পালানোর আশঙ্কা হলমার্ক কর্তাদের-গ্রেপ্তার ক্ষমতা চায় দুদক by মোশতাক আহমদ

সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ হলমার্কের কর্মকর্তাদের দেশ ছেড়ে পালানোর আশঙ্কা করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল শুক্রবার দুদকের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠের কাছে এমন আশঙ্কার কথা জানান।


তহলমার্ক কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান দলের সদস্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের উপ-পরিচালক জানান, দুদক আইনে সীমাবদ্ধতার কারণে অভিযুক্তদের কাউকে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। কিন্তু নিরপেক্ষ তদন্ত ও প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করার স্বার্থে হলমার্ক গ্রুপের এমডিকে এখনই গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন। তা না হলে দুদকের তদন্ত কাজ আরো পিছিয়ে যেতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, অনুসন্ধানের স্বার্থে দুদকের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা থাকা দরকার। কিন্তু আইনে না থাকলে আমরা কি করব? তিনি বলেন, ১৯৫৭ সালের দুর্নীতি দমন আইনে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা ছিল, কিন্তু কেন যে এখন তা রাখা হয়নি তা বোধগম্য নয়। তিনি দুদক আইনের সংশোধনীতে দুদক কর্মকর্তাদের অনুসন্ধানের স্বার্থে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা প্রদানের বিষয়টি সংযুক্ত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো থাকাকালেও অভিযুক্তদের সার্স, মালামাল জব্ধ করা ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা ছিল। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন-২০০৪-এ এ ক্ষমতা বিলুপ্ত করা হয়েছে। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশন সংশোধনী ২০১২তেও দুদক কর্মকর্তাদের এ ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
জাতীয় সংসদের চলমান অধিবেশনে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফজলে রাবি্ব মিয়া দুদক আইনের সংশোধনী জাতীয় সংসদের অধিবেশনে উপস্থাপন করেছেন। সংশোধনীর প্রস্তাবেও দুদক কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা রাখা হয়নি।
তবে দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার চাইলে এ সংশোধনীতে সামান্য কয়েকটি শব্দ যোগ করলেই দুদক তার শক্তি ফিরে পেতে পারে। সার্স, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পেলে দুদকের অনুসন্ধানের গতি হাজার গুণ বেড়ে যাবে। দেশের মানুষও দুদকের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ফল পাবে।
দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এর ২০ ধারায় দুদক কর্মকর্তদের থানার ওসির সমান মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু একজন ওসির ন্যায় সার্স, জব্দ ও কাউকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সংশোধনীতে তা অন্তর্ভুক্ত করলে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন আরো যুগোপযোগী হয়ে উঠবে।
বর্তমান আইনে কাউকে গ্রেপ্তার করতে আদালতের অনুমতি নিতে হয় দুদকের। এ জন্য আগে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলাও করতে হয়। মামলা করতেও কমিশনের পূর্বানুমতি দরকার। এসব সীমাবদ্ধতার কারণে দুদকের অনুসন্ধানকাজে প্রায়ই কোনো অগ্রগতি দেখা যায় না।
এদিকে সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্কসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠানের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট চার বছরের এলসির কাগজপত্র ও সংশ্লিষ্ট নথি তলব করেছে দুদক। এজন্য সংশ্লিষ্ট আরো দেশি-বিদেশি ২৬টি ব্যাংকের কাছেও চিঠি দিচ্ছে দুদক। রূপসী বাংলা শাখায় হলমার্কসহ ছয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ব্যাংকের বিল ক্রয়সংক্রান্ত নথি খতিয়ে দেখতে ব্যাংকগুলোর কাছে চিঠিও পাঠানো শুরু করেছে দুদক। এই নথি চেয়ে গত ১৪ আগস্ট থেকে চিঠি পাঠানো শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে সাউথইস্ট ব্যাংক, এনসিসি, আইএফআইসি, এক্সিমসহ বেশকিছু ব্যাংক প্রয়োজনীয় নথি সরবরাহ করেছে। অন্যান্য ব্যাংকও শিগগিরই নথি সরবরাহ করবে বলে মৌখিকভাবে দুদককে জানিয়েছে।
দুদকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করে কালের কণ্ঠকে জানান, জড়িত ব্যাংকগুলো কোনো খোঁজখবর না নিয়েই সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখার বিভিন্ন বিল কিনেছে। এর মাধ্যমে হলমার্কসহ ছয় প্রতিষ্ঠানকে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে এসব ব্যাংকের বিল ক্রয়-সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে হলমার্ক গ্রুপ একাই আত্মসাৎ করেছে দুই হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া টি অ্যান্ড ব্রাদার্স ৬০৯ কোটি টাকা, প্যারাগন ব্রাদার্স ১৪৬ কোটি, ডিএন স্পোর্টস ৩৩ কোটি, নকশি নিট ৬৬ কোটি ও খানজাহান আলী গ্রুপ পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এ ঘটনায় হলমার্ক ও ডিএন স্পোর্টসের ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। বাকি চার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আগামী সপ্তাহে নোটিশ পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।
শ্রমিকদের রাস্তায় নামাল হলমার্ক
সাভার থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, হলমার্ক গ্রুপ প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শ্রমিককে রাস্তায় নামিয়েছে। শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে গতকাল শুক্রবার মানববন্ধন ও মহাসড়ক অবরোধ করেছে। তাদের দাবি, হলমার্ক গ্রুপের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাভারের তেঁতুলঝোড়ার নন্দখালী এলাকায় কারখানার সামনে হেমায়েতপুর-সিঙ্গাইর সড়কের পাশে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে হলমার্কের প্রায় চার হাজার শ্রমিক। এ সময় তাদের হাতে ছিল 'হলমার্ক গ্রুপের ৪০টি প্রতিষ্ঠান থাকতে কেন বলা হয় ভুয়া প্রতিষ্ঠান, জবাব চাই, দিতে হবে' স্লোগান লেখা ব্যানার, প্লাকার্ড ও ফেস্টুন।
শ্রমিকরা হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা ষড়যন্ত্রমূলক বলে দাবি করে সেগুলো প্রত্যাহার করার দাবি জানায়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে দিয়ে কারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছে।
মানববন্ধনের পর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শ্রমিকরা মিছিল নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে। এ সময় শ্রমিকদের মধ্য থেকে কয়েকজন এ সময় যানবাহন লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। এতে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে যাত্রীরা অবর্ণনীয় কষ্টের শিকার হয়। পরে পুলিশ এসে শ্রমিকদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
শ্রমিকদের এই কর্মসূচির ব্যাপারে হলমার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) শামীম হোসেন সাংবাদিকদের জানান, প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক লেনদেন বন্ধ করে দেওয়ায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতা সময়মতো পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। তাই শ্রমিকরা তাদের জীবন-জীবিকার জন্য আন্দোলনে নেমেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলমার্ক গ্রুপের এক শ্রমিক নেতা বলেন, কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র করে যদি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করা হয়, তবে তাঁরা চুপ করে বসে থাকবেন না। এ নেতার দাবি, গণমাধ্যমের অপপ্রচারে(?) বিদেশি বায়াররা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি বলেছেন, হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ এসব কর্মীকে প্ররোচনা দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে মহাসড়ক অচল করে সরকারকে হুমকি দিচ্ছেন, যাতে গ্রুপটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা যেন না নেওয়া হয়।
সাভার মডেল থানার অফিসার ওসি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদের বিরুদ্ধে জমি দখল, ম্যাজিস্ট্রেটকে মারধর, হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৩টি মামলা ও ২০টি সাধারণ ডায়েরি হয়েছে সাভার থানায়। মহাসড়কের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হেমায়েতপুর এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

No comments

Powered by Blogger.