অস্বীকারে দায় কমে না বরংবাড়ে-গুপ্তহত্যা চলছে এবং চলবে?

দীতে ভেসে উঠছে অর্ধগলিত লাশ—দৃশ্য হিসেবে, সংবাদ হিসেবে, হত্যার নৃশংসতার বিচারে ঘটনাগুলো ভয়ংকর। কেবল নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের ওপরই নয়, জনমনেও তা গভীর আতঙ্ক ও উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। গত মঙ্গলবার মুন্সিগঞ্জের কাছে ধলেশ্বরী নদীতে আরও তিনটি লাশ পাওয়া গেছে। গত নভেম্বর ও চলতি ডিসেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ রকম লাশ আরও উদ্ধার করা হয়েছে।


হত্যার ধরন, লাশগুলোর অবস্থা এবং এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রহস্যজনক নীরবতা থেকে মনে হওয়ার কারণ রয়েছে, গড়পরতা হত্যাকাণ্ড থেকে এসব হত্যার নকশা কিছুটা আলাদা। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা যখন তাঁদের খোঁজ পেতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ধরনা দিচ্ছেন, গণমাধ্যমে যখন এসবের খবর-প্রতিবাদ ইত্যাদি ছাপা হচ্ছে, ঠিক সে সময়েই মানুষগুলোর খুন হওয়া একটা কিছু প্রমাণ করে।
যারাই এসব করে থাকুক, তারা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ঠান্ডা মাথায় তাদের হত্যা-কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। এর পরে আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীরব থাকার কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘গুপ্তহত্যা’র খবর জেনেছেন পত্রিকা পড়ে। দেশের নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব যাঁর কাঁধে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান এত মামুলি হলে তাঁর পক্ষে কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব! সব গুপ্তহত্যার ব্যাপারে অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হতে হবে, মানুষকে সত্য জানাতে হবে। এ রকম নির্মমতার বিচার না হলে আইনের শাসন জারি আছে বলে মনে করার কারণ থাকতে পারে না।
হত্যা কেউ প্রকাশ্যে করে না, সেই অর্থে সব হত্যাই গুপ্তহত্যা। কিন্তু প্রথমে নিখোঁজ হওয়া, তার বেশ কিছুদিন পরে নদী থেকে একের পর এক হাত-পাবাঁধা গলিত লাশ পাওয়ার মধ্যে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের নকশাটা ফুটে ওঠে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এগুলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যারই নতুন ধরন বলে অভিযোগ তুলেছেন। নিখোঁজ ও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরাও প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। র‌্যাবও বরাবরের মতো অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। র‌্যাবের কাজ হত্যা-সন্ত্রাস-অপহরণ বন্ধ করা। ক্রমাগত র‌্যাবের নামে অপহরণ চলছে, স্বজনদের আশঙ্কাকে সত্যি করে নিখোঁজ ব্যক্তিরা লাশ হয়ে যাচ্ছে, অথচ র‌্যাব নিজের গরজে গুপ্তহত্যা বন্ধ করছে না—এমনটা চলতে থাকলে জনমনে প্রতিষ্ঠিত হবে যে গুপ্তহত্যা ও র‌্যাবের মধ্যে কোনো না কোনো সম্পর্ক রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ র‌্যাবের ক্রসফায়ারের সাফাই গেয়েছিলেন অপরাধ দমনের যুক্তিতে। কিন্তু গুপ্তহত্যার মতো ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড নিয়মিতভাবে ঘটতে পারা কি র‌্যাবের ব্যর্থতাকেই প্রমাণ করে না?
বিএনপির আমলে অপারেশন ক্লিন হার্টের মধ্য দিয়ে শুরু করা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তাদের আমলেই ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারে রূপান্তরিত হয়েছিল। বর্তমান সরকার সেই কলঙ্কিত উত্তরাধিকার কেবল বহনই করছে না, তাদের আমলেই গুপ্তহত্যার পর্বে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। এ ব্যর্থতা আইনের শাসন কায়েম করতে না পারার, এ ব্যর্থতা সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের, এটা মানবাধিকারের বিপর্যয়।

No comments

Powered by Blogger.