পর্যালোচনা-‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জিনিসটা কী?’ by মোহীত উল আলম

পরের প্রশ্নটা আমার নয়। এক সুধী সমাবেশে একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠকি আলাপে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশি প্রবাসী বুদ্ধিজীবী প্রশ্নটা করেছিলেন একজন জাতীয়ভাবে পরিচিত কলাম লেখককে। কোনো তুচ্ছার্থে নয়, আন্তরিকভাবে তিনি জানতে চেয়েছিলেন—অনেকটা এক, দুই, তিন করে পয়েন্ট বাই পয়েন্ট ধরে—কীভাবে আমরা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’কে বুঝতে পারি।


কিন্তু আলোচনা গড়াতে থাকলে ভদ্রলোকের এই সৎ প্রশ্নটি দু-চারজনের মুখে এমনভাবে ঘোরাফেরা করতে লাগল যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি কোনো একটা হালকা ব্যাপার, এবং তখন বুঝলাম যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে তাঁরা একটা হেঁয়ালিপ্রধান ভাববাচ্যকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তাঁরা মনে করছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে এমন একটা বিষয় যেটা নিয়ে ঠাট্টা করা যায়, যেটাকে অন্য বিষয়ের সঙ্গে তুল্যমূল্য ভাবা যায়। উদাহরণটা দিই। আলোচনাটা ঢাকা বিভক্তির বিষয়ে গড়ালে (তখনো ঢাকার বিভাজন নিয়ে গেজেট হয়নি) একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবী খুব খেলো স্বরে বললেন, ওটাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মতো একটি ‘কনফিউজিং’ (!) বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কথাটি নিয়ে যে ঠাট্টা-মশকরা হয় তার সঙ্গে আমরা অপরিচিত নই। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে যাঁদের মনে নানা যৌক্তিক-অযৌক্তিক বিবাদ আছে তাঁরা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রশ্নটাকে নানাভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। দেশে যে দ্বি-বিরোধী রাজনৈতিক সংস্কৃতি ডালপালা মেলেছে, তার একটি অংশে তাঁরা আছেন যাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধটা শাঁখের করাতস্বরূপ, যেটা তাঁরা গিলতেও পারেন না, ফেলতেও পারেন না, এবং তাঁরা বিভিন্নভাবে এই লোক-উসকানো প্রশ্নটি করেন যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে কী বোঝায়।
এই আত্ম-অস্তিত্ব বিনাশক, আত্মমর্যাদা হানিকর ঠাট্টাটি যখন সুধী মহলের আলোচনায়ও একই মাত্রায় আলোচিত হয় তখন আমাদের বুঝতে হবে, একটি মহান রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ফলে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেটি সুধী মহলের অনেকে সচেতনভাবে মানতে চান না। সাধারণ রাজনৈতিক বিপক্ষতার জন্য যখন প্রশ্নটি ওঠে, সেটি কেন উঠল তার উত্তর দেওয়া যায়। কিন্তু যখন আপন আপন ক্ষেত্রে চর্চিত ও পরিশীলিত বুদ্ধিজীবী মহলের কেউ কেউ প্রশ্নটিকে ঠাট্টার মতো বিষয় মনে করেন, তখন মনে মনে আহত হলেও, প্রশ্নটার উত্তর পরিষ্কার করা দরকার।
চেতনা কার্যত একটি অদৃশ্যমান অনুভূতি, কিন্তু এটার দৃশ্যমান প্রতিফলন হয় বাস্তব জগতে কর্মের মাধ্যমে। কর্মটাকে বুঝলে চেতনাটাকেও বোঝা যাবে। খুব সাদামাটাভাবে বললে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে সেই কর্মটি যার ফলে বাঙালির স্বশাসিত একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জিত হয়েছে। ইতিহাস বলছে, বাঙালি কখনো আগে নিজেদের শাসন করেনি, সব সময় বাইরের শক্তি বা রাজবংশ এসে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে শাসন করেছে। ইতিহাস পাঠ করলে এটাও জানা যায়, পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলেও এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রায় প্রথম দিন থেকেই বাঙালি তার ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে অশান্তিতে ছিল। তারা