জামদানি শিল্প রক্ষা পাক by আবু সালেহ মোঃ সায়েম

রেশম, সুতা, জরি এবং শিল্পীর হাতের নিপুণ ছোঁয়ার মিশ্রণে তৈরি হয় এক ধরনের কাপড়। নাম জামদানি শাড়ি। প্রাচীনকালের মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানি শাড়ি বাঙালি নারীদের অতি পরিচিত। জামদানি বলতে শাড়িকেই বোঝানো হয়।


এ ছাড়াও জামদানি দিয়ে ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দা, শার্ট, পাঞ্জাবি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। ১৭০০ শতাব্দীতে জামদানি দিয়ে তৈরি নকশাওয়ালা শেরওয়ানির প্রচলন ছিল। সম্রাট জাহাঙ্গীর, সম্রাট আওরঙ্গজেব প্রমুখ তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য জামদানি শাড়ি তৈরি করাতেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের জন্য তৈরি করা জামদানির দাম ছিল ২৫০ টাকা। ১৭৭৬ সালে ঢাকায় সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের জামদানির মূল্য ছিল ৪৫০ টাকা, যা পৃথিবীর যে কোনো কাপড়ের চেয়ে ব্যয়বহুল।
সময়ের পরিবর্তনে বাঙালি ইতিহাসকে সাক্ষী রাখা সেই জামদানি শাড়ি দৈনিক ১৬ ঘণ্টায় দু'জন শিল্পের নিপুণতায় ৬ দিনে তৈরি হয় এবং শাড়িটি বৃহস্পতিবার বসা হাটে দুই থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। স্ত্রী-পরিজন নিয়ে এ টাকায় চলতে হয় পুরো একটি সপ্তাহ, কিনতে হয় কাপড় তৈরির রেশম, সুতা, জরি, দিতে হয় সারকিতের সাপ্তাহিক বেতন। অথচ এ শাড়িটি দশ থেকে বারো হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশসহ ভারতের বিভিন্ন শপিং মলগুলোতে। প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা অর্জন করা এ শিল্পের প্রকৃত শিল্পীরা যথাযোগ্য পারিশ্রমিকের অভাবে এ পেশা থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হচ্ছে।
বছরের বর্ষা মৌসুমে কাপড়ের দাম একেবারেই কমে যাওয়ায় শিল্পীদের দীনতা আরও বেড়ে যায়। গরিব, দুস্থ শিল্পীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয় রক্তচোষা ছারপোকার মতো কিছু জামদানি পাইকার (সাউদ)। তারা শিল্পীদের কিছু টাকা ধার দেয় একটি মাত্র শর্তে। শর্তটি হলো_ আগামী বর্ষার আগ পর্যন্ত কাপড়গুলো সাউদের কাছে নির্দিষ্ট মূল্যে (যা ন্যায্যমূল্যের অনেক কম) বিক্রি করতে হবে। সংসার, স্ত্রী-সন্তানের কথা চিন্তা করে শিল্পীরা রাজি হয়ে যান। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, পরের বর্ষা এলেও ধারের টাকা পরিশোধ করতে পারে না। রেশমের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। এছাড়া সুতা, ভারত থেকে আমদানি করা জরি, সারকিতের দিনমজুরি, দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়ায়, কাপড়ের দাম না বাড়াতে জামদানি শিল্পীরা পড়েছেন বিপাকে। পরের বর্ষাতে ধারের বোঝা আরও বেড়ে যায়। এভাবেই চলছে যুগের পর যুগ। অনেক শিল্পী আজ ভিটামাটিহারা সর্বস্বান্ত। প্রায় বিশ হাজার শিল্পীর মধ্যে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে পাঁচ বছরান্তে শিল্পীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আড়াই হাজারের মতো। এ অবস্থা চলতে থাকলে জামদানি শিল্প নিশ্চিহ্ন হতে কয়েক বছর লাগবে।
বিভিন্ন সময়ে গ্রহণ করা সরকারি উদ্যোগগুলো প্রশংসনীয় হলেও তার বাস্তবায়ন চোখে পড়ার মতো নয়। জামদানি শিল্পীদের জন্য গড়ে ওঠা নোয়াপাড়াস্থ বিসিক জামদানি শিল্পনগরীর শিল্পীরা পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের অভাবে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছেন। অর্থাভাবে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারছেন না। দু'বেলা ভাত যাদের পেটে পড়ে না, তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজন আছে কিনা তা সুধী সমাজই ভালো বলতে পারবে। স্বাধীনতার পর অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, জ্ঞানী-গুণীজন এই শিল্পের কাছাকাছি এসেছেন, অনেক কিছু করার আশ্বাস দিয়েছেন; কিন্তু শিল্পের অবস্থা দিন দিন করুণ থেকে করুণতর হচ্ছে। মৌলিক চাহিদা পূরণসাপেক্ষে জামদানি শিল্পীর পরিবারসহ শিল্পকে পুনরুদ্ধার করে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলার মানচিত্র তুলে ধরা যাবে।
য় প্রভাষক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ পাবলিক কলেজ

No comments

Powered by Blogger.