মত দ্বিমত- আস্থা ফিরিয়ে আনুন by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

হলমার্ক কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার গভীর সংকট প্রতিফলিত হয়েছে। এ বিষয়ে কী করণীয়, তা নিয়ে মতামত দিয়েছেন একজন ব্যাংকার ও একজন অর্থনীতিবিদ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক থেকে একটি কোম্পানি যে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা, আর কয়েকটি কোম্পানি মিলে সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার


কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, সেটি দেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি বলেই মনে করি। এটি ঋণ প্রদানের অনিয়ম নয়, জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্ক নামে একটি অখ্যাত কোম্পানি সোনালী ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এখানে মূল অপরাধী হলমার্ক হলেও সোনালী ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশেই ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশে বড় বড় দুর্নীতি বা অনিয়মের শাস্তি হওয়ার নজির তেমন নেই। যে কারণে দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়ম বেড়ে চলেছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সরকারের উচিত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের কেলেঙ্কারি ঘটাতে সাহস পাবে না। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছি, ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হলেও অভিযুক্ত কোম্পানির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি। সরকার হয়তো যুক্তি দেখাবে, এ মুহূর্তে আত্মসাৎ করা অর্থ আদায়ই তার প্রথম অগ্রাধিকার। সেটি হতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে জালিয়াত কোম্পানির কর্মকর্তাদের ফৌজদারি আইনের আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদই যথেষ্ট নয়।
আরেকটি কথা, কেবল ব্যাংকের একজন শাখা ব্যবস্থাপকের পক্ষে এত বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। এর পেছনে ব্যাংকের ডিজিএম, জিএম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সহযোগিতা ছিল বলেই আমার ধারণা। দায় এড়াতে পারে না পরিচালনা পর্ষদও। আর যদি তাঁদের অজ্ঞাতেই এত বড় কেলেঙ্কারি ঘটে থাকে, তা হলে স্বীকার করতে হবে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বড় ধরনের দুর্বলতা আছে। সরকারের দায়িত্ব হবে সেই দুর্বলতা ও ফাঁকফোকরগুলো অবিলম্বে বন্ধ করা।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে যখন কোম্পানি করা হলো, তখন উচিত ছিল এগুলোকে কোম্পানি মডেলে পরিচালনা করা। যেমনটি বেসরকারি ব্যাংকগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। কিন্তু সরকার তা না করে এর তদারকির দায়িত্ব দিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওপর। এতে করে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে তাদের হস্তক্ষেপ বাড়ল।
আমি মনে করি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো তদারকির জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ রাখার প্রয়োজন নেই। তদারকির কাজটি বাংলাদেশ ব্যাংকই করতে পারে। তবে এ কথাও ঠিক, বাংলাদেশ ব্যাংক রোজ রোজ গিয়ে দেশের ৫০টি ব্যাংকের সাত হাজার শাখার কাজকর্ম তদারক করতে পারবে না। এটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিরীক্ষা বিভাগকেই করতে হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্তত বড় শাখাগুলোর আর্থিক লেনদেন নিরীক্ষা করে দেখতে পারে।
আরেকটি কথা, ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ গঠনে কোনো নীতি মানা হচ্ছে না। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা নিজেদের পছন্দের লোকদের নিয়োগ করে। তা করতে পারে। কিন্তু যাঁদের ব্যাংকিং বা আর্থিক খাত সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই, কেবল সাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা হওয়ার কারণে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বসানোর কী যুক্তি থাকতে পারে? বিএনপি আমলেও দলীয় বিবেচনায় এ ধরনের আরেক দল লোককে বসানো হয়েছিল।
এ কারণেই আমি মনে করি, ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বাধীন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা উচিত। ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে এই অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা যেতে পারে। কমিটি যদি ১৫ জনের নাম প্রস্তাব করে, সরকার সেখান থেকে ১০ জনকে বেছে নেবে। সে ক্ষেত্রে পর্ষদ পরিচালক নিয়োগে সরকারের কর্তৃত্বও থাকল, আবার পর্ষদ গঠনে স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করা গেল।
ব্যাংকিং খাতে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী মহোদয় যে মন্তব্য করেছেন, তাতে বিষয়টি লঘু করে দেখা হয়েছে। এতে জালিয়াতেরা এবং ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারাও উৎসাহিত হতে পারেন। সরকার অর্থ উদ্ধারে যে তৎপরতা দেখাচ্ছে, তা সমর্থনযোগ্য। কিন্তু এর পাশাপাশি অপরাধীদের শাস্তি না দিলে ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে। এটি দূর করার দায়িত্ব সরকারেরই।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ব্যবসা প্রতিযোগিতায় এ বছর বাংলাদেশ যে ১০ ধাপ পিছিয়ে গেল, এর পেছনে আর্থিক খাতের অব্যবস্থা ও সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতাও অনেকাংশে দায়ী। ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক থেকে ঠিকমতো অর্থ না পাওয়ার অভিযোগ এনেছেন। এর অন্যতম কারণ, সরকার নিজেই ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে প্রচুর ঋণ নিয়েছে। আমরা বলেছিলাম, সরকার এমনভাবে বাজেট করুক, যাতে ব্যাংক থেকে ঋণ কম নিতে হয়। সরকার ঋণ কম নিলে ব্যাংকগুলো বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বেশি ঋণ দিতে পারবে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর। চেয়ারম্যান, কৃষি ব্যাংক।

No comments

Powered by Blogger.