এ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সচেষ্ট হয়। পর্যায়ক্রমে ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা পেশ, গণ-অভ্যুত্থান এবং অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর বাংলাদেশের সৃষ্টি—এসবই হচ্ছে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রারম্ভিক অংশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন তাঁর সাতই মার্চের ভাষণে ঘোষণা দিলেন যে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তখন এ কথাটাই ঘোষিত হচ্ছে যে বাঙালি তার নিজের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি চায়, যেখানে সে নিজেই তার রাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর চর্চা করবে।
নিজের রাষ্ট্রীয় জীবনের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাটা অদ্যাবধি স্বপ্ন হয়ে থাকত, যদি না মুক্তিযুদ্ধ হতো। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ব্রত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৪০ বছর, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কার্যকরতা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। খাপছাড়া গোছের শোনাবে কথাটি, কিন্তু যে বৈঠকি আলাপটি সেদিন আমার মন বিষিয়ে দিয়েছিল, সেটাতে যত সুধীজন অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের এক থেকে শেষ পর্যন্ত সবারই প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে।
আমরা বহু কারণে বিভিন্ন সরকারের বহু কাজের অবশ্যই সমালোচনা করতে পারি, যেমন বর্তমান সরকারের ঢাকা-বিভাজনের মতো কর্মটিকে আমরা নিতান্ত বিভ্রান্তিমূলক বলে সমালোচনা করতে পারি। কিন্তু সেই বিভ্রান্তির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যোগসূত্র পাওয়াটাতে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্যের কিছু খর্ব হলো না, হলো আমাদের সেই চর্চিত মানসিকতার, যার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেন একটি অব্যাখ্যাত জিনিস। অথচ, যদি রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের দর্শনের আলোকে বাংলাদেশকে বুঝতে হয়, তাহলে বুঝব মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবচেয়ে বেশি পরিষ্কৃত ধারণা, সবচেয়ে স্বচ্ছ বাতাবরণ। এটা আমরা আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের কারণে কিংবা ওই কারণে প্রণোদিত ও প্ররোচিত শিক্ষার ফলে বুঝতে না চাইতে পারি, কিন্তু ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দযুগল আমাদের যেকোনো আহরিত সর্বোচ্চ জ্ঞান, শিক্ষা ও ডিগ্রির চেয়ে বেশি স্বচ্ছ। আমাদের শিক্ষায় বিভ্রান্তি থাকতে পারে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি থাকতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে দেশকে ভালোবাসার অপার অঙ্গীকার, যার কাছে নিজের মায়ের প্রতি ভালোবাসা পর্যন্ত হার মেনে যায়। দেশমাতৃকার প্রতি অপূর্ব প্রেমের কারণে কী করে মুক্তিযোদ্ধারা নিজের মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুদ্ধে গেলেন এবং যুদ্ধে প্রাণও দিলেন, সে রকম কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার কিছু ছিন্নপত্র এখানে উল্লেখ করলে বোঝা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি কীভাবে একটা বিভ্রান্তিহীন বিষয় হিসেবে জাগরূক ছিল।
মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহহিল বাকী (সাজু) ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মাকে লিখছেন:
মা,
আপনি এবং বাসার সবাইকে সালাম জানিয়ে বলছি, দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না। তাই ঢাকার আরও ২০টা যুবকের সাথে আমিও পথ ধরেছি ওপার বাংলার। মা, তুমি কেঁদো না, দেশের জন্য এটা খুব ন্যূনতম চেষ্টা।...
