মোবাইল ফোন টাওয়ার বিকিরণের শিকার চড়ুই মৌমাছি শালিক by শাহীন রহমান

প্রযুক্তির ছোঁয়া এখন দেশের আনাচে কানচে। প্রযুক্তির এ ছোঁয়া মানুষের উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তির অভিশাপ থেকে মানুষ ও জীব জগত মোটেও নিরাপদ নয়। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সবার হাতে পৌঁছে গেছে মোবাইল ফোন।


কিন্তু এ সেলফোনের টাওয়ারের প্রভাব থেকে মানুষ ও প্রকৃতি কতটা মুক্ত? সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে তড়িৎ চুম্বকীয় যে বিকিরণ হচ্ছে তাতে মানুষ জীবজগত ও পক্ষীকুলের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে এর ফলে পশুপাখি পতঙ্গকুলের আচরণ যেমন বদলে যাচ্ছে, তেমনি এর প্রভাব পড়ছে প্রজননে। ফলে তাদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, মোবাইল টাওয়ারের সংখ্যা যত বাড়ছে গৃহস্তের সবচেয়ে কাছে বাস করা চড়ুই পাখির সংখ্যাও তত কমে আসছে। মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণের ফলে চড়ুই পাখির প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক (৪ পৃষ্ঠা ৩ কঃ দেখুন) মোবাইল ফোন
(প্রথম পৃষ্ঠার পর)
সময় এই বিকিরণের মধ্যে পড়ে চড়ুইয়ের ডিমও ফুটছে না। বিশেষজ্ঞরা লক্ষ্য করেছেন, এই বিকিরণের প্রভাবে মৌমাছির মধ্যেও একটা অদ্ভুত আচরণ ধরা পড়ছে। টাওয়ারের আশপাশ থেকে হঠাৎ মোমাছির দল উধাও হয়ে যাচ্ছে। খাবার যোগাড় করতে গিয়ে এই তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে পড়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ছে। ফলে তারা মৌচাকে ফেরার পথ চিনতে পারছে না। মাঝপথে তারা মারা পড়ছে। এর প্রভাবে শুধু যে চড়ুই ও মৌমাছি তাদের প্রজাতি হারাচ্ছে তা নয়, শালিক, টুনটুনি ও ময়না পাখিও একই অবস্থার শিকার হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাওয়ারের এক কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী মানুষসহ যে কোন জীবের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে জেনেটিক পরিবর্তনসহ মানুষের স্মৃতিশক্তি নষ্ট, অবসন্নতা, লিউকেমিয়া, এলার্জি, মাথাব্যথা এবং চর্মরোগও হতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে বীর্যে শুক্রাণুর পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ার প্রভূত আশঙ্কা থাকে। শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশও ব্যাহত হতে পারে। এসব রোগ উপসর্গ ১০-২০ বছর পরে দেখা দেয়ার আশঙ্কা বেশি। আবার টাওয়ারের নিচে থাকা ডাব, কলা, আমের ওপর এর প্রভাব রয়েছে। সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, টাওয়ার এলাকায় গাছে ফুল ও ফল কম এসেছে। ফলের দাগ ও ঝড়ে পড়ার সংখ্যার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।
দেশের যততত্র নিয়মনীতি ছাড়াই গড়ে উঠেছে এসব মোবাইল টাওয়ার। এসব টাওয়ার বসানোর সময় এর রেডিয়েশন বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এমনকি এর ফলে প্রকৃতির ওপর কি ধরনের প্রভাব পড়ছে তা নিয়ে তেমন কোন গবেষণা নেই। পরিবেশ তথা মানুষ, জীব-জন্তু ও উদ্ভিদকুলের ওপর মোবাইল টাওয়ারের আদৌ কোন ক্ষতিকর প্রভাব আছে কি না সে বিষয়ে কোন গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত আজও নেই আমাদের হাতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের ওপর এসব টাওয়ারের সত্যিকার যদি কোন ক্ষতিকর প্রভাব থাকে তবে পরের প্রজন্মকে যুগযুগ ধরে তার মাসুল দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত যে কোন ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড (ইএমএফ), ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন (ইএমআর) এবং রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি (আরএফ) স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাদের