সাক্ষরতা দিবস-দুটি প্রকল্পের পোস্টমর্টেম এবং শতভাগ সাক্ষরতা by মাহফুজুর রহমান মানিক

আশ্চর্যের বিষয় যে, তিন বছরেও সরকার এত গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রকল্প টাকার কথা বলে অনুমোদন করেনি। অথচ বিগত প্রত্যেক বছরই আগামী বছর থেকে চালু হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আর এখন এরকম ঢিলেমি করতে গিয়ে
প্রকল্পগুলোরই মৃত্যু হলো


সাক্ষরতা নিয়ে সম্প্রতি দুটি প্রকল্পের মৃত্যু হয়েছে, এতদিন ধরে যে প্রকল্পগুলোকে সরকার 'শতভাগ সাক্ষর বাংলাদেশের স্বপ্নে'র মাধ্যম হিসেবে দেখিয়েছে। প্রকল্প দুটির পোস্টমর্টেম করা আবশ্যক। গত বছরও সাক্ষরতা দিবসের প্রাক্কালে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলেই প্রথমে নজরে আসত '২০১৪ সালের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিত করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ' লেখাটি। এ বছর প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতেই দেখাচ্ছে, ঞযরং ধপপড়ঁহঃ যধং নববহ ংঁংঢ়বহফবফ অর্থাৎ এই অ্যাকাউন্টটি স্থগিত করা হয়েছে। ডিজিটাল সরকারের ওয়েবসাইটের এই দশা কেন? এই প্রশ্নটির চেয়েও কৌতূহলের বিষয় ছিল, এখন আসলে সেখানে কী লেখা থাকত; মানে শতভাগ সাক্ষরতা ঠিক কত সালের মধ্যে।
এই কৌতূহলেরও সঙ্গত কারণ আছে। সেটা বলার আগে প্রকল্পগুলোর অবস্থা দেখা যাক। আজ ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। ঠিক তিন বছর আগে ২০০৯ সালে দিনটি উপলক্ষে দৈনিক পত্রিকায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো প্রকাশিত ক্রোড়পত্রে বলা হয়, ২০১৪ সালের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিত করতে ব্যুরো দুটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। যেগুলো কেবল সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্প দুটি হলো_ মৌলিক সাক্ষরতা ও অব্যাহত শিক্ষা প্রকল্প-১ ও মৌলিক সাক্ষরতা ও অব্যাহত শিক্ষা প্রকল্প-২। আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়, প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দেশের সকল নিরক্ষরকে সাক্ষর করা হবে। এক বছরের মধ্যে এ বিষয়ে আর বিস্তারিত জানা যায়নি। ঠিক এক বছর পর ২০১০ সালে সাক্ষরতা দিবসে 'নিরক্ষরতা দূর করতে তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প' শিরোনামে প্রথম আলো বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে প্রকল্প দুটির বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়। প্রথমটি ৬১ জেলার নিরক্ষরদের সাক্ষর করার জন্য, ব্যয় ২ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা আর অন্যটি এর বাইরের ৩টি পার্বত্য জেলার জন্য, ব্যয় ৫০ কোটি টাকার কিছু বেশি। যেখানে বলা হয় প্রকল্পগুলো শুরু হবে ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে এবং তিন ধাপে কাজ করে ২০১৩-এর মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। তার আগের কথা হলো বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করার ঘোষণা দেয়। এ প্রকল্প হলো সে ঘোষণার ফল আর এ জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো তার ওয়েসবাইটে ২০১৪ সালের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিতকরণের কথা বলে।
যা হোক, ২০১০-এ প্রথম আলোর প্রতিবেদনের মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পগুলো ডিসেম্বরের মধ্যেই পাস হবে এবং ২০১১-এর জানুয়ারি থেকেই কাজ শুরু হচ্ছে। কিন্তু তা হয়নি। সমকাল ২০১১-এর ৮ ফেব্রুয়ারি 'চ্যালেঞ্জের মুখে নিরক্ষরতা দূরীকরণ কার্যক্রম' শিরোনামে ফলোআপ রিপোর্ট করে দেখিয়েছিল অর্থের অভাবে প্রকল্প দুটি অনুমোদন দেয়নি সরকার। আবার সমকালই 'সাক্ষরতা অর্জনে মহাপরিকল্পনা' শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০১১ সালের ২১ এপ্রিল। অনেকটা ২০১০-এর সাক্ষরতা দিবসে প্রথম আলোর মতোই ছিল প্রতিবেদনটি, যেখানে দুটি প্রকল্পের