তোমারই বাকী (সাজু)।
খিলগাঁও নিবাসী আবদুল্লাহহিল বাকী মুক্তিযুদ্ধে ডিসেম্বর মাসে শহীদ হন। বীর-প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ খোরশেদ আলম লিখছেন তাঁর মাকে:
মা,
দোয়া করো। তোমার ছেলে আজ তোমার সন্তানদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে চলেছে। বর্বর পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠী আজ তোমার সন্তানদের ওপর নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। যেখানে তোমার সন্তানদের ইজ্জতের ওপর আঘাত করেছে, সেখানে তো তোমার সন্তানেরা চুপ করে বসে থাকতে পারে না। তাই আজ তোমার হাজার হাজার বীর সন্তান বাঁচার দাবি নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তোমার নগণ্য ছেলে তাদের মধ্যে একজন। পরম করুণাময় আল্লাহ্্র কাছে দু হাত তুলে দোয়া করি, তোমার সন্তানেরা যেন বর্বর পাকিস্তানি জনগোষ্ঠীকে কতল করে এ দেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে পারে। এ দেশের নাম হবে বাংলাদেশ, সোনার বাংলাদেশ। এ দেশের জন্য তোমার কত বীর সন্তান শহীদ হয়ে গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ইনশাল্লাহ্্ শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। দেশকে স্বাধীন করে ছাড়বই। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। দোয়া করো যেন জয়ের গৌরব নিয়ে ফিরে আসতে পারি।
ইতি,
তোমার হতভাগ্য ছেলে খোরশেদ।
মো. আবদুর রউফ ববিন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে মাকে লিখছেন:
...আমি তোমাকে বললাম, মা, আমি চলে যাচ্ছি। তুমি মুখের দিকে তাকালে। আমি বলেছিলাম, মা, আমি মুক্তিবাহিনীতে চলে যাচ্ছি। উনুনের আলোতে তোমার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তোমার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তুমি দাঁড়িয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তাকালে। আমার ঘরের পেছনে বেলগাছটার কিছু পাতা বাতাসে দোল খেয়ে আবার স্থির হয়ে গেল। মা, সেদিন সন্ধ্যাতেই তুমি আমাকে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিলে।
জাহানারা ইমামের সঙ্গে তাঁর ছেলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমীর সংলাপের একটি অংশ এখানে প্রাসঙ্গিক:
আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব, কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও, আম্মা? (মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধৃত পত্রাংশগুলোর সংগ্রহ সূত্র: সেলিনা হোসেন, ‘অবরুদ্ধ ঢাকা শহরের জীবনযাত্রা ও গোপন প্রতিরোধ’, মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা ১৯৭১, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১০)
রুমীর কথা ধরে বলছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে ‘বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে’ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলভূমি বা একেবারে নিখাদ বাস্তবতা হচ্ছে সেখানে যেখানে সন্তান তার দেশ এবং মায়ের মধ্যে বাছাই করতে গিয়ে মায়ের প্রতি ভালোবাসাকে দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসায় ছড়িয়ে দিতে কোনো দ্বিধা করছে না। এই কঠিন সত্যের ধারেকাছে আমরা কখনো যেতে পারব না, এবং দেশকে ভালোবাসতে গিয়ে যে শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের এই মহান ত্যাগের—আব্রাহাম লিংকন যেমন বলেছিলেন তাঁর গ্যাটিসবার্গ বক্তৃতায়—কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি আমরা করতে পারব না, কিন্তু তাঁদের আরাধ্য স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে তো আমাদেরই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের জন্য হবে নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ দিয়ে দেশের জন্য কাজ করে যাওয়া। কোথায় না থাকবে এ ব্যাপারে আমাদের শতকরা ১০০ ভাগ নিবেদন, তা না করে সে জায়গায় আমরা তো একটা হেঁয়ালি ভরা, ধোঁয়াটে তাচ্ছিল্য মাখা ও অহংকার ভরা ডিসকোর্সকে প্রাধান্য দিয়ে ‘বীরের সদগতি হতে’ জাতিকে ‘ভ্রষ্ট’ হতে বলতে পারি না (উদ্ধৃত শব্দনিচয় রবীন্দ্রনাথের ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’ কবিতা থেকে আহূত)।
ড. মোহীত উল আলম: সভাপতি, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব।
mohit_13_1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.