ভেজাল সর্বত্র-প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে

ভেজালের হাত থেকে যেন নিষ্কৃতি নেই দেশের মানুষের। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় যাদের বসবাস, ভেজাল থেকে মুক্তি নেই তাদের। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য মাত্রা ছাড়িয়েছে। ভেজাল হয় না এমন কোনো দ্রব্য খুঁজে পাওয়া বোধ হয় এখন আর সম্ভব নয়।
খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে নিত্যপণ্য, এমনকি মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পর্যন্ত ভেজাল হচ্ছে। এই ভেজাল খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। ভেজালের এই কারবার দীর্ঘস্থায়ী হলে বা বেশি দিন চলতে থাকলে দেশের শতভাগ মানুষের স্বাস্থ্য যে নানা রোগের ঝুঁকিতে পড়বে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কালের কণ্ঠসহ সহযোগী দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত খবরই বলে দিচ্ছে, ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। শাকসবজি থেকে শুরু করে ফলমূল- প্রতিদিনের সব খাবারেই রয়েছে ভেজাল ও বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি। মাছে মিলছে বিষাক্ত ফরমালিন, ফলে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথেফেন, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম পাউডার, বিস্কুটসহ বেকারি পণ্যে রয়েছে বিষতুল্য রং আর মুড়িতে মেশানো হচ্ছে কৃষিকাজে ব্যবহৃত ইউরিয়া সার। পরীক্ষায় দেখা গেছে, আঙুর, আপেল ও নাশপাতিসহ আমদানি করা ফলেও ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। এতে এসব ফল দীর্ঘদিন দোকানে রাখার পরও নষ্ট হয় না, ঝরে পড়ে না। এসব ফল ফুসফুস, কিডনি ও লিভারের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ছে। পকেটের টাকা খরচ করে যা কেনা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই প্রকৃতপক্ষে বিষ। এই বিষাক্ত খাবার দেশবাসীকে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ঠেলে দিচ্ছে।
শুক্রবার কালের কণ্ঠে প্রকাশিত এক সচিত্র প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে কেমন করে মাত্র ৩০ মিনিটে আখের রস ছাড়াই তৈরি হয়ে যায় চমৎকার ও সুস্বাদু আখের গুড়। পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত চিটাগুড় ও আগের বছরের নালি গুড়ের মধ্যে চিনি, গমের আটা, হাইড্রোজ, ফিটকিরি ও ডালডা মিশিয়ে রাজশাহীতে তৈরি হচ্ছে নতুন ভেজাল গুড়। দেখতে সুন্দর এই গুড় বর্তমানে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি দরে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গুড়ের নামে বিক্রি হওয়া এসব বিষাক্ত খাদ্যদ্রব্য লিভার, কিডনি, পরিপাকতন্ত্র, খাদ্যনালিসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিছুদিন আগে সহযোগী একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছিল ভেজাল দুধের কথা। কিভাবে ছানার পানির সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদি মিশিয়ে ক্ষতিকর একটি দ্রব্য দুধ হিসেবে বাজারজাত করা হয়, তা তুলে ধরা হয়েছিল ওই প্রতিবেদনে। রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে বিভিন্ন এলাকায়ও এসব দুধের কারখানা আছে। রাজধানীতে এ জাতীয় দুধ 'প্লাস্টিকের দুধ' নামে পরিচিত।
অনুমোদন ছাড়া ও অনুমোদন নিয়ে শর্ত ভঙ্গ করে মানহীন পণ্য বিক্রি চলছে দেদার। সনদ প্রদানেও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। জনস্বাস্থ্য ও পণ্যমান ধরে রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বিএসটিআই নামের প্রতিষ্ঠানটি যেন থেকেও নেই। বিএসটিআইর তালিকার বাইরে আছে অনেক খাদ্যপণ্য। সব ধরনের ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের পরীক্ষার উপকরণ নেই বিএসটিআইতে। আছে লোকবল সংকট। বাজারে নিম্নমান, ভেজাল ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্যদ্রব্যসহ নানা পণ্য ছড়িয়ে পড়লেও সংশ্লিষ্ট মহল থেকে দীর্ঘস্থায়ী কোনো কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। মাঝেমধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা কাজে আসছে না। ভেজালকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে দেখা যায় না। কিছু জরিমানা আদায় ও ভেজাল দ্রব্য নষ্ট করা হয়। কিন্তু ভেজালের মূল হোতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ভেজাল খাদ্য এক নীরব ঘাতক। ভেজালকারীরাও এই ঘাতকের পর্যায়ে পড়ে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে ভেজালকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হলে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করা সম্ভব হতে পারে। একই সঙ্গে ভেজাল প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে কার্যকর করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.