ফায়দা হাসিলে রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রাখছে জামায়াত-শিবির- জেএমবি ও হুজি জঙ্গীরাও জড়িত, পাহাড়ে আস্তানা

কক্সবাজার ও বান্দরবানে মৌলবাদী জামায়াত শিবির এবং তিনটি এনজিও সংস্থা এবং অন্য উগ্রবাদীরা রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রেখে বিভিন্ন ফায়দা হাসিলে অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এদিকে, কক্সবাজার ও পার্বত্য বান্দরবান জেলার বিভিন্ন পাহাড়ী এলাকায় আস্তানা গড়ে শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেছে জেএমবি ও হুজি সদস্যরা।
সম্প্রতি কক্সবাজার জেলা পুলিশের সাহসী অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে ১৬ জঙ্গী সদস্য। মূল দলের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ার কারণে একের পর এক জঙ্গী গ্রেফতার হচ্ছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। ১ ও ২ সেপ্টেম্বর জেলা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ৪ জঙ্গী। তাদের ৫ দিনের রিমান্ডে আনার পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। সে তথ্যানুযায়ী পুলিশ এ পর্যন্ত কক্সবাজার ও বান্দরবানের আলীকদমের গভীর অরণ্যে সাঁড়াশী অভিযান চালিয়ে মহিলাসহ ৩ জনকে আটক করেছে। কক্সবাজার মডেল থানা পুলিশের হাতে রিমান্ডে থাকা ৪ জঙ্গী, পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও জামায়াত উল মুজাহেদিন (জেএমবি) থেকে বের হয়ে আসার কারণেই তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। মূলত তাদের মধ্যে আটক কাজী ফারুক ও আব্দুল্লাহ হেল কাফি জেএমবি ও হুজি’র দ্বিতীয় সারির নেতা ছিলেন। পুলিশের হাতে জব্দ হওয়া গোপন ডায়েরিটিও তাদের। ওই ডায়েরিতে ২০০০ সাল থেকে তাদের যাবতীয় কর্মকা- লিপিবদ্ধ রয়েছে। সেথায় জঙ্গী নেতা সাইদুর রহমানের সঙ্গে তাদের একাধিক বৈঠকের তথ্যও রয়েছে। আছে ১২ জঙ্গীর মূল নাম ও সাংকেতিক নাম। সূত্র জানায়, জেএমবি ও হুজির বাংলাদেশে পরিচালিত কর্মকা-ে সন্তুষ্ট হতে না পেরে জঙ্গী নেতা তারেক ওরফে সালমান ওরফে রুহুল আমিনের নেতৃত্বে ওই দুটি জঙ্গী সংগঠনের অর্ধশত জঙ্গী মিয়ানমার সীমান্তের বান্দরবান জেলার আলীকদমের গহীন অরণ্যে আস্তানা গড়ে তোলে। সেখানে তারা খামারের অজুহাতে জমি লিজ নিয়ে তাতে জঙ্গী কর্মকা- চালিয়ে আসছিল। তাদের মধ্যেই সেখানে নতুন করে জঙ্গী সংগঠন গড়ে তোলার বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়। তাদের মধ্যে রফিক, কাফি, কাজী ফারুক, মতিনসহ ৬ সদস্য বাংলাদেশে কোন ধরনের জঙ্গী কর্মকা- না চালানোর পক্ষে মত দেন। তাদের দাবি ছিল বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সুতরাং সেখানেই বিধর্মীদের ওপর জঙ্গী হামলা চালানোর পক্ষে ছিল তারা। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা রোহিঙ্গাদের কয়েকটি সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে ‘জামায়াতুল আরাকান’ নামের জঙ্গী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে মতানৈক্য সৃষ্টি হলে রফিকের নেতৃত্বে ৬ জঙ্গী সদস্য পরিবার-পরিজন নিয়ে কক্সবাজার শহরে চলে আসে।
সূত্র আরও জানায়, রিক্সা ও টমটম গাড়ি চালিয়ে তারা শুরু করে কক্সবাজার শহর ও শহরতলিতে কর্মী সংগ্রহের কাজ। তবে কক্সবাজার এসেও তারা কর্মী সংগ্রহে তেমন কোন সফল হতে পারেনি। শুধু ধার্মিক হিসেবে কক্সবাজার শহরের বাহারছড়ার রুবেল নামের আটক কিশোরকে টার্গেট করে তাকে বইপত্র দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওইসব বই ও দাওয়াতকে রুবেল তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। এর পরও রুবেলকে টার্গেট করেই তারা তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত। একসময় ওসব কাজে সফল হতে না পেরে কাজী ফারুক ও আব্দুল্লাহ হেল কাফি জঙ্গী মতবাদে এতই বিশ্বাসী ছিল যে, তারা তাদের টমটম ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র বিক্রি করে ভারত হয়ে আফগানিস্তানে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। তবে এর আগেই এসব মতবিরোধ নিয়ে খুন হন জঙ্গী নেতা তারেক ওরফে সালমান ওরফে রুহুল আমিন। তারেক খুন হওয়ার পর থেকে ওসব জঙ্গীর কোন ধরনের দলনেতা ছিল না। যে কয়জন জঙ্গী ছিল তারা ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে।
