ঢাকা রিজেন্সির মালিকানা-দ্বন্দ্ব-প্রতারণার অভিযোগ প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের by আবুল কাশেম

আড়াই লাখ বর্গফুট আয়তনের পাঁচতারা হোটেল 'ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট'-এর মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। লন্ডনপ্রবাসী একটি গোষ্ঠী ১৫ তলা এই হোটেল স্থাপনে বিনিয়োগ করলেও গত ছয় বছরে তারা কোনো লভ্যাংশ পায়নি বলে অভিযোগ করেছে।


এমনকি প্রবাসী এই বিনিয়োগকারীদের হোটেলটির 'পরিচালক' পদ দেওয়ার কথা থাকলেও তা নিয়েও প্রতারণা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পরিচালক হিসেবে এসব প্রবাসী বিনিয়োগকারীকে কার্ড দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে কাগজপত্রে তাঁদের পরিচালক করা হয়নি। বিনিয়োগ হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কার পাশাপাশি এখন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা। তবে রিজেন্সি হোটেলের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কবির রেজা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
রাজধানীর নিকুঞ্জ এলাকায় অবস্থিত এই হোটেল কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি পুঁজিবাজারে আইপিও (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) ছেড়ে মূলধন সংগ্রহের চেষ্টা করলে প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের আবেদনের কারণে তা স্থগিত করেছে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। জানা গেছে, লন্ডনের বিনিয়োগকারীদের পক্ষে ব্রিটিশ এমপি রোশনারা আলী এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। তবে এসব তৎপরতার কারণে প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করেছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের পক্ষে ড. কামাল হোসেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস থেকে হোটেল কর্তৃপক্ষকে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের একজন শাহ মো. আশরাফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, তিনি ছাড়াও লন্ডনপ্রবাসী শামুসদ্দোহা, আমিনা বেগম, সাদত হোসাইন মনির, তামজিদা খাতুন, মমিন আলী, মনজুর হোসাইন, মইনুল ইসলাম ও ফয়সাল হোসাইনসহ অনেকেই এই হোটেলে বিনিয়োগ করেছেন। ২৫ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ডের বিনিময়ে কম্পানির পরিচালক পদ বিক্রির কথা বলে মোসলেহ আহমেদ, কবির রেজা, মজিবুল ইসলাম ও আরিফ মোতাহার নামের চার ব্যক্তি তাঁদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন।
ঢাকা রিজেন্সি হোটেল নির্মাণে লন্ডনপ্রবাসী বিনিয়োগকারীরা সম্প্রতি একটি ফোরাম গঠন করেছেন। ওই ফোরামের সচিব শাহ মো. আশরাফুল ইসলাম সম্প্রতি ঢাকায় এসেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার প্রবাসীদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করছে। কিন্তু প্রবাসী হিসেবে বিনিয়োগ করে লভ্যাংশ তো পাচ্ছিই না, উল্টো প্রতারণার প্রতিবাদ করায় নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছি। আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা পর্যন্ত করেছে। বিনিয়োগ করে মুনাফা ও সম্মান পাওয়ার পরিবর্তে লন্ডন থেকে এসে আমাকে বাংলাদেশের আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে প্রবাসীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে আবেদন জানিয়েছি। একই সঙ্গে ড. কামাল হোসেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস থেকে ওই চারজনের বিরুদ্ধে উকিল নোটিশও পাঠানো হয়েছে।'
শাহ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, '২০০৭ সালে হোটেলটি উদ্বোধন করার পর থেকেই সফলভাবে ব্যবসা করছে। প্রতিবছরই হোটেলটি মুনাফা করছে। তা সত্ত্বেও আমাদের কোনো লভ্যাংশ দেওয়া হয়নি। এমনকি যে পরিচালক পদ বিক্রি করে আমাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছে, তা নিয়েও প্রতারণা করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ প্রথমে ২০০৮ সালে আমাদের পরিচালক হিসেবে কার্ড দিয়েছে। পরে দেখি ওই চারজনের স্ত্রী-সন্তানসহ আত্মীয়রাই পরিচালক, আমরা নই। যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের কাগজপত্রেও আমাদের পরিচালক হিসেবে দেখানো হয়নি।'
