্যদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় পলিটেকনিক কতর্ৃপক্ষ একাডেমিক কমিটির জরম্নরীসভায় ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা এবং শিক্ষার্থীদের বিকেল ৫টার মধ্যে হোস্টেল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে। ঘটনার পর পলিটেকনিক হোস্টেলে তলস্ন্লাশি চালিয়ে পুলিশ ৪ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, পলিটেকনিক ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিসত্মারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও ছাত্রমৈত্রীর মধ্যে মহাজোটের সরকার গঠনের পর থেকেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছিল। ওই দ্বন্দ্বের জের ধরে বৃহস্পতিবার হামলার ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদশর্ী ও পুলিশ জানায়, ছাত্রমৈত্রীর পলিটেকনিক শাখার সভাপতি ও কম্পিউটার শেষ বর্ষের ছাত্র কাজী মোতালেব হোসেন জুয়েল, সহ-সভাপতি সপ্তম সেমিস্টারের ছাত্র রেজানুর ইসলাম চৌধুরী ওরফে সানি এবং একই সেমিস্টারের ছাত্র সহ-সভাপতি শেফারত আলী ওরফে বুলবুল দুপুর ১২টার দিকে মেইন গেট দিয়ে পলিটেকনিক ক্যাম্পাসে প্রবেশ করছিলেন। এ সময় প্রশাসন ভবনের কাছকাছি পূর্ব থেকে ওঁৎ পেতে থাকা একদল ছাত্রলীগ কমর্ী তাদের ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। ছাত্রমৈত্রীর নেতাকর্মীরা হামলাকারীদের প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও পারেনি। এ সময় পলিটেকনিক ক্যাম্পাসে ডিউটিরত পুলিশ কনস্টেবল শহিদুল ইসলাম ও আশরাফ আলী হামলাকারীদের বাধা দিতে গিয়ে আহত হন। পুলিশ কনস্টেবল শহীদুলের একটি আঙুল কেটে যায়। আতঙ্কিত সাধারণ শিক্ষার্থীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। পরে হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসের পেছনের গেট দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে সাধারণ ছাত্ররা রক্তাক্ত অবস্থায় আহত সানি, জুয়েল ও বুলবুলকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। দুপুর ২টার দিকে ইনস্টিটিউট অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদীন শিক্ষকদের নিয়ে জরম্নরি একাডেমিক সভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে বিকেল ৫টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হোস্টেল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। তবে এখনও যাদের ফরম পূরণ বাকি আছে তাদের নিজ নিজ বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। হামলার ঘটনা সম্পর্কে অধ্যক্ষ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেননি।
মেডিক্যাল সূত্র জানায়, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সানির মাথার মগজ বের হয়ে যায়। বুলবুলের মাথায় গুরম্নতর জখম হয়। তার চোখের মধ্যে রক্ত জমেছে। ফলে সে সঙ্গাহীন হয়ে পড়ে। সভাপতি জুয়েলও মাথায় আঘাত পেয়েছেন। তার ডান হাতের একটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পরে সানিকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয় এবং সঙ্গাহীন অবস্থায় বুলবুলকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। সঙ্গাহীন বুলবুলকে ঢাকায় পাঠাতে এ্যাম্বুলেন্স পেতে বিলম্ব হওয়ায় বিক্ষুব্ধ ছাত্রমৈত্রীর কমর্ীদের হাসপাতালের সহকারী পরিচালকের সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে কথাবর্তা বলতে দেখা যায়। ওদিকে প্রায় তিন ঘণ্টা অস্ত্রোপাচারের পর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের অপারেশন থিয়েটারে রেজানুর ইসলাম চৌধুরী ওরফে সানি মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়েন। অপারেশন থিয়েটারে কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ জানান, সানির অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক ছিল। তার মাথার মগজ বের হয়ে গিয়েছিল। তার বাবা হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন। তার বাবার আকুতির প্রেক্ষিতে চিকিৎসকগণ সানিকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। নিহত সানির বাড়ি রাজশাহী মহানগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বালিয়াপুকুর এলাকায়। বিকেল ৫টার দিকে সানির মৃতু্যর খবর পেয়ে ছাত্রমৈত্রীর কর্মীরা হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ করার চেষ্টা করে। ছাত্রমৈত্রীর রাজশাহী মহানগর শাখার সভাপতি মতিউর রহমান দাবি করেন, এ সময় সাবেক যুবলীগ নেতা আসাদের নেতৃত্বে একদল উচ্ছৃঙ্খল যুবক লাঠিসোটা নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। তবে সাবেক যুবলীগ নেতা আসাদুজ্জামান জানান, তারা হাসপাতালে সানির লাশ দেখে ফিরে আসার সময় ছাত্রমৈত্রীর নামধারী কিছু ছাত্রদলের ক্যাডার তাদের ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করলে স্থানীয় দোকানি ও সাধারণ জনগণ তাদের তেড়ে বের করে দেয়। কোনো ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেনি।
এ ব্যাপারে ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন তুষার দাবি করেন, এই হামলার ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতার্মীরা জড়িত নয়। ছাত্রমৈত্রীর অভ্যনত্মরীণ কোন্দলের কারণেই এই হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে ছাত্রমৈত্রীর মহানগর সভাপতি মতিউর রহমান দাবি করেন, ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীরা ছাত্রমৈত্রীর সভাপতিসহ ৩ নেতার ওপর হামলা চালায়। ছাত্রমৈত্রী যাতে পলিটেকনিকে অবস্থান না করতে পারে সেজন্য এই আক্রমণ করা হয়েছে। তিনি অবলিম্বে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার ও শাসত্মি দাবি করেন। ঘটনার প্রতিবাদে নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল করা হবে।
এদিকে, নিহত সানিকে ছাত্রলীগ কমর্ী দাবি করে মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জেডু সরকার বলেন, সানির বাবা মনোয়ার হোসেন নান্নু মহানগরীর মতিহার থানা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং তার মা শাহীন মনোয়ার রাজশাহী মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভানেত্রী। পলিটেকনিক শাখায় তাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। কমিটি থাকলে হয়ত সানি তাদের কমিটিতে থাকত। মহাজোটে ভাঙ্গন ধরাতে একটি কুচক্রি মহলের ইন্ধন ও অংশগ্রহণে এই হামলার ঘটনা ঘটেছে বলেও তিনি দাবি করেন। জেডু বলেন, এ ঘটনায় ব্যর্থতার দায়ে বিকেলে মহানগর ছাত্রলীগের সভায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের কার্যক্রম আগামী ৩ মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা, সভাপতি নিজাম উদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনসহ ৭ জনকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার এবং বৃহস্পতিবারের ঘটনা তদনত্মের জন্য ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
অন্যদিকে, রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটির পলিটবু্যরো সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘদিন থেকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসীরা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটল। তিনি দোষীদের তাদের গ্রেফতার ও শাসত্মি দাবি করেন। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ড. জয়নুল আবেদীন বলেন, জরম্নরী সভায় সিদ্ধানত্ম নিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ইনস্টিউিট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং বিকেল পাঁচটার মধ্যে ছাত্রাবাস খালি করে দেয়া হয়েছে। বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন সন্ধ্যায় জানান, তিনি নিহত সানির লাশ নিয়ে তার বাসায় যাচ্ছেন। পলিটেকনিক ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনায় পরে হত্যা মামলা হবে।

No comments

Powered by Blogger.