কক্সবাজারে জামায়াত-শিবির ক্যাডার ৩টি এনজিও সংস্থা এবং মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠনগুলো দেশে রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রেখে তাদের বিভিন্ন ফায়দা হাসিল করতে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এটি এদের প্রণীত নীলনকশারই অংশ। তাছাড়া মিয়ানমার থেকে ফের রোহিঙ্গা আনতে তৎপর হয়ে ব্যর্থ ওইসব গোষ্ঠী বর্তমানে নাশকতামূলক কর্মকা- ঘটাতে নানা প্ররোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে স্থানীয়রা। হাট-বাজারে, বিভিন্ন চাকরি ও দিনমজুরি কাজে, লঞ্চ-স্টিমার, ফিশিং ট্রলার, যানবাহন এবং বহু ওয়ার্কসপেও রোহিঙ্গারা সামান্য মজুরিতে শ্রম দিয়ে দেশের বেকার যুবকদের ভাগ্য ও নিয়মিত কাজ-কাম থেকে মাহরোম করে দিয়েছে। কক্সবাজারের বাসিন্দাদের জন্য এখন প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ওইসব রোহিঙ্গা। জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীদের প্ররোচনায় দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান এ সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে ক্রমশ আরও দীর্ঘতর করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ১৯৬২ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অজুহাত তোলে ও সময় মোটা দাগে ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার কুটনৈতিক আলোচনার পর কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা সে দেশে ফিরে গেলেও কিছু রোহিঙ্গা থেকে যায় এদেশে। ১৯৭৮ সালে বিএনপি সরকারের মদদ পেয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশে। তখন থেকে জামায়াত-বিএনপির স্থানীয় কিছু নেতা নিজেদের ভোট ব্যাংক তৈরি করতে ওইসব রোহিঙ্গাকে ভোটার তালিকায়ও অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এই সুযোগে আরাকানভিত্তিক কিছু জঙ্গী সংগঠন কতিপয় সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাকে তাদের দলে যুক্ত করে আরও মজবুত করে তোলে জামায়াতে আরাকান, আরএসও, আরইএফ, এআরএনও, নোপাসহ বিভিন্ন আরাকান বিদ্রোহী সংগঠন। জামায়াত-বিএনপির কতিপয় নেতার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ওই সময় জঙ্গীরা উখিয়ার একাধিক পাহাড়ে ঘাঁটি তৈরি করে সশস্ত্র অবস্থান নেয়। সেখানে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের অস্ত্র হাতে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৪ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করলেও ঐ রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ১ লক্ষাধিক লোক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে স্থানীয় বাসিন্দা বলে দাবি করে চলেছে।
১৯৯২ সালে মিয়ানমার থেকে আবারও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অজুহাত তুলে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় ১৯৯৪ সালেও ২ লাখ রোহিঙ্গা অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে কক্সবাজার ও পার্বত্য বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দু’দেশের সৌহার্দপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত আড়াই লাখ তালিকাভুক্ত শরণার্থীদের মধ্যে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫শ’ ৯৯ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়। আরও ২৭ হাজার ৫শ’ শরণার্থী টেকনাফ-উখিয়ার দুটি ক্যাম্পে প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় রয়েছে। অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গারা বস্তি তৈরি করে লেদা ও কুতুপালং শিবিরের পাশে অবস্থান ও বসবাস করে যাচ্ছে অদ্যাবধি। রোহিঙ্গা সমস্যাকে জিয়ে রাখতে আন্তর্জাতিক কতিপয় সাহায্য সংস্থাগুলোর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।

No comments

Powered by Blogger.