সংশ্লিষ্টরা জানান, রোশনারা আলী গত ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর কাছে পাঠানো চিঠিতে লেখেন, 'ইংল্যান্ডের কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হচ্ছেন। মোসলেহ আহমেদ, কবির রেজা, মজিবুল ইসলাম ও আরিফ মোতাহার এসব বিনিয়োগকারীর সঙ্গে প্রতারণা করছেন। লন্ডনপ্রবাসী আমিনা বেগম, মোহাম্মদ শামসুদ্দোহাসহ আরো তিনজনের প্রত্যেকে হোটেলটির মালিকানা অংশীদারির পাশাপাশি পরিচালক পদের জন্য এই প্রকল্পে ২৫ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৯ লাখ) করে বিনিয়োগ করেন। ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে হোটেলটি উদ্বোধনের পর থেকে তাঁদের লভ্যাংশ পাওয়ার কথা। তখন থেকে হোটেলটি সফলভাবে পরিচালিত হলেও ব্যবসাবহির্ভূতভাবে মোসলেহ আহমেদ, কবির রেজা, মজিবুল ইসলাম ও আরিফ মোতাহার আর্থিক সুবিধা ভোগ করছেন। অন্যদিকে লন্ডনপ্রবাসী বিনিয়োগকারী আমিনা বেগম ও তাঁর স্বামী শামসুদ্দোহা এখন পর্যন্ত কোনো লভ্যাংশই পাননি। তাঁরা ওই চারজন দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন বলে আমাকে জানানো হয়েছে।' এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারকে অনুরোধ জানান রোশনারা আলী।
প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের পক্ষে মোসলেহ আহমেদ, কবির রেজা, মজিবুল ইসলাম ও আরিফ মোতাহারের কাছে গত ২০ মে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে ড. কামাল হোসেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। তাতে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালের ১০ নভেম্বর লন্ডনপ্রবাসী বিনিয়োগকারীদের পরিচালক হিসেবে সম্বোধন করে হোটেল কর্তৃপক্ষ চিঠি পাঠিয়েছে। পরিচালক হিসেবে তাঁদের কার্ডও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরে পাঠানো কাগজপত্রে তাঁদের পরিচালক হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। উকিল নোটিশে এটাকে প্রতারণা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে রিজেন্সি হোটেল কর্তৃপক্ষ পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত হয়ে আইপিও ছাড়ার উদ্যোগ নেয়। লন্ডনপ্রবাসী বিনিয়োগকারীরা গত ২২ মার্চ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে একটি চিঠি পাঠান। ফলে হোটেল কর্তৃপক্ষের আইপিও ছাড়ার উদ্যোগটি ভেস্তে গেছে।
রোশনারা আলীর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের কাছে চিঠি পাঠানো এবং এসইসি ও ডিএসইর কাছে চিঠি পাঠানোর কারণে হোটেলের পাশাপাশি মোসলেহ আহমেদ, কবির রেজা, মজিবুল ইসলাম ও আরিফ মোতাহারের সম্মানহানি হয়েছে উল্লেখ করে গত জুনে প্রবাসী বিনিয়োগকারী শাহ মো. আশরাফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একটি মানহানি মামলা করেছেন হোটেলটির সহকারী ব্যবস্থাপক মো. কয়েস মুন্সী।
প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রিজেন্সি হোটেল পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কবির রেজা। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, তাঁরা (প্রবাসীরা) অল্প কিছু শেয়ারের মালিক। তাঁদের বিনিয়োগ এক কোটি টাকার মতো। আর হোটেল প্রতিষ্ঠায় মোট বিনিয়োগ সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। সেখানে তাঁরা পরিচালক পদ পেতে পারেন না। তবে আমরা প্রতিবছর লভ্যাংশ ঘোষণা করছি। গতবারও ২০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছি। শেয়ারের মালিক হিসেবে তাঁরাও লভ্যাংশ পেয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।
পরিচালক পদ দেওয়ার নাম করে প্রবাসীদের কাছ থেকে বিনিয়োগের জন্য অর্থ আনা হয়েছে- এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমরা এ ধরনের কোনো কথা তাঁদের বলিনি। আর তাঁদের পরিচালক হিসেবে কোনো চিঠি বা কার্ডও দিইনি।' এসইসি, ডিএসই বা সরকারের বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরনের চিঠি পাঠানোর কারণে প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নিজেদের সম্মানহানি হচ্ছে উল্লেখ করে কবির রেজা বলেন, এ কারণেই মানহানির মামলা করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.