বর্ণনার বাইরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাক্ষরতার কাজে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়। তবে প্রকল্প দুটি বলা হলো চালু হবে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। এপ্রিলের পর সেপ্টেম্বরে সাক্ষরতা দিবসে এসে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর ক্রোড়পত্র ঠিক সেটাই আবার বলল এবং প্রকল্প ২০১২ জানুয়ারিতে চালু হয়ে ২০১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। মানে প্রকল্প দুটি ২০১৩ সালে শেষ করার মাধমে ২০১৪ সালের মধ্যেই শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিত হবে! অনেকটা এ রকম বিষয় আর কি।
মজার বিষয় হলো, এরপর ২০১২-এর জানুয়ারি গেল, জুনে বাজেট গেল কিন্তু প্রকল্প দুটির বিষয়ে আর তেমন কিছু জানা যায়নি। অবশেষে এই লেখক নিজে সপ্তাহখানেক আগে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোতে গিয়ে জানলেন, প্রকল্প দুটি চালু হয়নি। আরও বিস্তারিত জানা গেল ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিক থেকে। যেটি বলছে প্রকল্প দুটি একনেকে গত তিন বছর ধরে অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। টাকার অঙ্ক বেশি হওয়ায় সেটি অনুমোদন পায়নি। এখন টাকার অঙ্ক তিন হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৪৯৯ কোটি টাকার প্রকল্পের নতুন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিন বছর ধরেও যে প্রকল্পের কোনো সদগতি হয়নি, এখন সেটাকে টাকার অঙ্কে কয়েকগুণ কমিয়ে খুব দ্রুত বাস্তবায়নের আশা করছেন কর্তাব্যক্তিরা। আসলেই কবে নাগাদ হচ্ছে তার চেয়ে জরুরি প্রশ্ন_ শতভাগ সাক্ষরতার কী হবে?
উত্তরটা মাননীয় মন্ত্রীই দিয়েছেন। আজকের সাক্ষরতা দিবসকে সামনে রেখে ৬ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেন, '২০১৪ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের ঘোষণা থাকলেও সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা একটি ট্র্যাকে পেঁৗছাতে চাই।' মন্ত্রীর 'সম্ভব হচ্ছে না' বলার গোড়ার বিষয় কিন্তু ওই দুটি প্রকল্প। এখন সাক্ষরতার হার তিনি পরিসংখ্যান ব্যুরোর তরফে বলেন ৫৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। যদি এমন হতো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে, তখন হয়তো ভিন্ন কথা শোনা যেত, দৃঢ়তার সঙ্গে বলতেন ২০১৪ সালের মধ্যে আমরা পারবই।
খুবই আশ্চর্যের বিষয়, তিন বছরেও সরকার গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রকল্প টাকার কথা বলে অনুমোদন করেনি। অথচ বিগত প্রত্যেক বছরই আগামী বছর থেকে চালু হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আর এখন এরকম ঢিলেমি করতে গিয়ে প্রকল্পগুলোরই মৃত্যু হলো। তার স্থলে ৪৯৯ কোটি টাকার প্রকল্প কতটা কার্যকর হবে, কিংবা আদৌ অনুমোদনই হবে কিনা সে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
সব মিলিয়ে একটা বিষয় পরিষ্কার, সরকার যা-ই করুক অন্তত সাক্ষরতার গুরুত্ব বোঝেনি। বোঝেনি দেশ থেকে নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর করার তাৎপর্য। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলি আর মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলে ২০১৫ সালের মধ্যে 'সবার জন্য শিক্ষা'য় সরকারের প্রতিশ্রুতির কথাই বলি। কেবল সাক্ষরতা দিবস এলে যত তোড়জোড় দেখা যায়। এখন যেহেতু ২০১৪ সালের মধ্যে শতভাগ সাক্ষর করা সম্ভব হচ্ছে না, সুতরাং উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর ওয়েবসাইটে তার স্থলে ঠিক কী লেখা থাকত সে কৌতূহল থেকেই যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট পুনরায় কবে চালু হচ্ছে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

মাহফুজুর রহমান মানিক :শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
mahfuz.manik@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.