কর্মসূচী প্রত্যাহার ॥ তবে ক্লাসে যাচ্ছি না, মন্ত্রীর আশ্বাস বাস্তবায়ন হলে যাব -০ সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা শিক্ষার্থীদের -০ বর্তমান ভিসির অধীনে ক্লাসে ফিরতে আপত্তি নেই -০ মামলা প্রত্যাহারে থানায় আবেদন কর্তৃপক্ষের -০ প্রো-ভিসিকে অব্যাহতির সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে

কর্মসূচী প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তবে একই সঙ্গে তারা ঘোষণা দিয়েছে, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছ থেকে পাওয়া আশ্বাসের পূর্ণ বাস্তবায়ন হলেই আমরা ক্লাসে যাব। উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএম নজরুল ইসলামের অধীনে ক্লাসে ফিরতে আপত্তি নেই।


ক্লাসে ফিরতে আমরা প্রস্তুত। কিন্তু উপ-উপাচার্যের অব্যাহতি, মামলা তুলে নেয়া ও আবাসিক হলসহ প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক রদবদলের যে প্রতিশ্রুতি শিক্ষামন্ত্রী দিয়েছেন আগে সেগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে। বুধবার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে ‘আমরা আশ্বস্ত’ বলে ঘোষণা দেয়ার পর শুক্রবার বুয়েট ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। এদিকে ঘোষণা অনুসারে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে। মামলা প্রত্যাহারে থানায় আবেদন করেছে কর্তৃপক্ষ। উপ-উপাচার্যের অব্যাহতির জন্যও সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তবে অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, উপাচার্যের অপসারণ ছাড়াই আপাতত উপ-উপাচার্যের অব্যাহতি ও মামলা প্রত্যাহারসহ প্রশাসনে রদবদল হলে বুয়েট শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি ও শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসের প্রেক্ষাপটে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
অন্যদিকে গত কয়েকদিনের কর্মকা-ের পর অভিযোগ উঠেছে, ক্লাস নয়, আন্দোলনই আসলে লক্ষ্য শিক্ষক সমিতির। শিক্ষার্থীদের ক্লাস না নিলেও গত ৪ মাসে একবারও নিজেদের বেতন তুলতে ভুলছেন না সততার বুলি আওড়ানো শিক্ষকগণ। যথারীতি করেছেন কনসালটেন্সি। খ্যাপের কাজ যথারীতিই করেছেন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোথাও। শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষক নেতাদের নিজস্ব স্বার্থ সিদ্ধির নানা দাবি ঢুকিয়ে দেয়া, আন্দোলন ঝুলিয়ে রাখা এবং হলসহ প্রশাসনিক পদে বিগত বিএনপি-জামায়াত আমলের ব্যক্তিদের নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরই অংশ হিসেবে শিক্ষক সমিতির কিছু নেতা শিক্ষার্থীদের দিয়ে দাবি তুলেছেন, হলসহ প্রশাসনিক পদে যে রদবদল হয়েছে তার পুনর্বিন্যাস করতে হবে। বিষয়টিকে কিছু নেতার পদ-পদবী দখলের রাজনীতি বলে অভিহিত করেছেন সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কারণ এর সঙ্গে শিক্ষার্থী কিংবা সাধারণ শিক্ষকদের স্বার্থের কোন সম্পৃক্ততা নেই। এর আগে উপ-উপাচার্যের অব্যহতি ও মামলা প্রত্যাহারে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ঘোষণায় শিক্ষক সমিতির পর বুধবার নমনীয় অবস্থান নেয় আন্দোলরত শিক্ষার্থীরা। সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ তিন ঘণ্টার বৈঠক শেষে আন্দোলকারী শিক্ষার্থীরা বলেছিল, আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। বৈঠক শেষে বুয়েট শিক্ষার্থীদের ১৬ সদস্যের প্রতিনিধিদল বলেছে, ইতোমধ্যেই উপ-উপাচার্যের অব্যাহতি ও মামলা তুলে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। উপচার্যের পদত্যাগ ও অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন শিক্ষামন্ত্রী। আন্দোলকারীদের নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তাও শিক্ষামন্ত্রী দিয়েছেন। আমরা মন্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হয়েছি। এ অবস্থায় আন্দোলন নিয়ে পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলন করে আমাদের অবস্থান আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেব। এরই ধারাবহিকতায় শুক্রবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে তারা। লিখিত বক্তব্যে তারা বলে, বুয়েটের ঐতিহ্য ও শিক্ষার পরিবেশ পুনরুদ্ধার এবং রক্ষার জন্য যে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন তার সবকিছুই করা হবে বলে শিক্ষামন্ত্রী প্রত্যক্ষ নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আন্দোলনকারী যে কোন শিক্ষার্থী কোন প্রকার একাডেমিক অবিচার, শারীরিক লাঞ্ছনা এবং প্রশাসনিক হয়রানির শিকার হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপূর্বক সেটির সমাধান করা হবে বলে মন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া শিক্ষামন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় যে গুচ্ছপ্রস্তাব হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বিশ্বাস করে শিক্ষামন্ত্রী সম্পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন। এমন অবস্থায় বাস্তবায়ন হয়ে গেলে ক্লাসে ফিরে যেতে আমরা প্রস্তুত। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মেরিনা জাহান, অভীক রায়, ফাহিম তানভির, সুদীপ্ত সাহা প্রমুখ। তাঁরা বলেন, শিক্ষার্থীদের বিজয় হয়েছে, নৈতিকতার জয় হয়েছে। এই বিজয়ের জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলাম।
দাবি বাস্তবায়ন হতে যদি সময় লাগে তাহলে কি আপনারা ক্লাসে ফিরে যেতে সময় নেবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তাঁরা বলেন, এই মুহূর্তে দাবি বাস্তবায়ন হলে আমরা এখনই ক্লাসে ফিরে যাব। উপাচার্যের অপসারণের প্রসঙ্গে তারা কিছুটা এড়িয়ে বলেন, গুচ্ছ প্রস্তারের মধ্যেই এ বিষয়ে আমরা সুস্পষ্ট করে বলেছি। সংবাদ সম্মেলনের পরে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরফুল ইসলাম বলেন, ছাত্রদের সংশয় কেটে গেছে। কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তবে ভিসির প্রতি সকলের অনাস্থা রয়েছে।
এদিকে প্রথমে বুয়েটের ঘটনার অনিয়মের তদন্তের দাবি থাকলেও এক পর্যায়ে উপাচার্য অপসারণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষক সমিতি। গত ৫ মাস ধরেই কর্মবিরতিতে রয়েছেন শিক্ষকরা। অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষার্থীদের ক্লাস কার্যক্রম স্বাভাবিক রেখে কোন ধরনের আন্দোলনের পরিকল্পনা কখনও করেনি সমিতি। শিক্ষার্থীদের নিজেদের সন্তান বলে দাবি করলেও শিক্ষকরা সন্তানের পড়াশোনার চাইতে নিজেদের দাবি আদায়ে বেশি এককাট্টা। প্রশাসনিক অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ক্ষতি করছেন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার। ক্লাস না নিলেও গত ৪ মাসে একবারও নিজেদের বেতন তুলতে ভুলছেন না সততার বুলি আওড়ানো শিক্ষকগণ। যথারীতি করেছেন কনসালটেন্সি। খ্যাপের কাজ যথারীতিই করেছেন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোথাও। উপ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার পদ নিয়ে যে অনিয়মের অভিযোগ থেকে আন্দোলন দানাবাঁধে সেটি শিক্ষার্থীদের কোন অভিযোগ নয়। মূলত নিজেদের দাবি আদায়ে ও আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছেন শিক্ষকরা। আন্দোলনে শিক্ষক সমিতির কর্মসূচী ও নেতৃবৃন্দের ঘোষণার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক্লাসে ফেরা নয়, বরং আন্দোলনকে বিভিন্ন গতিতে টেনে লম্বা করাতেই বেশি আগ্রহ শিক্ষকদের, যেখানে নেই শিক্ষার্থীদের ক্লাসের মূল্য। বুয়েটে শিক্ষক সমিতির প্রভাবের কারণ হিসেবে জানা যায়, ১৯৬২ সালের আইনেই সমিতিকে প্রভাবশালী করা হয়েছে। এর পর পাকিস্তানী আমলের এ আইনের এখন পর্যন্ত কোন পরিবর্তন আসেনি। এছাড়াও শিক্ষক সমিতির নেতারাই বিভিন্ন বিভাগের প্রধান। তাই সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন কনসালটেন্সিতে তাদের প্রভাব থাকে। জুনিয়র শিক্ষকদের কনসালটেন্সির কাজ পেতে সিনিয়রদের সান্নিধ্যে থাকতে হয়। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কমিটিতেও প্রধান থাকেন সমিতির নেতারা। শিক্ষক সমিতির বিভিন্ন সময় ঘোষণা পাল্টানো, আন্দোলনে অপ্রয়োজনীয় কর্মসূচী, শিক্ষার্থীদের উস্কে দেয়া প্রমাণ করে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্লাসে ফেরার চাইতে আন্দোলনেই বেশি আগ্রহী।

No comments

Powered by Blogger.