খানাখন্দের রাজনীতি : প্রয়োজন বিপদবিনাশী একতা by এস এম আব্রাহাম লিংকন

দানীং ব্যাপকভাবে বলার চেষ্টা হচ্ছে রাস্তা যেমন বেহাল, সংসদের অবস্থাও অনুরূপ। রাস্তা যেমন চলছে না, তেমনি সংসদও চলছে না। তাঁরা ইনডিকেটর ধরছেন, সরকারি দলের সদস্যরা নিজ মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে যেভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন, তা প্রমাণ করে সরকারের অবস্থান সড়ক-মহাসড়কের মতো পর্যুদস্ত। তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর এ বিষয়টি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় চাউর হয়ে উঠেছে।


বেশ কয়েক দিন থেকে সরকার এবং মন্ত্রিসভার ওপর এ বিষয়ে চাপ লক্ষ করা যাচ্ছে। নৌপরিবহনমন্ত্রীর শ্রমিক সন্তুষ্টির নামে নিচুমানের বক্তব্য এবং যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্বহীনতা নিয়ে বেশ জমেছে রাজনীতি এবং পত্রিকাগুলোর নিবন্ধ। চলমান ঘটনার ধারাবাহিকতায় আমাদের জাতীয় সংসদ জমে উঠেছে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম সরকারি দলের সদস্যরা বিরোধী দলের সদস্যদের মতো করে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। সংসদীয় কমিটি নৌমন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। এ সংবাদগুলো পাঠ করে মনে হচ্ছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের এ মুহূর্তে রং কিছুটা হলেও ফিকে হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এই ফিকে ভাব চলমান থাকা উচিত। ট্রেজারি বেঞ্চের বাঘা-বাঘা সদস্যরা যখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মন্ত্রীদের তুলাধুনা করেছেন, তখন সত্যিই মনে হয়েছে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা অনেকটা স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি সংসদে তুলে ধরতে পেরেছেন। এ পর্যন্ত আমরা লক্ষ করেছি, সাধারণত দলীয় সংসদ সদস্যরা সংসদ বা ওপেন ফোরামে মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বলেন না। এবার প্রধানমন্ত্রীর সামনে যে ধারা চালু হয়েছে, আমি মনে করি এতে সংসদ নেত্রীর সায় আছে। নতুবা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রথমেই তিনি বন্ধ করাতে পারতেন। তিনি আলোচনা রোধে হস্তক্ষেপ করেননি। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ধারার সূচনা হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকুক_এটি আমাদের প্রত্যাশা। বিরোধী দল সংসদে ফিরে এলে আমরা যেন নিজেদের ভুলত্রুটিগুলোর গঠনমূলক সমালোচনা থেকে বিরত না রাখি। সরকারদলীয়দের সংসদের আলোচনায় শুধু দলীয় আনুগত্য প্রকাশ নয়, জনগণের প্রতিও যেন আনুগত্যের প্রকাশ থাকে।
আমরা বিপর্যস্ত রাস্তার জন্য এমনভাবে সমালোচনা করছি, যেন সব রাস্তা এই আড়াই বছরে নষ্ট হয়েছে। অভিজ্ঞজনরা জানেন, দুর্নীতি না হলে একটি রাস্তা সংস্কারের বা নির্মাণের পর দুই বা আড়াই বছরে নষ্ট হওয়ার নয়। নিম্নমানের নির্মাণকাজ ছাড়াও রাস্তা নষ্ট হওয়ার জন্য অনেক কারণ আছে। সংসদ নেত্রী যথার্থই বলেছেন, রাস্তায় একটি ট্রাক যে পরিমাণ লোড নেয়, তা ধারণ করার মতো শক্তি আমাদের সড়ক-মহাসড়কের নেই। যে ট্রাক পাঁচ টন মাল পরিবহনের জন্য_সে ট্রাক বহন করছে ১৫ টন। ফলে সড়ক নষ্ট হওয়ার জন্য অতিরিক্ত মাল বহনই উত্তম কারণ। রেলকে অচল করে সড়ক পরিবহনকে অতীতে উৎসাহী করা হয়েছে। আমরা দেখি, সড়ক পরিবহনকে নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র কয়েকটি পরিবহন কম্পানি। যাদের রাজনৈতিক অবস্থান আমাদের সবার জানা। যদি সিলেট-ঢাকা, চট্টগ্রাম-ঢাকা সরাসরি ট্রেন লাভজনক হয়, তবে কোন অজুহাতে রাষ্ট্রীয় এই খাতটিকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে? রেল অচল থাকায় রাস্তার ওপর বাড়তি চাপ। যদি সত্যিই প্রধানমন্ত্রী কমিউটার ট্রেন চালু করেন, তবে তা হবে একটি কার্যকর পদক্ষেপ। আমরা এ উদ্যোগটি শুধু দেশের ১০টি রুটে সীমাবদ্ধ দেখতে চাই না। আমাদের দেশে ঈদের আগে রাস্তার জ্যাম, টিকিটের অভাব নিয়ে ঘরে ফেরা মানুষের ভোগান্তি নতুন নয়। যদি আট বছর আগের চারদলীয় জোট বা তিন বছর আগে মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন সাহেবদের সরকারের