মতে, মোবাইল টাওয়ার থেকেও এক ধরনের আরএফ, ইএমএফ ও ইএমআর তৈরি হয়। এককভাবে একটি টাওয়ারের যে আরএফ, ইএমএফ এবং ইএমআর বিকিরণ হয় তা ক্ষতিকর না হলেও একই ভবনে বা এলাকায় অনেক টাওয়ার বসানোর ফলে বিকিরণের ওয়েভ বেড়ে যায়। সামগ্রিকভাবে যে আরএফ, ইএমএফ এবং ইএমআর তৈরি হয় তার মাত্রা অনেক। ফলে মানব স্বাস্থ্যের পাশাপাশি পক্ষীকুলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, মোবাইল টাওয়ারের কাছে বসবাসকারী লোকজনদের এক বিশেষ ধরনের আকর্ষণ বা বিকর্ষণ মোকাবেলা করে চলতে হয়। ফলে তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাত্রা খুবই বেশি। মোবাইল টাওয়ার থেকে প্রতি বর্গমিটারে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা হচ্ছে ১৭১০০ থেকে ৭২০০০ মাইক্রোওয়াট। ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফ্রিকুয়েন্সি হলো ১৯০০ মেগাহার্জ, যা ভবনে বা আশপাশে বসবাসকারীদের শরীরে সহজেই ভেদ করতে পারে। এটা মানুষের শরীরে মুক্ত বা সুপার আয়ন তৈরি হওয়ার কারণসহ ক্যান্সার, হৃদরোগ, ব্রেন টিউমার এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্গান ড্যামেজের আশঙ্কা দারুণভাবে বাড়িয়ে দেয়। ফলে টাওয়ারের কারণে মানুষের তো বটেই বরং এক কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী যে কোন জীবের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
তবে আমাদের দেশে মোবাইল টাওয়ারে তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণ নিয়ে বিস্তর কোন গবেষণা না হলেও বম্বে নেচার হিস্ট্রি সোসাইটি এ বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান ও গবেষণা চালিয়ে যে তথ্য উপাত্ত পেয়েছে তা এক কথায় ভয়ঙ্কর। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে বম্বে নেচার হিস্ট্রি সোসাইটির পরিচালক আসাদ রহমানির নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণা রিপোর্ট প্রদান করা হয় সে দেশের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে। তাতে দেখা গেছে, স্বপ্ন মেয়াদে এর বিরূপ প্রভাব না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে এর সংস্পর্শে থাকলে প্রভাব পড়তে বাধ্য। শুধু মোবাইল টাওয়ার নয়, যে কোন যোগাযোগ টাওয়ার থেকে নির্গত রেডিও তরঙ্গ ও মাইক্রোওয়েভ একত্রিত হয়ে বায়ুম-লে একটি তড়ি চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে। তৈরি হয় এক ধরনের বিকিরণের দূষণ। এই দূষণ পশুপাখি তরঙ্গের জীবন ধারণের জন্য ক্রমশই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে বলে ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, মোবাইল টাওয়ারের সংখ্যা যত বাড়ছে ততই কমছে গৃহস্তের সবচেয়ে নিকটে বাস করা চড়ুইয়ের সংখ্যা। এতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমীক্ষার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, উন্নত বিশ্বেও এই অবস্থার শিকার হচ্ছে পশুপাখি ও পক্ষীকুল। ইউরোপের অনেক শহরে এখন চড়ুইয়ের দেখা মেলা ভার। এতে দেখানো হয়েছে, ১৯৯৪ সালে লন্ডন শহরে যত চড়ুই ছিল সেলফোনে প্রভাবের কারণে এখন ৭৫ ভাগ চড়ুই সেখান থেকে হ্রাস পেয়েছে। মোবাইল টাওয়ারের নির্গত বিকিরণের কবলে পড়ে চড়ুই প্রজনন ক্ষমতা হারাচ্ছে। অনেক সময় তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণের মধ্যে পড়ে চড়ুইয়ের ডিমও ফুটছে না। ৫০টি চড়ুইয়ের ডিম পরীক্ষমুলকভাবে ৩০ মিনিট ধরে তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণের মধ্যে রেখে গবেষকরা দেখতে পান সব ডিম নষ্ট হয়ে গেছে।
