বিএনপির আন্দোলনের কোনো গণতান্ত্রিক উপাদান নেই-সমকালীন প্রসঙ্গ by বদরুদ্দীন উমর

ওয়ামী লীগের বেপরোয়া অপশাসন জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি করছে তাকে পুঁজি করে বিএনপি এখন তার বিক্ষোভ আন্দোলন পরিচালনা করছে। ক্ষোভ যতই বাড়ছে বিএনপির আন্দোলন ততই জোরদার হচ্ছে। এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এ দেশে কোনো নতুন ব্যাপার নয়।


ইতিপূর্বেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই ক্ষমতাসীন প্রতিপক্ষের ক্ষোভকে পুঁজি করে আন্দোলন করে এসেছে এবং নির্বাচনে তার প্রতিফলন হয়েছে। এভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ দুই দল এখনও পর্যন্ত ঠিক থেকে পালা করে এক দল অন্য দলকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নিজেরা ক্ষমতাসীন হলেও বুর্জোয়া শাসকশ্রেণীর সমগ্র শাসন ব্যবস্থায় ভাঙন চলতে থাকার কারণে তার প্রতিফলনও তাদের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে।
বিএনপির অবস্থা পর্যালোচনার আগে এদিক দিয়ে যদি আওয়ামী লীগের দিকে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশের সামনের সারির দুই দলের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে এবং সমাজভূমির মধ্যে ব্যাপকতরভাবে প্রোথিত রাজনৈতিক দল হিসেবে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভাঙন ও সংগঠনের ওপর নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণের শৈথিল্য এখন আর আড়াল করার মতো কোনো বিষয় নয়। কেউ আড়াল করার চেষ্টা করলে সেটা খরগোশের চোখ বন্ধ করে থাকার মতোই ব্যাপার হবে। এর অনেক দৃষ্টান্ত থাকলেও এই মুহূর্তে দুটি দৃষ্টান্ত এ প্রসঙ্গে খুব উল্লেখযোগ্য।
প্রথমত, নারায়ণগঞ্জের দৃষ্টান্ত। সেখানকার পৌরসভার মেয়র নির্বাচনে দুই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মধ্যে কেউই আওয়ামী লীগের নেত্রীর নির্দেশ ও চাপের মুখে নিজের প্রাথিতা প্রত্যাহার করতে রাজি হননি। এর অর্থ দলীয় সমর্থন না পেলেও যে তারা ক্ষতিগ্রস্ত ও পরাজিত হবেন এ ধারণা তাদের কারও মধ্যে নেই। এর অন্য অর্থ হলো, দু'জনই দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী। নিম্ন পর্যায়ের সংগঠন ও সাংগঠনিক নেতৃত্বের ওপর শীর্ষ নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণহীনতার এটা এক অভ্রান্ত প্রমাণ। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। নিজেদের দলের দুই প্রার্থীর নির্বাচনী লড়াই সংগঠনের জন্য একটা কেলেঙ্কারিতে যাতে পরিণত না হয়, এ কারণে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব কার্যত এবং প্রকাশ্যেই একজনকে সমর্থন প্রদান করেছেন। কিন্তু এদিক দিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা এমনই দুর্বল যে, তারা এই সমর্থনের ক্ষেত্রে ধরি মাছ না ছুঁই পানির নীতি গ্রহণ করেছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যেও মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। এই সুবিধাবাদী অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক অবস্থার দুর্বলতা এখন তারা নিজেরাই চোখে আঙুল দিয়ে অন্যদের দেখিয়ে দিচ্ছেন। এ সঙ্গে তাদের নিজেদের লোকদের কাছেও এর মাধ্যমে এই বাণী পেঁৗছে যাচ্ছে যে, সংগঠনের ওপর শীর্ষ নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে আসছে। এ ধরনের শৈথিল্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য বিপর্যয়ের পূর্বাভাস, এটা সাধারণ রাজনৈতিক বিচার-বুদ্ধিতেই বোঝা যায়। কিন্তু এখানে যা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার তা হলো, নারায়ণগঞ্জেই এর এক পূর্ব দৃষ্টান্ত আছে। ১৯৭৪ সালে প্রথম নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনে সেখানকার জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা আলী আহমদ চুনকাকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন না দিয়ে অন্য একজনকে মনোনয়ন দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগ নেতা চুনকা বিজয়ী হয়েছিলেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবক্ষয় ও সাংগঠনিক ভাঙনের লক্ষণ স্পষ্ট ছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এর থেকে কোনো শিক্ষা না নেওয়ায় এবং এই অবক্ষয় ও ভাঙন অব্যাহত থাকার সুযোগ নিয়ে তৎকালীন সামরিক বাহিনীর কিছু অফিসার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে শেখ মুজিবকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগ দলকে ছত্রভঙ্গ করেছিল।
এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতৃত্বের অবক্ষয় ও সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণের শৈথিল্যের দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত হলো, বাংলাদেশকে কোনো অর্থ সাহায্য না করার জন্য মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করার বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিযোগ এবং সে অভিযোগ খণ্ডন করে তাদেরই অর্থমন্ত্রীর বিপরীত বক্তব্য। শেখ হাসিনা ইউনূসের নাম না নিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের একজন নোবেল প্রাইজ পাওয়া ব্যক্তি বাংলাদেশকে কোনো অর্থ সাহায্য না করার জন্য লবিং করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, এই ব্যক্তি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চান। ডক্টর ইউনূসের মনে কি রাজনৈতিক বাসনা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশকে কোনো অর্থ সাহায্য না করার জন্য ডক্টর ইউনূসের তদবির করারও কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আছে বলে মনে হয় না। তিনি গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যা করেছেন তার সঙ্গে এ ব্যাপারকে জড়িত করা যথার্থ মনে হয় না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যা লক্ষ্য করার বিষয় তা হলো, শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রীর পাল্টা বক্তব্য। ডক্টর ইউনূস শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদ করে যা বলেছেন, অর্থমন্ত্রী সেটাই সমর্থন করে বলেছেন, ইউনূস বাংলাদেশকে অর্থ সাহায্য না দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন এটা নিছক প্রপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি এ ধরনের কোনো ব্যাপারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ যাতে কোনো বৈদেশিক সাহায্য না পায় এ জন্য ডক্টর ইউনূস চেষ্টা করেছেন_ এ মর্মে একটা প্রপাগান্ডা চলছে। এই ধরনের কিছু আমি দেখিনি। এর কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই' ( ডেইলি স্টার, ২৪.১০.১১)। যে 'প্রপাগান্ডার' কথা অর্থমন্ত্রী বলেছেন সেটা তো তাদের প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ করেননি। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় নেত্রী যা বলছেন সে বিষয়ে তার অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য বিস্ময়করই বটে! এর থেকে বোঝার কি অসুবিধা আছে যে, আওয়ামী লীগের মধ্যে সাংগঠনিক শৃঙ্খলার অভাব শোচনীয় ব্যাধি। এর থেকে বোঝার কি অসুবিধা আছে যে, মন্ত্রিসভার মধ্যে সমন্বিত চিন্তা ও নীতির ঐক্য বলে কিছু নেই।
এই হলো শাসকশ্রেণীর বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অবস্থা। আওয়ামী লীগের নানা কার্যকলাপ, সরকারের মধ্যে চিন্তার সমন্বয়ের অভাব, মন্ত্রীদের অযোগ্যতা, দুর্নীতি ইত্যাদির কারণে তাদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সুযোগ নিয়ে বিএনপি সর্বপ্রধান বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জোর প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। নানা কৌশলে ও নানা পদ্ধতিতে তারা এ কাজ করছে। কিন্তু তাদের এই কাজের মধ্যে কি গণতান্ত্রিক কোনো উপাদান আছে? যে ইস্যু নিয়ে তারা প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন, যে দাবি নিয়ে তারা বিরাট আকারে মাঠে নেমেছেন তার মধ্যে জনগণের জন্য কি কিছু আছে? জনস্বার্থের কোনো প্রতিফলন কি তার মধ্যে হচ্ছে? বিএনপির কথা হলো, আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি, আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে, কাজেই এ মুহূর্তে তাদের পদত্যাগ করা দরকার। নতুন নির্বাচন দেওয়া দরকার এবং সে নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া দরকার। অর্থাৎ বিএনপির এই দাবিগুলোর মূল লক্ষ্য হলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের ক্ষমতায় যাওয়া দরকার, সরকার গঠন করা দরকার। ক্ষমতায় যেতে চাওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই আন্দোলন যে একেবারে অন্তঃসারশূন্য এবং এক চরম সুবিধাবাদী ব্যাপার এতে সন্দেহ নেই।
দেখা যাবে যে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বড় বড় জনসভায় পরস্পরকে গালাগালই হলো দুই নেত্রীর মূল কাজ। বিএনপি রোডমার্চ, জনসভা, মিছিল, সংবাদ সম্মেলন ইত্যাদির মাধ্যমে এখন যা কিছু করছে তার মধ্যে দেশের জনগণের হাজারো সমস্যা সমাধানের বিশেষ কোনো কথা নেই। কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি তাদের নেই। তাদের মূল কর্মসূচি ও দাবি হলো, বাস্তবত এক দফা : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবিলম্বে নির্বাচন দিতে হবে। অন্য কোনো সমস্যা নিয়ে যে তারা কথা বলছে না এমন নয়, কিন্তু যেভাবে তারা এসব সমস্যা নিয়ে বলছে তার উদ্দেশ্য হলো, আওয়ামী লীগ সরকারকে অকেজো প্রমাণ করা। কোনো সমস্যা সমাধানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বা কর্মসূচি তাদের নেই।
এটা ঠিক যে, আওয়ামী লীগ এখন যা করছে তাতে তারা যে গাছে বসে আছে সেই গাছের ডালই কেটে নিজেদের পতনের পথ পরিষ্কার করছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপি ক্ষমতায় এলে কি জনগণের সোনায় সোহাগা হবে? বিএনপি কি এর আগে দুই দফা ক্ষমতায় থাকেনি? ক্ষমতায় থেকে কি তারা জনগণকে দুধে-ভাতে রেখেছিল? তা যদি রাখত তাহলে ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হতো না। কাজেই আওয়ামী লীগের নানা অপকর্ম ও ব্যাপক দমন-পীড়ন ও দুর্নীতির কারণে জনপ্রিয়তা হারিয়ে চললেও এ কারণে বিএনপি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক গণতান্ত্রিক দলে পরিণত হয়নি। কাজেই বিএনপির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি হতে থাকা এবং আগামী নির্বাচনে তাদের জয়ের সম্ভাবনা থাকলেও এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে জনগণের আশান্বিত এবং উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই।
২৪.১০.২০১১
 

No comments

Powered by Blogger.