সময়ের পত্রিকাগুলো দেখেন, একই চিত্র পাবেন। কিন্তু এবারে যুক্ত হয়েছে বর্ষা-বাদল, ঈদ এবং ড. মনমোহনের সফর। কারণ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরে ট্রানজিট একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্যসূচি। অবশ্যই ট্রানজিটের আগে আমাদের রাস্তাঘাটের অবকাঠামোগত বিষয় উত্থাপিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেখানে নিজের চলার রাস্তা নেই, সেখানে অতিথির ভারী গাড়ি আমার চলার পথকে আরো বন্ধুর করবে। যদি চুক্তিও হয় আমরা প্রত্যাশা করব, দেশের রাস্তাঘাট আন্তর্জাতিক মানে উত্তীর্ণ করার পর তা যেন কার্যকর হয়। এতে যদি চুক্তির বাস্তবায়ন পাঁচ বছর পিছিয়ে যায় তাতে জনগণ সম্মত থাকবে।
মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ স্বাধীনতার ৪০ বছর হলেও এর গণতন্ত্র কিন্তু বেশি দিনের নয়। গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক চর্চা বেশি দিন না হওয়ায় এখনো আমরা শিশু অবস্থায় আছি। এই শিশু গণতন্ত্রকে হটিয়ে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের কথা কিছু কিছু পত্রিকার সুবাদে নতুন করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বর্তমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি নেই, যদি ধরি চারদলীয় জোটের যাঁরা বিপদগ্রস্ত আছেন, যেমন_খালেদা জিয়ার নিজের বিরুদ্ধে মামলা, ছোট ছেলের জেল, বড় ছেলের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ খুন-খারাবির মামলা, নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদীর নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা, পাশাপাশি নিজেদের দলের কোন্দল প্রভৃতি কারণে নিজেরা বাঁচার জন্য সরকারকে বিতাড়নের জোর চেষ্টা করছেন। তাঁদের চেষ্টার কারণে যদি সত্যই সরকারের বদল হয়, তাহলে কোন পদ্ধতির মাধ্যমে ক্ষমতার বদল হবে? কার অধীনে নির্বাচন হবে? আর যাই হোক, সংবিধান সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই ভোট করতে হবে। আর সেটি না চাইলে সামরিক শক্তিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার পথকে উন্মুক্ত করতে হবে? খালেদা জিয়া, নিজামীরা নিজেদের সমূহ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য কৌশল বদল করছেন_যদি সামরিক শক্তির হাতে ক্ষমতা যায় যাক, আওয়ামী লীগ বা প্রগতিশীলরা যেন ক্ষমতায় না থাকে। এই মূলনীতিকে ধারণ করেই বিএনপি-জামায়াত সুকৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা যেখানে ভারত বিরোধিতা করলে নিজেদের লাভ হবে সেখানে তা-ই করছেন। যেখানে তৈল মর্দন করা দরকার সেখানে তা-ই করছেন। যাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে আবার কাছে টেনে নেওয়া হচ্ছে (এখানে আপসহীন নেত্রী আর আপসহীন থাকতে পারছেন না)! লক্ষ্য একটাই নিজের পরিবার রক্ষা। এখানে গণতন্ত্র হত্যা হলো কি না সেটি বিবেচ্য নয়, বিচার থেকে পরিত্রাণই মূল।
সামনে আমাদের দেশের রাজনীতিকে বেশ গরম করে তোলা হবে। সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে এ সরকারের কিছু দুর্বলতাকে। এই সরকারের সাফল্য হাজারো, প্রচার নেই। এত মন্ত্রীর মধ্যে মাত্র দু-একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারও যৌক্তিকতা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। তদুপরি যাঁদের সফলতা আছে সে সফলতাকে প্রচারে নেওয়া যাচ্ছে না কেন? এর অন্তরায়কে বিবেচনায় নিতে হবে। সরকারের ব্যর্থতা প্রচার করা অন্যায় নয়; কিন্তু সাফল্যের প্রচারও জরুরি। মনে রাখতে হবে, দল ক্ষমতায় আসার পর কে বেশি লাভবান হয়েছেন, কে হননি, কে এমপি হয়েছেন আর কে মন্ত্রী হননি_এসব ব্যক্তিগত বঞ্চনার হিসাব এ মুহূর্তে শুধু দলকেই নয়, ব্যক্তি আপনাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। মনে রাখতে হবে, যখন সাপ ঘরে ঢোকে তখন কে বঞ্চিত কে সুবিধাভোগী তা বাছ-বিচার করবে না, লক্ষ্য একটাই হবে আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল বধ। এ মুহূর্তে বিপদবিনাশী বোধ নিয়ে না এগোলে আমাদের পরিণতি করুণ হতে বাধ্য।
লেখক : আইনজীবী ও সাবেক ছাত্রনেতা
abrahamlincoln66@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.