ওই রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যেসব এলাকায় এসব মোবাইল টাওয়ারের সংখ্যা অধিক সেসব এলাকা থেকে আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে শালিক, টুনটুনি, বুলবুলি, ময়না, টিয়া। গবেষকরা মৌমাছির ওপর গবেষণা করে নিশ্চিত হয়েছেন বিকিরণের প্রভাবে মৌমাছিরা অদ্ভুদ ধরনের আচরণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, টাওয়ারের আশপাশ থেকে হঠাৎ একদিন মৌমাছির দল উধাও হয়ে যাচ্ছে। খাবার যোগাড় করতে গিয়ে তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছে। মৌচাকে ফেরার পথ তারা চিনতে পারছে না। মাঝ পথে মারা যাচ্ছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত বছর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে ৬০ ভাগ মৌচাকে এবং পূর্ব উপকূলে ৭০ ভাগের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। আগে যেখানে একটি রানী মৌমাছি গড়ে দিনে সাড়ে তিন শ’ ডিম দিত এখন তা কমে এক শ’য় দাঁড়িয়েছে। এই রিপোর্টের মতে, মোবাইল ফোন টাওয়ারের কারণে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে পারে অন্যান্য পতঙ্গ। কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাদুড়ের তীক্ষ্ম সেন্সকেও ধোঁকায় ফেলছে এই তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাদুড় দিক নির্ণয়ের জন্য এক ধরনের শব্দ তরঙ্গ বা সেন্সর ব্যবহার করে। যার দ্বারা নিজেকে গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, ভবন, বৈদ্যুতিক খুঁটি বা অনুরূপ কোন উঁচু জিনিসের সঙ্গে ধাক্কা লাগা থেকে রক্ষা করে। বাদুড়ের চলার পথে এসব উঁচু কোন কিছুর উপস্থিতি আঁচ করে দূর থেকেই গতিপথ পরিবর্তন করে। কিন্তু মোবাইল টাওয়ার বাদুড়ের এই তীক্ষ্ম সেন্সরকে ধোঁকায় ফেলেছে। উড়াল দেয়ার পরেই বাদুড়ের মনে হয় পথজুড়ে নিরেট কি যেন গতি রোধ করে আছে। শুধু বাদুড় নয়, অন্য পাখিও টাওয়ারকে কাক তাড়ুয়ার মতো মনে করে, ভয় পায় এবং অস্বস্তিবোধ করে। ফলে টাওয়ার এলাকায় প্রতিদিন বাদুড় ও পাখির সংখ্যা কমছে। শুধু পাখি নয়, ডাব, কলা ও আমের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক। মোবাইল ফোনের কারণে এসব ফলমূলে যে প্রভাব পড়ছে তা স্থানীয় চাষীদের জানা। সম্প্রতি দেখা গেছে, মসৃণ সবুজে ভরা কচি ডাব আর পাওয়া যায় না। সব গা-ফাটা, অমসৃণ পানিশূন্য ডাব। কচি ডাব আর ঝুনো ডাবের পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ছে। শুধু ডাব নয়, কলা ও আমের অবস্থাও একই। বিভিন্ন ফলমূল তাদের আকর্ষণীয় লাবণ্য ও বাহ্যিক সৌন্দর্য হারাচ্ছে এর ফলে। সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, টাওয়ার এলাকায় গাছে ফুল ও ফল কম এসেছে এবং ফলের দাগ ও পতন বেড়েছে।
গত বছর ১ জুনে ইউএসএ টুডের প্রথম পাতায় প্রধান খবর ছাপা হয় সেলফোন ও ক্যান্সার নিয়ে। এতে বলা হয়, গত বছর মে মাসের শেষ সপ্তাহে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আয়োজনে ফ্রান্সে যে প্রোগ্রাম হয় সেখানে ৩১ জন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ মোবাইলের ক্ষতিকর দিক নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। এতে মোবাইল ও টাওয়ার থেকে যে রেডিয়েশন হয় সে ব্যাপারে সবাই একমত পোষণ করেন। সম্প্রতি ডাচ গবেষকদের এক গবেষণায় বলা হয়, (টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত) নেটওয়ার্ক থেকে নির্গত হওয়া রেডিয়েশন বড় বড় গাছের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ওয়্যারলেস রাউটারের নিকটে গাছ লাগানো হলে গাছের শাখা এবং পাতা ঝরে যায়। এতে বলা হয়, টাওয়ার থেকে নির্গত রেডিয়েশন কেবল গাছেরই নয়, মানুষের শরীরেও প্রভাব ফেলতে পারে। গবেষকদের বরাত দিয়ে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, নেটওয়ার্ক উৎসের নিকটে থাকা গাছগুলোর পাতায় সীসার মতো এক ধরনের উজ্জ্বল প্রলেপ পড়ে। তাতে পাতা মরে যায়। রেডিয়েশনের ফলে গাছে ফলের বৃদ্ধিও কমে যায়। এতে বলা হয়, নেদারল্যান্ডের শহুরে এলাকায় শতকরা ৭০ ভাগ গাছেই রেডিয়েশনজনিত সমস্যা দেখা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.