বাল্যবিবাহই যেন নিয়তি by সাদেকুল ইসলাম ও এ এস এম আলমগীর

পাশাপাশি গ্রাম তিনটির বেশির ভাগ মানুষই খেটে খাওয়া দিনমজুর ও নিরক্ষর। এসব গ্রামে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়েছে—এমন নজির খুঁজে পাওয়া কঠিন। মেয়েদের বয়স ১৩ থেকে ১৫ হলেই বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া-নেওয়া শুরু হয়।


গত ছয় মাসে গ্রামগুলোর ৬৫-৭০ জন ছেলেমেয়ের বাল্যবিবাহ হয়েছে। গ্রাম তিনটি দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার ৩ নম্বর খানপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ সাহাবাজপুর মৌজায় পড়েছে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ছয় মাসে যাদের বাল্যবিবাহ হয়েছে এর মধ্যে মাদ্রাসাপড়ুয়া পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণীর ছাত্রী আছে ২০ জন, অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে (১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী) আছে ২০ জন এবং পড়াশোনা করে না এমন মেয়ে আছে ২৫-৩০ জন। কাজী বিয়ে নিবন্ধনে রাজি না হলে মৌলভী ডেকে বিয়ে পড়ানো হয়। গ্রামগুলোর পাশে একটিমাত্র মাদ্রাসা রয়েছে। আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তে হলে ছেলেমেয়েদের যেতে হয় সাত কিলোমিটার দূরে অন্য উপজেলায়।
গ্রামগুলো হলো: দক্ষিণ সাহাবাজপুর (বড়গ্রাম), নটকুমারী ও পোড়াগ্রাম। এই তিন গ্রামে দুই হাজার ২০০ পরিবারে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার লোক বাস করে। স্থানীয়ভাবে তাঁরা ‘চাঁপাইয়া’ নামে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এসে পরিবারগুলো এখানে বসত গড়ে।
পোড়াগ্রামের বাসিন্দা ও কলেজশিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, ‘গ্রামে শতকরা ৯০ ভাগই বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বাল্যবিবাহ ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অভিভাবকেরা বুঝতে চান না। উল্টো নাখোশ হন।’
গত ছয় মাসে উপবৃত্তি পাওয়া আট ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে বলে দক্ষিণ সাহাবাজপুর দ্বিমুখী দাখিল মাদ্রাসা সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণীর একজন, ষষ্ঠ শ্রেণীর এক, সপ্তম শ্রেণীর দুই, অষ্টম শ্রেণীর তিন ও নবম শ্রেণীর একজন ছাত্রী রয়েছে। বাল্যবিবাহের শিকার এসব ছাত্রীর নাম-পরিচয় প্রথম আলোর কাছে আছে। কিন্তু সামাজিক সম্ভ্রম বিবেচনায় তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হলো না।
মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট মাওলানা মো. কাদিমুল হক ছাত্রীদের বাল্যবিবাহের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য অভিভাবক ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকের চেষ্টা করা হয়। তাতে গ্রামবাসীর সাড়া মেলেনি। উল্টো গ্রামের লোকজনের রোষানলে পড়তে হয়।
মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক একরামুল হক বলেন, ‘প্রতি মাসে এই প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে তিনজন ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ৮৫ জনের মতো ছাত্রী ভর্তি হয়েছিল। সপ্তম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত যেতে প্রায় ৬০ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। ওই ব্যাচে ভবিষ্যতে দাখিল পরীক্ষার জন্য ছাত্রী আছে মাত্র ১৯ জন।’
মৌজাটির আশপাশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। প্রায় ৫০০ মিটার পূর্বে দক্ষিণ সাহাবাজপুর দ্বিমুখী দাখিল মাদ্রাসা এবং পোড়াগ্রামে একটি রেজিস্ট্রার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। উচ্চবিদ্যালয়ে পড়তে হলে শিক্ষার্থীদের সাত কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়ী উপজেলা শহরে বা মৌজার পশ্চিমে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে রতনপুর গ্রামে যেতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই তিন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ রাজমিস্ত্রির জোগালি ও দিনমজুর। গ্রামে শিক্ষিত ছেলে হাতে গোনা। ছেলেদের বয়স ১০-১২ বছর হলেই রোজগার করতে পাঠানো হয়।
বিরামপুরের খানপুর ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার মো. রেহান রেজা বলেন, বাল্যবিবাহের কারণে ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। গত ছয় মাসে ইউনিয়নজুড়ে ৩০টির মতো বিয়ে পড়াতে পেরেছেন। অধিকাংশ বাল্যবিবাহের নিবন্ধন করা হয় না। স্থানীয় মৌলভী দিয়ে বিয়ে পড়ানো হয়। তিনি জানান, অভিভাবকদের কাছে বয়স প্রমাণের জন্য জন্মনিবন্ধনের সনদ চাইলে খুব খারাপ আচরণ করে, হুমকি-ধমকি দেয়।
৩ নম্বর খানপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘মেয়েদের বয়স বেশি হলে ও লেখাপড়া শেখালে শিক্ষিত বর দরকার হবে। এ ক্ষেত্রে যৌতুকও বেশি দিতে হবে। অল্প বয়সে ভালো বরের সন্ধান মেলে, তাই অভিভাবকেরা চিন্তাভাবনা না করে মৌলভী ডেকে বাল্যবিবাহ দিয়ে দেন।’
ইউপি চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলী বলেন, ‘আগে এ রকম কিছু ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু এখন জন্মনিবন্ধনে সঠিক বয়সটা উল্লেখ থাকে। এ কারণে কাজিদের আর বাল্যবিবাহ দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে বাড়িতে যদি মৌলভী ডেকে চুপিচুপি বিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেটা আমাদের জানা নেই।’
অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন এমন কয়েকজন অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাঁয়ের পরিবেশ ভালো লয়। কাজ-কামের জন্য দূর-দূরান্তে যাতি হয়। সিয়ানা মাইয়া বাড়িত রাখতি ভয় লাগে, কখন কী হয়।’
বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোখছানা বেগম বলেন, ‘বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জেনেছি। তবে বাল্যবিবাহ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের কিছুই করার থাকে না।’ ওই এলাকার মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কিছু দিনের মধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.